bengali wedding

হারিয়ে গিয়েছে বিয়ের ছড়া

সুতরাং বিয়েতেও যে নানা ধরনের ছড়া থাকবে তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে! আগে পাড়াগাঁয়ে পান, সুপারি দিয়ে নেমন্তন্ন করার চল ছিল। বন্ধু-বান্ধবদের নিমন্ত্রণ করার সময় বাজার থেকে কয়েকটা কার্ড নিয়ে এসে হাতে লেখা হত লালকালিতে রঙ বাহারি ছড়ায় নিমন্ত্রণ-লিপি। যেমন, ‘‘বন্ধু তোমায় জানাই খবর/ হয়তো তুমি হাসবে। লিখছেন স্বপনকুমার ঠাকুরবিয়ের বাসরে গান, বাজনা-সহ জলসহায় গান, ঢেঁকি মোঙলানোর গান আজও শোনা যায়। আর বিয়ে মানেই কাব্যময়। ছাদনাতলার ছড়া, নেমন্তন্ন করার ছড়ার চিঠি আর সেই সঙ্গে নাপিতের কণ্ঠে ছড়া এবং বিয়ের আসরে বর্ণাঢ্য পদ্যপাঠ। এগুলি অনেকাংশেই বর্তমানে লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০২:০২
Share:

বিবাহ অনুষ্ঠান। ফাইল ছবি

কথায় আছে, ‘জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে/ তিন বিধাতা নিয়ে।’ জন্ম-মৃত্যুর মতো বিয়েটাও অধিকাংশ নরনারীর কাছে রহস্য রোমাঞ্চকর এক বিমিশ্র বিষয়। হিন্দুদের চোখে বিয়ে আবার দশবিধ সংস্কারের মধ্যে শেষ বা চরম সংস্কার। তবে পুরুষদের তুলনায় মেয়েদের কাছে বিবাহ অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সাধারণত পিতৃকুলের গোত্র পরিত্যাগ করে তিনি স্বামীকুলের গোত্র ও পদবি গ্রহণ করেন। সুতরাং বিবাহ মানেই হিন্দুনারীর কাছে এক চরম সন্ধিক্ষণ। তাই বিয়েতে নানা ধরনের শাস্ত্রীয় ও মেয়েলি আচার অনুষ্ঠান পালন করতে হয়। এই আচার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি, বিয়েতে থাকে তিনটি আকর্ষণীয় পর্ব—লোকখেলা, গান আর পদ্য মানে ছড়া। লোকখেলা যেমন, কড়িখেলা, পাশাখেলা, ভাঁড়কুলোখেলা ইত্যাদি। বিয়ের বাসরে গান, বাজনা-সহ জলসহায় গান, ঢেঁকি মোঙলানোর গান আজও শোনা যায়। আর বিয়ে মানেই কাব্যময়। ছাদনাতলার ছড়া, নেমন্তন্ন করার ছড়ার চিঠি আর সেই সঙ্গে নাপিতের কণ্ঠে ছড়া এবং বিয়ের আসরে বর্ণাঢ্য পদ্যপাঠ। এগুলি অনেকাংশেই বর্তমানে লুপ্ত বা লুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছে।

Advertisement

বিয়ের পদ্য নিয়ে বিস্তারিত চর্চা করা যায়। তার আগে ছড়া নিয়ে দু’চার কথা বলা যেতে পারে। বাংলার মায়েদের এক স্বভাবগত সৃষ্টি হল এই ছড়া। ছেলে-ভুলনোর ছড়া থেকে ঘুম-পাড়ানির গান, প্রবাদ প্রবচনে সর্বত্রই ছড়া সৃষ্টি করেন বাংলার বধূরা। তা-ও মুখে মুখে। বাংলার কবিয়ালেরাও আসরে বলেন, ‘‘মায়া মমতায় গড়া/ বাংলা মায়ের ছড়া।’’

সুতরাং বিয়েতেও যে নানা ধরনের ছড়া থাকবে তাতে আর বিস্ময়ের কী আছে! আগে পান, সুপারি দিয়ে নেমন্তন্ন করার চল ছিল। বন্ধু-বান্ধবদের নিমন্ত্রণ করার সময়ে বাজার থেকে কয়েকটা কার্ড নিয়ে এসে লাল কালিতে রং বাহারি ছড়ায় নিমন্ত্রণ-ছড়া লেখা হত। যেমন, ‘‘বন্ধু তোমায় জানাই খবর/ হয়তো তুমি হাসবে।/ ৮ই ফাগুন আমার বিয়ে / নিশ্চয় তুমি আসবে।।’’
বিয়ের দিন ছাদনাতলায় সুন্দর করে আলপনা দেওয়ার চল আছে। বড় করে দু’টি উড়ন্ত প্রজাপতি আঁকা হত। আগেকার বিয়ের আলপনায় দেখা যায়, চারপাশে লতাপাতার অলঙ্করণ। বর, কনের বসার পিঁড়ি দু’টিও অলঙ্কৃত হত সুচিত্রিত আলপনায়। বর্গাকার ছাদনাতলায় লেখা হত ‘শ্রীশ্রীপ্রজাপতয়ে নমঃ’। তার পরেই লেখা থাকত দুই পঙ্‌ক্তির ছড়া।
কন্যা সম্প্রদানের বা মধুপর্ক দানের পরে নাপিত ছড়া কাটেন। একে সাধারণত ‘গৌরবচন’ বলা হয়। অনেক সময়ে আবার বিবাহের শুভদৃষ্টি বা মালাবদলের সময়ে এই ছড়া বলা হয়, যেমন, ‘‘শুনুন শুনুন মহাশয় করি নিবেদন।/ রামসীতার বিবাহ কথা করুন গো শ্রবণ।।/ যথাধ্বনি উলুধ্বনি করুন সকলে।/ হর গৌরীর মিলন হল শুভকালে।।’’

Advertisement

এ বার আসি বিয়ের পদ্যের কথায়। বিয়ের পদ্য বর ও কনে দুই পক্ষেই ছাপাত। বরের বন্ধুরা আবার আলাদা করে বিয়ের পদ্য পাঠ ও তা বিলির ব্যবস্থা করতেন বিবাহসভায়। পদ্য-পাঠের সাধারণ নিয়ম ছিল, কনেকে সিঁদুর দান করার পরে অথবা বাসরঘরে যাওয়ার পূর্বে নাপিত ঘোষণা করতেন এ বার বিয়ের পদ্য পড়ার পালা। বর বা কনেপক্ষের পারিবারিক পদ্যপাঠ করার পরে ছেলের বন্ধুদের এক জন পদ্য পড়তেন। পদ্য শুনে উপস্থিত ব্যক্তিরা হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাত। তবে মেয়ের বন্ধুদের কবিতা ছাপানো বা পাঠের ব্যবস্থা দেখা যেত না। বিয়ের পদ্য সাধারণত তিন ধরনের হত— ছড়াকারে লেখা, গদ্যে লেখা আর গদ্যপদ্য মিশিয়ে লেখা। পারিবারিক পদ্যগুলি ছিল ক্ষুদ্র পুস্তিকা স্বরূপ। এখানে বাবা, মা, কাকা, কাকিমা, দাদা, বৌদি, দাদু, ঠাকুমা, ভাইপো, ভাইঝি বা ভাগ্নে-ভাগ্নির বয়ানে পদ্য লেখা হত। এ ধরনের পদ্যগুলিতে আশীর্বাণী, মৃত নিকট আত্মীয়কে স্মরণ করে শোকোচ্ছ্বাস ইত্যাদির পাশাপাশি, ছোটদের বয়ানে পদ্যর শিরোনাম থাকত— ‘দিদির বিয়েতে একটু চাটনি’, ‘মামার বিয়েতে ধামাকা’ ইত্যাদি। যেমন, ‘‘তেল হলুদের বন্যায় মুড়কি মুড়ি ভেসে/ বোঁদে ব্যাটা ভিজে মরে পড়ে চিনির রসে।।’’

পদ্যর শেষে থাকত ইতি তোমার ভাই-বোনেরা, মা, বাবা ইত্যাদি শব্দমালা। পদ্য শুরু হতো ‘শ্রীশ্রীপ্রজাপতয়ে নমঃ’ বাক্য দিয়ে। দু’দিকে দু’টি প্রজাপতির ছবি। তারও উপরে ছাপা হত মালা হাতে দু’টি পরি বা বিদ্যাধর-বিদ্যাধরী। কাগজগুলি ছিল হালকা লাল, সবুজ বা হলুদ রঙের। পদ্যপাঠের পরে উপস্থিত শ্রোতা দর্শকদের বিলি করা হত। ৯০-এর দশকের শুরুতে গ্রামবাংলা থেকে বিয়ের পদ্যপাঠ বিলুপ্ত হতে থাকে।

একটা প্রশ্ন অনেকেই তোলেন, বিয়ের পদ্যপাঠ কবে থেকে শুরু হয়েছিল? এ কথা সত্য প্রাচীন বা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বিয়ের নানা আচার অনুষ্ঠান, লোকখেলা, গানবাজনার বিবরণ থাকলেও পদ্যপাঠের কোনও প্রসঙ্গ নেই। যতীন্দ্রমোহন গুপ্ত এই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন যে, ১৩০৪ বঙ্গাব্দে কলকাতায় রাজা সুবোধ মল্লিকের বিয়ের সময় প্রথম পদ্য ছাপানো হয়েছিল। কারও কারও মতে রাজা প্রফুল্লনাথ ঠাকুরের বিবাহ উপলক্ষে পিতামহ কালীকৃষ্ণ ঠাকুর তাঁর মৃত পুত্র শরদ্বিন্দুনাথকে স্মরণ করে এক শোকবিলাপ মুদ্রণ ও পাঠের ব্যবস্থা করেন। যাই হোক, বিয়ের পদ্য বিশ শতকের প্রথম দিকে যে ব্যাপক মাত্রায় শুরু হয়েছিল সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

অধিকাংশ ছাপাখানায় হরেক রকম বিয়ের পদ্যের নমুনা আগে থেকেই সংগৃহীত থাকত। যারা পদ্য ছাপাতে যেতেন তাঁরা পছন্দ করার পরে বর-কনের নাম, বিয়ের তারিখ, বিবাহবাসর এবং কারা লিখছেন তাদের নামগুলি লিখে নিতেন। অনেকেই আবার কবিযশোঃপ্রার্থী, কবিয়াল বা প্রতিষ্ঠিত কবিদের কাছে লিখিয়ে নিয়ে আসতেন বিয়ের পদ্যগুলি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিয়ের পদ্য না লিখলেও অনেক বিয়েতে তিনি আশীর্বাণী লিখে দিতেন। লীলাদেবী, দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের কন্যা ইন্দিরা, লালাগোলার রাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ এবং কবি অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে কোচবিহারের রাজকন্যা ইলাদেবীর বিয়েতেও তিনি সানন্দে আশীর্বাণী লিখে দিয়েছিলেন। তবে প্রথম শ্রেণির বিয়ের পদ্যকার ছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। কাটোয়ার ডাকসাইটে ডেপুটি ছিলেন কবি তারকচন্দ্র রায়। তারকবাবুর শালার বিয়েতে পদ্য লিখে দিয়েছিলেন কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। আচার্য হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের সংগৃহীত সেই পদ্যটি লেখা হয়েছিল ১৩২২ সালের ১৮ মাঘ। পদ্যটি লেখা হয়েছিল তারকবাবুর নাতির নামে, ‘‘আজকে তোমার বইবে তুফান বুকে/ মুখেতে আর বলবো আমি কত/ দুই জনেতে থাক পরম সুখে/ একটি বোঁটায় দুটি ফুলের মতো।।’’

বিয়ের পদ্য দেবদেবীর বিয়েতেও লেখা হয় এবং পাঠ করা হয়। বর্ধমানের সগড়াই গ্রামে ধর্মরাজ ও মনসাদেবীর বিয়ে উপলক্ষে পদ্যপাঠের রীতি আছে, ‘‘যুগে যুগে এইভাবে কাটে কতকাল।/ সগড়াইবাসীর কিবা সুখের কপাল।।/ প্রতি বর্ষে ধর্ম বিয়ে মনসা মিলন।/ দেখিতেছে গ্রামবাসী যাবজ্জীবন।।’’

ইতিহাস গবেষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement