নিবেদিতার গহন সত্তায় ছিল ঘুমন্ত এক অগ্নিশিখা। ঋষি অরবিন্দ সেই শিখাকে দেখেই নিবেদিতার নাম দিয়েছিলেন ‘শিখাময়ী’। ভিতরের ঘুমন্ত শিখার জ্বলে ওঠার তৃষ্ণাই তাঁকে অস্থির করে তুলেছিল সুদূর আয়ারল্যান্ডে, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দেওয়ার মুখেই। তখন তিনি মিস মার্গারেট এলিজ়াবেথ নোবল।
দ্বন্দ্বে দীর্ণ মার্গারেটের অন্তরের ঘুমন্ত শিখায় অগ্নিসংযোগ করলেন সূর্যের মতো দীপ্তিমান ও তেজোদীপ্ত সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ। নিবেদিতার অন্তরে সৃষ্টি হল মহা আলোড়ন। তিনি এই দহনদানে নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন করলেন— তাঁর নবজন্ম ঘটল। স্বামীজি তাঁর নাম দিলেন— ‘নিবেদিতা’। গুরুর ডাকে পুরনো জীবন ত্যাগ করে হয়ে উঠলেন ভারতসেবিকা।
গুরুর সে ডাক ছিল আত্মার ডাক। পাশ্চাত্যের আরামনিলয় হেলায় ছেড়ে তিনি বাস করতে লাগলেন উত্তর কলকাতার সরু গলির দারুণ গরম আবহাওয়ায়। পাশ্চাত্যে তখন তাঁর বেশ সম্মান ও প্রতিষ্ঠা— সবই জীর্ণ বস্ত্রের মতো ত্যাগ করলেন। জীবন অনন্তের বেদিতে প্রতিষ্ঠিত— এই নতুন বার্তা নিবেদিতা এমন এক জনের কাছ থেকে পেলেন, যাঁর চিন্তা-চেতনায় সেই অনন্তের আলোক বিচ্ছুরণ! এর পর আর আগের মতো থেকে যাওয়া অসম্ভব।
এই প্রসঙ্গে ১৯০৪ সালে নিবেদিতা লিখেছেন, ‘‘ভিতরে আমার আগুন জ্বলতো, কিন্তু প্রকাশের ভাষা ছিল না। এমন কতদিন হয়েছে কলম হাতে নিয়ে বসেছি অন্তরের দাহকে রূপ দেব বলে— কিন্তু কথা জোটেনি। আর আজ আমার কথা বলে শেষ করতে পারি না। দুনিয়ায় আমি যেন আমার ঠিক জায়গাটি খুঁজে পেয়েছি।... এবার তীর এসে লেগেছে ধনুকের ছিলায়।’’ নিবেদিতা ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হলেন। ভারত-সেবা রূপ অভিযানে ছুটে বেড়ালেন এ দেশের সর্বত্র। স্বামীজি এই ঘুমন্ত জাতিকে চাবুক মেরে জাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বীর সন্ন্যাসীর সেই অগ্নিকে অন্তরে বহন করে নিবেদিতা ভারতকল্যাণে ঝাঁপ দিলেন। অপূর্ব সেই আত্মসমর্পণ, অপূর্ব সেই সেবা! স্বামীজির মহাপ্রয়াণের পর সারা ভারতে গুরুর আবির্ভাব দেখতে পেয়েছিলেন নিবেদিতা— তাই তো কর্মের মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। গুরু এবং তাঁর আদর্শের প্রতি নিবেদিতা ছিলেন এতটাই খাঁটি যে, কোনও বাধাই তাঁর কাছে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। এই আত্মনিবেদনে তাঁর শরীর পর্যন্ত তুচ্ছ হয়েছিল। ধূপ যেমন নিজে পুড়ে চারিদিক সুগন্ধে পূর্ণ করে, তেমন করে তিলে তিলে নিজেকে দান করলেন ভারতের মাটিতে। নীরবে আড়াল থেকে ভারতীয় মানবসম্পদকে তিনি প্রেরণা দিয়েছেন। সান্ত্বনা দিয়েছেন, উজ্জীবিত করেছেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু, এমনকি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত অনেকেই এই ব্যতিক্রমী নারীটির কাছে ঋণী। তিনি বাইরের জয়ঢাক বাজাননি। কেবল গোপনে গভীর সেবা করে গিয়েছেন!
কলকাতায় ১৮৯৯ সালে প্লেগ মহামারি রূপে দেখা দিল। শয়ে শয়ে মানুষ মৃত্যুমুখে। আতঙ্কে মানুষ শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। স্বামীজির নেতৃত্বে রামকৃষ্ণ মিশন থেকে প্লেগ রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য কমিটি গঠিত হল। নিবেদিতা হলেন তার সম্পাদক। সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লিখে ও বক্তৃতার মাধ্যমে জনচেতনা জাগানোর চেষ্টার সঙ্গে পরিবেশকে শুদ্ধ ও পরিষ্কার রাখতে নিজে কাজে হাত লাগাতেন। বাগবাজারের গলিতে ঝাঁটা হাতে জঞ্জাল পরিষ্কার করতে দেখা গেল এই আইরিশ দুহিতাকে। লজ্জায় পাড়ার যুবকেরা সে কাজে এগিয়ে এলেন। এই ভাবে নিবেদিতা সাধারণের মধ্যে সচেতনতা ও কর্তব্যবোধ জাগিয়ে তুলতেন। ডাক্তার রাধাগোবিন্দ করের (আর জি কর) পরামর্শে রোগাক্রান্ত মানুষের চিকিৎসা হত। তিনি নিবেদিতাকে সাবধান করেছিলেন, শরীর দুর্বল। তাই তিনি যেন মারণব্যাধির ছোঁয়া থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলেন। এক দিন ডাক্তার কর বস্তিতে রোগ পরিদর্শন করতে গিয়ে অবাক! স্যাঁতসেঁতে কুঁড়েঘরে প্লেগ রোগাক্রান্ত মা-হারা শিশুকে কোলে করে নিবেদিতা বসে আছেন। ঘরটি শুদ্ধ করতে হবে বুঝে মহীয়সী নিজেই মই নিয়ে তা চুনকাম করলেন। এত সেবা সত্ত্বেও শিশুটি বাঁচল না। ‘মা’ ‘মা’ বলে শেষ সময়ে নিবেদিতাকেই নিজের মা ভেবে জড়িয়ে ধরল সেই মৃত্যুপথযাত্রী মানবসন্তান। একেই তো বলে শ্রীমদ্ভভগবদ্গীতা-য় বর্ণিত নিষ্কাম সেবা।
আজ আমরা আবার অতিমারির ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সম্মুখীন। এই সময় নিবেদিতার ওই অপূর্ব সেবিকা-মূর্তি আমাদের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠুক। তিনি নিজেকে কতখানি ভুলে গিয়ে সেবা করতেন, তা স্বামীজির গুরুভাই স্বামী সারদানন্দর মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে লেখা একটি চিঠির মাধ্যমে জানতে পারি: ‘‘শি (সিস্টার নিবেদিতা) হ্যাজ় গ্রোন থিনার দ্যান বিফোর... বাট দ্য ‘ডিয়ার গার্ল’ ডিড বিয়ন্ড হার লাইফ টোয়াইস দ্যাট ওয়ে...’’ (তিনি আগের চেয়ে শীর্ণকায় হয়ে গিয়েছেন, কিন্তু এই প্রিয় কন্যেটি এ ভাবেই তাঁর মর্তজীবনের সীমানাকে দ্বিগুণ অতিক্রম করে চলেছেন।)
১৯০৬ সালে প্রবল বন্যায় পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হয়। নিবেদিতা তখন অসুস্থ। তা সত্ত্বেও নিজের শরীরের কষ্ট অগ্রাহ্য করেই ছুটে গিয়েছেন জল, কাদা পেরিয়ে অস্বাস্থ্যকর জায়গায় বন্যাবিপর্যস্ত মানুষদের ত্রাণে।
স্বামীজির অগ্নিসত্তার তেজ নিজের মধ্যে ধারণ করে নিজেকে ভারতের সেবায় সম্পূর্ণ বিলিয়ে দিয়ে অকালে অনন্তে মিশে গেলেন নিবেদিতা। যাওয়ার সময় সেই আলো ও সূর্যোদয়ের স্বপ্ন নিজের অন্তরে দেখতে দেখতে বিদায় নিলেন। বলে গেলেন, ‘‘নৌকা ডুবছে। কিন্তু আমি সূর্যোদয় দেখব!’’ শিখাময়ী হয়ে উঠলেন সূর্যতনয়া।