নিজের স্টুডিয়োয় সত্যেন। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য। উপরে, সত্যেনের তোলা কিছু ছবি।
কৃষ্ণনগরের শেষ মাথায় জলঙ্গি নদীর রেল সেতুটার নীচে শেষ বিকেলে একটা ক্যামেরা নিয়ে ছবি তুলছিল দুই স্কুলপড়ুয়া। সময়টা চল্লিশের দশকের শেষ দিকে। রেজিস্ট্রি কোর্টের কাজ শেষ করে সাইকেল চেপে সেই রাস্তা দিয়ে বাহাদুরপুরে বাড়ির দিকে ফিরছিলেন এক মুহুরী। তখনই তাঁর চোখে পড়ে ছেলে দুটোকে। দেশ ভাগের পর সে সময় দলে দলে মুসলিম পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে (এখন বাংলাদেশ) চলে যাচ্ছেন। সে কারণেই পাসপোর্ট বানানোর জন্য, পাসপোর্ট ছবির বাজারও তুঙ্গে। মুহুরীও সেই উদ্দেশ্যে ওই ছেলেদুটোকে পাকড়াও করেন। এদের মধ্যে একজন রাজি হয়ে যায় পাসপোর্ট ছবি তুলতে। সেই শুরু নেশাকে পেশা করে নেওয়ার।
ছেলেটার নাম সত্যেন মণ্ডল। জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৪ মার্চ। ছয় বোন চার ভাইয়ের মধ্যে সত্যেন ছিলেন অষ্টম সন্তান। মালোপাড়া বারোয়ারির কাছে তাঁর বাবা নলিনাক্ষ মণ্ডলের তেলেভাজার দোকান ছিল। পেশায় ঠিকাদার সত্যেনের বড় মামা বৈদ্যনাথ দাক্ষীর ছিল ফোটোগ্রাফির শখ। বড় মামার কাছেই কাঁচের নেগেটিভের প্লেট ক্যামেরা দেখে ছবি তোলার প্রবল ইচ্ছে চেপে বসে কিশোর সত্যেনের মনে।
স্কুলেরই এক বড়লোক বন্ধুকে ফোটোগ্রাফি শেখার টোপ দিয়ে ১২০ ফরম্যাটের ৮ এক্সপোজারের কোডাক বক্স ক্যামেরা কেনান সত্যেন। বন্ধুর সেই ক্যামেরায় তাঁর ফোটোগ্রাফির হাতেখড়ি। ওই মুহুরীর কথাতেই বন্ধুর ক্যামেরাতেই পাসপোর্ট ছবি তোলা শুরু। দিদিদের কালো কাপড় খাটের পায়ার সঙ্গে বেঁধে খাটের তলাটাই হয়ে উঠেছিল ছোট্ট সত্যেনের ডার্করুম। নেগেটিভ ডেভলপের কাজটা হত সেখানেই। সূর্যের আলোকে সরাসরি নেগেটিভের মধ্যে দিয়ে ফোটো পেপারের উপর ফেলে করা হত প্রিন্ট। এ ভাবেই পড়া আর ফোটোগ্রাফি চর্চা।
১৯৫১ সালে ম্যাট্রিকুলেশনের শেষ ব্যাচের পরীক্ষার্থী হয়ে কৃষ্ণনগর সি এম এস স্কুল থেকে পাস করেন সত্যেন। আর্থিক অনটনে কলেজে ভর্তি হওয়া হল না। ছবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে তখন বাবার দোকানও সামলাতে হত। পড়তে না পারার কষ্টটা ছিল মনের মধ্যে। তখন মধ্যবিত্ত বাঙালি ফোটোগ্রাফি চর্চা করে— এ ছিল ভাবনার অতীত। সে সময়ে বাঙালি ফোটোগ্রাফার রাধু কর্মকার মুম্বইয়ে সিনেমার ক্যামেরাম্যান হিসাবে খুব নাম করেছিলেন। তাই সত্যেনের ফোটোগ্রাফি চর্চাকে বিদ্রুপ করে বন্ধুমহলে অনেকেই তাঁকে ‘রাধু’ নামে ডাকতেন। স্কুলজীবনের বন্ধু বিশিষ্ট লেখক সুধীর চক্রবর্তী স্মৃতি হাতড়ে বলেন— ‘‘রাধু নামে কোনও দিনই রাগ করেনি সত্যেন।’’
এর মধ্যে পাসপোর্ট ছবি তুলে হাতে কিছু টাকা জমেছে। সেই টাকায় একটা ১২০ ফরম্যাটের ১২ এক্সপোসারের আইসোলেট ক্যামেরা কেনেন সত্যেন। তার কিছুদিন পরে একটা জার্মান টুইন লেন্স রিফ্লেক্স রোলিকর্ড ক্যামেরা কিনে চুটিয়ে ছবি তোলা শুরু। এই ক্যামেরাতেই পরবর্তী ক্ষেত্রে তিনি ‘অপুর সংসার’ আর মুক্তিযুদ্ধের ছবি তুলেছিলেন। কৃষ্ণনগরের জর্জকোট মোড়ে একটা ভাড়াবাড়িতে সত্যেনের ছোটমামার পেট্রল বিক্রির দোকান ছিল। ১৯৫৫ সালে ছোটমামার সেই দোকানেই ‘আলেখ্য’ স্টুডিয়ো খোলেন সত্যেন। বাড়িটা পরে কিনে নেন। আলেখ্য ভীষণ প্রিয় ছিল সত্যেনের। সন্ধে হলে সেখানে শহরের গুণী মানুষদের আড্ডা বসত। ষাটের দশকে মনীশ ঘটক থেকে শুরু করে আশির দশকে সুবোধ সরকার, জয় গোস্বামী সবাই এসেছেন এই আলেখ্যয়। সত্যেন না থাকলেও আলেখ্যর আড্ডাটা রয়ে গিয়েছে।
১৯৫৯ সালের জানুয়ারিতে ‘অপুর সংসার’-এর শুটিংয়ে মহেশগঞ্জের জমিদার পালচৌধুরী বাড়িতে এসেছিলেন সত্যজিৎ রায়। সত্যেন ছুটলেন সেই ছবির শুটিংয়ের ফোটোগ্রাফি করতে। সত্যজিতের সঙ্গে সত্যেনের প্রথম আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন প্রোডাকশন ম্যানেজার অনিল চৌধুরী। মহেশগঞ্জে শুটিং স্পটে গিয়ে দেখা হয়ে যায় স্কুলজীবনের আর এক সহপাঠী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। শোনা যায়, সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ডেভেলপের জন্য আলেখ্য স্টুডিয়োর ডার্করুম ব্যবহার করেছিলেন সেই সময়ে।
ওই বছরেরই নভেম্বর মাসে সত্যজিতের ইচ্ছেয় কৃষ্ণনগর থেকে দুই প্রতিমাশিল্পী কানাই, বলাইকে মুর্শিদাবাদের নিমতিতা রাজবাড়িতে ‘দেবী’ সিনেমার শুটিংয়ের জন্য দুর্গা প্রতিমা বানাতে নিয়ে যান সত্যেন। ‘দেবী’র শুটিংয়েরও অনেক ছবি তুলেছিলেন প্রিয় রোলিকর্ড ক্যামেরা দিয়ে। এই দুটো সিনেমার শুটিংয়ের ২৫০টি নেগেটিভ নন্দনে সত্যজিৎ রায় আর্কাইভ-এ সংরক্ষিত আছে।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত একটা অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে কৃষ্ণনগর। এই সময়টাতেই সত্যেন হয়ে উঠলেন পুরোদস্তুর চিত্র সাংবাদিক। শহর উত্তাল হল ছেষট্টি সালের খাদ্য আন্দোলনে। ৬৬ সালের ৪ মার্চ কৃষ্ণনগরে বিভিন্ন সরকারি দফতরে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ওই দিনই পোস্ট অফিস মোড়ে আন্দোলনকারীদের মিছিলে পুলিশের গুলিতে মারা যান আনন্দ হাইত। পরের দিন মৃতদেহ নিয়ে মিছিলের সময় পুলিশের গুলিতে মারা যান অর্জুন ঘোষ। পুলিশের গুলিতে মারা যান হরি বিশ্বাস। আন্দোলনকারীদের হাতে মারা যান নরেন দাস আর সুদর্শন ঘোষ নামে দুই পুলিশকর্মীও। ঘটনার পর জ্যোতি বসু এসেছিলেন আনন্দ হাইতের বাড়ি। সাদা-কালো ১২০ নেগেটিভে সে সবই ধরা আছে চিত্র সাংবাদিক সত্যেনের ক্যামেরায়।
এর পর শুরু হয় নকশাল আন্দোলন। চিত্র সাংবাদিক সত্যেন পেয়েছিলেন কার্ফু পাস। ৭১ সালে বন্যা আর মুক্তিযুদ্ধ। জেলাশাসক দীপক ঘোষ যুদ্ধের সময় সেক্টরের ছবি তোলার জন্য ফোটোগ্রাফার হিসাবে সত্যেনকে দায়িত্ব দিলেন। রোলিকর্ড কাঁধে সেনাবাহিনীর গাড়িতে চেপে সত্যেন ছুটলেন বাংলাদেশ। কুষ্টিয়া, যশোর, নোয়াখালি ঘুরে ছবি তুলে ফিরতেন বেশ কয়েক দিন পরে। এসেই প্রিন্ট করে আগে সাইকেল চেপে স্টেশনে গিয়ে ট্রেনের ড্রাইভারের হাত দিয়ে কয়েকটা ছবি বিভিন্ন সংবাদপত্রের অফিসে পাঠিয়ে, বাকি সব প্রিন্ট দিতেন জেলা প্রশাসনকে। সত্যেন যখন ছবির জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তখন তাঁর স্টুডিয়ো সামলাত দুই ভাগ্নে মাধব দাস আর বংশী মোদক। সত্যেন আজ নেই। কিন্তু বংশী এখনও একাই আগলে রেখেছেন আলেখ্যকে।
ছবি অন্তপ্রাণ সত্যেন বাড়িতে থাকতেন খুব কম। স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হত দু’বেলা খাওয়ার সময়ে। বাড়িতে সময় দিতে পারতেন না বলে মৃদু অভিযোগও আছে স্ত্রী জোৎস্নার। তবে প্রতি বছর দুর্গাপুজোয় সন্ধিপুজোয় নিয়ম করে রাজবাড়ি যেতেন সত্যেন। রাজবাড়ির দুর্গার অনেক ছবি ধরা আছে তাঁর ক্যামেরায়। বেশ কিছু দুর্গার মুখের ছবি আর তাঁর ব্যবহারের দুটো ক্যামেরা বর্তমানে সাবর্ণ রায়চৌধুরী সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে।
আশির দশক পর্যন্ত চুটিয়ে সাদা-কালো ছবি তুলেছেন সত্যেন। তার পরের সময়টায় ফোটোগ্রাফির যে দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকল, রঙিন ছবির বাড়বাড়ন্ত, ডিজিটাল ফোটোগ্রাফির যুগের সূচনা, সেই সময়টা মেনে নিতে পারেননি তিনি। সাদা-কালো ছাড়া যে ভাল ছবি হতে পারে, কোনও দিনই মন থেকে মানতে পারেননি তিনি। তাই হঠাৎ থেমে গেলেন ১২০ মিমি নেগেটিভের সাদা-কালো ছবির সম্রাট। বংশীর হাতে দায়িত্ব দিয়ে স্টুডিয়োয় বসে থাকতেন বেশির ভাগ সময়।
২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি অপূর্ণ ইচ্ছে রেখে চিরতরে চলে যান সত্যেন। শেষ জীবনে মেয়ে সুপ্রমাকে প্রায়ই বলতেন, তাঁর আলেখ্য যেন সংগ্রহশালা হয়েই থাকে। ‘‘আমি যখন রইব না আমার ছবি কইবে কথা’— বাবার এই কথাটা আজও সুপ্রমার কানে বাজে।