কেন্দ্র তার বাজেট পেশ করেছে। রাজ্য করেছে তার আগেই। দুই মিলিয়ে বাংলার চাষি কী পেল? ধানের দাম যে তেমন কিছু বাড়বে না, তা এত দিনে বোঝা গিয়েছে। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি যা বললেন (উৎপাদন খরচের উপর পঞ্চাশ শতাংশ বাড়বে), তাতে আগামী কার্তিকে ধানের সরকারি দর দাঁড়াবে ১৬৭৫ টাকার আশেপাশে। এ বছরের চাইতে ১২৫ টাকা মতো বেশি। তাতে কী এমন এসে গেল?
এ বছরেই তো একশো টাকা বেড়েছিল গত বছরের চাইতে (কেন্দ্র আশি, রাজ্য কু়ড়ি)। চাষিদের দাবি মেনে সরকার যদি উৎপাদন খরচের মধ্যে জমির ভাড়াও ধরত, তাতে ধানের সরকারি দর দাঁড়াত অন্তত বাইশশো টাকা কুইন্টাল। কিন্তু কেন্দ্রের থেকে তেমন ইঙ্গিত আজও মেলেনি, জানাচ্ছেন রাজ্যের কৃষি ও খাদ্যের কর্তারা। ‘সহায়ক মূল্য বাড়ানোর ঘোষণা চাষির সঙ্গে প্রতারণা,’ বলেন জয় কিসান আন্দোলনের নেতা অভীক সাহা।
বাজেটে আর একটা ঘোষণা, দশ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে জাতীয় ই-বাজারের সঙ্গে গ্রামের বাজারগুলোকে জুড়তে, যাতে চাষি সরাসরি ফসল বিক্রি করতে পারে সেরা দরে, অভাবী বিক্রি করতে না হয়। অথচ এ জন্য কেন্দ্র দিচ্ছে লবডঙ্কা। নাবার্ড ও অন্যান্য আর্থিক সংস্থা ওই টাকা বাজার থেকে তুলে চাষিকে দেবে। অন্তত আগামী বাজেটের আগে টাকা খরচ শুরু হচ্ছে না, বলছেন ব্যাংক কর্তারা।
তবু, চাষিকে বাজার ধরানো যে কত জরুরি, তা তো স্বীকার করল সরকার? তা হলে দেখা যাক, বাংলার চাষি যাতে বাজার ধরতে পারে, তার জন্য গত বছর কী কী হল। দেখলে চক্ষু চড়কগাছ। রাজ্য বাজেট বলছে, কৃষি বিপণনের অধীনে শস্যের ঝাড়াই, সংরক্ষণ, পরিবহণ খাতে রাজস্ব ব্যয় বরাদ্দ ছিল ষাট কোটি টাকা, খরচ হয়েছে সতেরো কোটি। গুদাম, হিমঘর প্রভৃতি স্থায়ী সম্পদ তৈরিতে ১৭০ কোটি টাকা খরচ হওয়ার কথা ছিল, অর্ধেকও খরচ হয়নি। রাজ্য আধিকারিকদের দাবি, এই খাতে কেন্দ্রের মোট বরাদ্দের (১৩৮ কোটি টাকা) অর্ধেকও মেলেনি। ফলে ‘ম্যাচিং গ্রান্ট’ বরাদ্দ করেনি রাজ্য সরকারও। গত বছর কৃষি বিপণনের মোট বাজেট ছিল তিনশো কোটি টাকা, জানুয়ারির শেষ অবধি খরচ হয়েছে একশো কোটি। আর দু’মাস জোর কদমে খরচ হলে তা বড়জোর দ্বিগুণ হবে।
রাজ্য সরকার হাত খুলে খরচ করেছে একটাই বিষয়ে। আলুচাষিদের ভরতুকি। ৭৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ ছিল গত বছর, খরচ হয়েছে ১৯ কোটি।
এ হয়তো প্রায়শ্চিত্ত— ২০১৪-১৫’য় অন্য রাজ্যে আলু পাঠানো রুখে দিয়েছিল তৃণমূল সরকার। সেই যে বাংলার আলু বাজার হারাল, এখন রাজস্বের থেকে কড়ি গুনে পরিবহণে ভরতুকি দিয়ে তার মাশুল গুনতে হচ্ছে। তবু, আলুচাষির উপকার হলে ভাল। কিন্তু ভরতুকি দিয়ে তো রোজগার বাড়বে না। যে-রাজ্য ধানসহ সব ক’টা প্রধান ফসলে হেক্টর-প্রতি উৎপাদনে পিছিয়ে পঞ্জাব গুজরাত বিহারের চেয়ে, যে-রাজ্যে চাষি পরিবারের আয় জাতীয় গড়ের চেয়ে মাসে প্রায় আড়াই হাজার টাকা কম, সে-রাজ্যে চাষির রোজগার না বাড়ালে চলবে কেন?
কৃষি বিপণনে কেন্দ্রের টাকা বরাদ্দ ছিল প্রধানত রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনার অধীনে। টাকা মেলেনি বলে এ-বার প্রায় ৯০ কোটি টাকা কম ধরা হয়েছে কৃষি বিপণনে। কেন্দ্রের কৃষি সচিব শোভন কে পট্টনায়কের বক্তব্য, ‘কৃষির মোট বরাদ্দ তো আর কমেনি। টাকাটা এক খাতে বরাদ্দ না হয়ে থাকলে অন্য খাতে বরাদ্দ হয়েছে।’ এ-রাজ্যে কিন্তু কৃষিতে কেন্দ্রের বরাদ্দ কমেছে। গত বছর রাজ্যের প্রকল্পে কেন্দ্রের সহায়তা বাবদ ৫০০ কোটি টাকা ধরেছিল রাজ্য সরকার। এ-বার ধরা হয়েছে ৩২৩ কোটি। তবে কি রাজ্য খরচ করতে পারেনি বলে কেন্দ্র টাকা কমিয়েছে? ‘কেন্দ্র তা দাবি করতে পারে। ওরা তথ্য দেখাক, আমরাও দেখাব,’ জবাব রাজ্যের কৃষি উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদারের। তাঁর দাবি, কেন্দ্র অনেক দেরিতে অতি সামান্য টাকা দেয়। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই এ-বার কৃষিতে কেন্দ্রের সহায়তা পৌনে দুশো কোটি টাকা কম ধরেছে রাজ্য।
এই দাবি ভিত্তিহীন বলে মনে হয় না। সংশোধিত বাজেটে যখনই কেন্দ্রের অনুদানের উল্লেখ রয়েছে, তার সঙ্গে রাজ্যের ‘ম্যাচিং গ্রান্ট’-এর টাকাও নির্দিষ্ট অনুপাতে দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্র টাকা পাঠিয়েছে, রাজ্য টাকা দেয়নি, এটা তেমন চোখে পড়ছে না। হয়তো কেন্দ্রের প্রত্যাশা, রাজস্বের ভাগ আগের চাইতে অনেক বেশি পাচ্ছে রাজ্য, তাই রাজ্যই বরাদ্দ বাড়াবে। বেশ কথা, কিন্তু তা হলে ‘চাষির বাজেট করেছি’ বলে মোদী সরকার ঢাক পেটাচ্ছে কেন?
এ-বার আর্থিক সমীক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে সেচ। কম জলে বেশি সেচের ব্যবস্থাই নাকি প্রধান চ্যালেঞ্জ। অথচ প্রধানমন্ত্রী কৃষি সেচ যোজনার অধীনে ‘প্রতি ফোঁটায় বেশি ফসল’ প্রকল্পের ৪০০ কোটি টাকা খরচ হয়নি গোটা দেশে। পশ্চিমবঙ্গে ওই প্রকল্পে বরাদ্দ কমেছে। ড্রিপ ইরিগেশন সবচেয়ে কাজে লাগে ফল-সবজির চাষে। এ-বছর তা থেকে কাটা গিয়েছে পনেরো কোটি। কেন্দ্রের ন’কোটি, রাজ্যের ছ’কোটি। খেদের কথা, এর মধ্যে পাঁচ কোটি টাকা আদিবাসীদের জন্য বরাদ্দ ছিল। বিশেষজ্ঞরা সেচের প্রসারকে চাষির আয় বাড়ানোর সবচেয়ে কার্যকর উপায় বলে সুপারিশ করছেন, অথচ বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার মতো শুষ্কতম, দরিদ্রতম এলাকায় সেচের বরাদ্দ কাটা পড়ছে। এ-ভাবেই বাজেট কল্যাণমুখী রাষ্ট্রের মুখটি চিনিয়ে দেয়।
বৃহৎ সেচ প্রকল্পে ভালই খরচ দেখাচ্ছে কেন্দ্রের বাজেট। এ-বছর বরাদ্দও বেড়েছে। কিন্তু নন্দলালের মন্দ কপাল। প্রধানমন্ত্রী কৃষি সেচ যোজনার অধীনে নিরানব্বইটা বড় সেচ প্রকল্পের একটিও এ-রাজ্যে নেই, বলছেন রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে এ-রাজ্যের ঝুলিতে একটাই বৃহৎ পরিকল্পনা, বিশ্ব ব্যাংকের টাকায় দামোদরের ক্যানাল সংস্কার। ২৫০০ কোটির প্রকল্প, গত বছর ধরা হয়েছিল প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। প্রকল্প-সম্ভাবনার মূল্যায়ন এখনও সম্পূর্ণ হয়নি, ঋণও মঞ্জুর হয়নি। বিশেষজ্ঞদের আসা-থাকা আর ফি বাবদ চোদ্দো কোটি টাকা খরচ হয়েছে কেবল। হয়তো আগামী অর্থবর্ষে কাজ শুরু করতে পারবে রাজ্য। যদি হয়, তা হলেও মাথায় রাখতে হবে, এ টাকা কেন্দ্রের অনুদান নয়, ঋণ। শর্ত যতই সহজ হোক, সুদ যতই কম হোক, রাজ্যবাসীকে শোধ দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখনই ঋণের সুদ মেটাতে তার মোট উৎপাদনের প্রায় কুড়ি শতাংশ খরচ করে, যা দেশের মধ্যে সর্বাধিক।
আর, এ টাকা খরচ হলেও সেচের প্রসার হবে আরও বত্রিশ হাজার হেক্টর জমিতে। এ-রাজ্যে বৃষ্টি-নির্ভর চাষ হয় একুশ লক্ষ হেক্টর জমিতে। যাঁরা সেখানে চাষ করেন, তাঁরাই গরিবতম চাষি। সেচ প্রসারের পরিকল্পনা না করলে, সেচে টাকা না বাড়লে, খরচ না হলে, এই চাষিদের রোজগার বাড়বে কী করে?
আরও আশ্চর্য লাগে যখন দেখি ক্যানাল সংস্কার, বাঁধ মেরামতে প্রয়োজনের অতি সামান্য টাকা খরচ হচ্ছে, অথচ বন্যার ক্ষতিপূরণে বছর বছর পঁচিশ-তিরিশ লক্ষ চাষিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে হাজার কোটি-বারোশো কোটি টাকা। ঘাটাল প্রকল্প এ-বছরও শুরু হবে না, চেক বিলি ফের শুরু হওয়া বর্ষার অপেক্ষা। টাকাটা দুর্গত মানুষের কাজে লাগে নিশ্চয়ই। কিন্তু এ যেন গরু মেরে জুতো দান।
প্রশ্নটা আরও অতিকায় হয়ে ওঠে কৃষিবিমার দিকে তাকালে। কেন্দ্র এ-বার কৃষিতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে সাড়ে ছ’হাজার কোটি টাকা, তার মধ্যে ৪০০০ কোটি বেড়েছে একটি মাত্র প্রকল্পে। তা হল প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা। পশ্চিমবঙ্গ বিমার প্রিমিয়াম বাবদ ধরেছে পাঁচশ কোটি টাকা। গত বছর বিমা-খরচ ছিল কৃষিবাজেটের উনিশ শতাংশ, এ-বার তা ২৭ শতাংশ। চার টাকার এক টাকাই যদি ক্ষতিপূরণে যায়, কৃষির সংস্কার হবে কোন টাকায়? যদি-বা চাষিরা সময়মত, যথাযথ ক্ষতিপূরণ পান (চান্স খুব কম), তাতে কতটুকু ভরসা পাবেন গরিব চাষি, যখন দেখবেন যে দলিত, আদিবাসী, মহিলা চাষিদের প্রশিক্ষণ, সেচ, কৃষি বিপনন বাবদ বরাদ্দ টাকা কমছে? তাঁরাও এ-বার কৃষিঋণ পেতে পারেন, জেনে কতটুকু ভরসা পাবেন মৎস্যজীবীরা, যখন রাজ্যের সত্তর লক্ষ চাষির মাত্র সতের লক্ষ কৃষিঋণ পান? এবং মাথাপিছু কৃষিঋণের পরিমাণ যখন জাতীয় গড়ের চাইতে ঢের কম?
তবে বাংলার ঋণ-পিয়াসি চাষির জন্য একটা সুখবর আছে। গত বছরই সমবায়ের জন্য প্রচুর টাকা খরচ করেছে রাজ্য, বরাদ্দের তিনগুণ। এ-বছরও রাজস্ব ব্যয় রাখা হয়েছে ৩০০ কোটি টাকার চাঙ্গায়নী সুধা। ছ’বছর পর হঠাৎ এমন বোধোদয়? সিম্পল। গত বছর দুয়েকে রাজ্যের আশি শতাংশ কৃষি সমবায় এসে গিয়েছে তৃণমূলের হাতে।