আপাতত: কৃষি আইনের বিরুদ্ধে অবরোধ সমাবেশে ভারতীয় কিসান ইউনিয়নের নেতারা। দিল্লির সীমান্তে, ৮ অক্টোবর। ছবি: পিটিআই।
বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যেই বীরপাল কউরের স্বামী ধর্মবীর গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা অদ্ভুত মিল ছিল। দু’জনের বাবা-ই আত্মহত্যা করেছেন। বীরপালের বাবা কিসানচাঁদ বিষ খেয়েছিলেন। ধর্মবীরের বাবা গলায় দড়ি দেন। পঞ্জাবের ভাতিন্ডায় বীরপালের বাবা-স্বামী-শ্বশুরের আত্মহত্যার কারণ একটাই: চাষ করতে গিয়ে মাথায় লক্ষ লক্ষ টাকার দেনার বোঝা।
পঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসেবে, ২০০০ থেকে ২০১৫-র মধ্যে ভাতিন্ডায় ৬,৪৮২ জন কৃষক ও খেতমজুর আত্মহত্যা করেছেন। গত লোকসভা নির্বাচনে বীরপাল ভাতিন্ডা থেকে নির্দল প্রার্থী হন। ‘আত্মঘাতী চাষির বিধবা’-র ঝুলিতে মাত্র ২,০৭৮টি ভোট পড়েছিল। ভাতিন্ডার আত্মঘাতী কৃষকদের পরিবারের সকলেও বীরপালকে ভোট দেননি।
ভাতিন্ডার একটু বিশেষত্ব আছে। শিরোমণি অকালি দলের নেত্রী, বাদল পরিবারের পুত্রবধূ হরসিমরত কউর বাদল ভাতিন্ডা থেকেই জিতে মোদী সরকারের মন্ত্রী হন। তিন কৃষি আইনের বিরোধিতা করে অকালিরা এখন এনডিএ ছেড়েছেন। হরসিমরতও মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: ফের কেন্দ্রের প্রস্তাব ফেরালেন কৃষকরা, আরও বড় আন্দোলনের হুঁশিয়ারি
আরও পড়ুন: কে বলেছে ধনী কৃষকদের আন্দোলন? গরিবরাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত: সাক্ষাৎকারে কৃষক নেতা রাকেশ
শরিকদের সঙ্গত্যাগ। পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের চাষিদের দিল্লিতে ঢোকার জাতীয় সড়ক অবরোধ। চাপের মুখে কৃষকদের সঙ্গে মন্ত্রীদের বৈঠকের পর বৈঠক। দেখেশুনে বিরোধী শিবির উল্লসিত। দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ এখনও চাষবাসের উপর নির্ভরশীল। মোদী সরকার তাঁদের চটিয়ে ফেলেছে, ভোটবাক্সে নিশ্চয়ই ধাক্কা লাগবে।
লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে, ২০১৮-র শেষ বেলাতেও বিরোধী শিবির আশাবাদী ছিল। ফসলের ন্যায্য দাম ও ঋণ মকুবের দাবিতে গোটা দেশের কৃষকরা আন্দোলনে নেমেছিলেন। দিল্লির সংসদ মার্গে কৃষক নেতারা স্লোগান তুলেছিলেন: মন্দির নয়, রুটি চাই। কৃষকদের মঞ্চে জড়ো হয়েছিলেন রাহুল গাঁধী, অরবিন্দ কেজরীবাল, তামাম দলের নেতা। লোকসভা ভোটের ফলে অবশ্য কৃষকদের ক্ষোভের বিন্দুবিসর্গও চোখে পড়েনি। ২০১৪’র থেকেও বেশি আসনে জিতে গদিতে ফেরেন নরেন্দ্র মোদী। এমন নয় যে তিনি কৃষকদের দাবি মেনে ঋণ মকুব করেছিলেন। ফসলের দামের দাবিও পূর্ণ হয়নি। কিন্তু কৃষকদের ক্ষোভ ভোটের সময় যেন উবে গিয়েছিল।
এখানেই প্রশ্ন, কৃষকরা কি আদৌ এককাট্টা হয়ে ভোট দেন? না কি ভোটযন্ত্রে বোতাম টেপার সময় অন্য পরিচিতি বড় হয়ে ওঠে? ধনী কৃষক? গরিব চাষি? খেতমজুর? ভাগচাষি? হিন্দু? মুসলিম? শিখ? উচ্চবর্ণ? ওবিসি? দলিত? কৃষকদের অভাব-অভিযোগ কি জাতীয় রাজনীতিতে ভোটের বিষয় হয়? না কি, হিন্দুত্ব-দেশপ্রেম-উগ্র জাতীয়তাবাদ বা স্থানীয় সমস্যার নীচে তা ধামাচাপা পড়ে যায়?
নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের নিন্দুকেরা বলতেই পারেন, তাঁরা অম্বানী-আদানির স্বার্থে কৃষি আইন করেছেন। চাষিদের ক্ষতি তাঁরা বুঝতে পারছেন না। কিন্তু মোদী-শাহ জুটি রাজনৈতিক খেসারতের হিসেব কষেননি বা তাঁরা ভোটের অঙ্ক কষতে জানেন না, এ তাঁদের ঘোর নিন্দুকরাও বলবেন না। তা হলে কি কৃষকদের আন্দোলন ভোটে ছাপ ফেলে না বলেই মোদী-শাহ কৃষি আইন নিয়ে অনড়? দিল্লি ঘেরাওয়ে তাঁরা তেমন বিচলিত নন?
দিল্লির সীমানায় জড়ো হওয়া কৃষক নেতাদের সামনে বহু বার প্রশ্ন উঠেছে: চাষিদের ক্ষোভ আগামী নির্বাচনে ছাপ ফেলবে কি? বিজেপি কি প্রবল ধাক্কা খাবে? কেউই নিশ্চিত ভাবে সেটা বলতে পারেননি। এই বিক্ষোভের মধ্যেই দিল্লির পাশে রাজস্থানে পঞ্চায়েত নির্বাচনে দারুণ ফল করেছে বিজেপি।
সরকারি হিসেবে, দেশে কৃষক পরিবার প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি। অর্থাৎ, ১৩০ কোটির দেশে চাষি পরিবারের ভোটারের সংখ্যা কিছু না হলেও ৪০ কোটি। খেতমজুর, ভাগচাষি যোগ করলে সংখ্যাটা আরও বেশি। এই ভোটব্যাঙ্ক এককাট্টা হলে যে কোনও নির্বাচনের দিশা বদলে দেবে। কোনও দিনই তা হয়নি। মণ্ডল বনাম কমণ্ডলুর হাত ধরে ধর্ম ও জাতপাতের প্রকাশ্য রাজনীতি শুরুর আগে হয়তো কৃষকদের একটা ‘সামাজিক রাজনৈতিক নির্বাচকমণ্ডলী’ বলা যেত। কিন্তু তার মধ্যেও ধনী-গরিব চাষি, জমির মালিক, ভূমিহীন কৃষক, খেতমজুরের শ্রেণিভেদ ছিল। ভূমিহার, জাঠ, মরাঠা, যাদব, পটেলরা চাষি হলেও জমির মালিক ছিলেন। তাঁরা সরকারি খাতায় অনগ্রসর, কিন্তু দলিত, ভূমিহীন, খেতমজুরদের উপর ছড়ি ঘোরাতে পিছপা হননি। মণ্ডল কমিশনের সংরক্ষণের হাত ধরে এই দলিত ভূমিহীনদের ক্ষমতায়নের পরে কৃষক ভোটব্যাঙ্কে এই বিভাজন আরও প্রকট হয়। এটা সকলেরই জানা যে, পঞ্জাব, হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের চাষিরা সবুজ বিপ্লবে বেশি লাভবান হন। পরে এখান থেকেই চরণ সিংহ, দেবী লাল থেকে মহেন্দ্র সিংহ টিকায়েত, শরদ অনন্তরাও জোশীর মতো কৃষক নেতাদের উত্থান। তাঁদের উত্তরসূরিরা জাতপাতের রাজনীতিতে গা ভাসান। এখন পঞ্জাব-হরিয়ানার কৃষক নেতারাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁদের ভোটব্যাঙ্ক আছে কি?
ধরা যাক, গুরনাম সিংহ চাদুনি-র কথা। ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন (হরিয়ানা)-এর সভাপতির নেতৃত্বে কয়েক হাজার কৃষক সড়কে রাত কাটাচ্ছেন। গত বছর হরিয়ানার বিধানসভা ভোটে লড়ে গুরনাম সাকুল্যে ১,৩০৭ ভোট পেয়েছিলেন। ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাতের বিধানসভা ভোটে কৃষকদের ক্ষোভ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেও লোকসভা ভোটে তা প্রাধান্য পায়নি। ২০১৭-য় নাশিক থেকে মুম্বই কৃষকদের ‘লং মার্চ’-এ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সিপিএমের বিধায়ক জে পি গাভিট। নাশিকেরই দিন্দোরি থেকে তিনি লোকসভা ভোটে লড়েন। দশ শতাংশ ভোটও মেলেনি। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের বিজেপি গরিবদের সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নীতি, জাতপাতের সমীকরণ, উগ্র জাতীয়তাবাদ, হিন্দুত্বের মিশেলের জোরে ক্ষমতায় আসে।
পঞ্জাবে ২০২২-এ ভোট। যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশেও। পঞ্জাব বিধানসভায় বিজেপির মাত্র তিনটি আসন। অকালি দল সঙ্গ ত্যাগ করেছে। এমনিতেই বিজেপির পঞ্জাবে ভাল কিছুর আশা নেই। আর উত্তরপ্রদেশ? যোগী আসার পরে গোরক্ষক বাহিনীর দাপটে চাষিদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল। হাড়-জিরজিরে গরু-বলদ লাঙল টানতে না পারলেও হাটে বেচার উপায় নেই। খাওয়াতে না পেরে গরু রাস্তায় ছেড়ে দিলে জমির ফসল নষ্ট করে। কিন্তু লোকসভা ভোটে সকলে বিজেপিকেই ঢেলে ভোট দেন। ২০২২-এও উত্তরপ্রদেশের চাষিরা হিন্দু-মুসলমান, দলিত-যাদব, ঠাকুর-ব্রাহ্মণ, এমন বিভিন্ন পরিচিতিতে বিভাজিত হয়ে যাবেন।
কৃষক নেতাদের আফসোস, এককাট্টা হয়ে ভোট দেন না বলেই চাষিদের দাবি নিয়ে কোনও সরকার মাথা ঘামায় না। স্বামীনাথন কমিশন ২০০৭-এ চাষের খরচের দেড় গুণ ফসলের দাম দিতে বলে। মনমোহন সিংহের আমলে তা নিয়ে বিশেষ কথাই হয়নি। ২০১৪ ভোটের আগে মোদী বলেন, ক্ষমতায় এলে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ রূপায়ণ করা হবে। ঘোষণা হয়, ২০১৮ ফেব্রুয়ারিতে। যদিও কৃষক সংগঠনের অভিযোগ, সরকার চাষের সব খরচ ধরেনি। এই ক্ষোভের মুখে মোদী সরকার পিএম-কিসান প্রকল্প ঘোষণা করে। কিন্তু লোকসভা ভোটের আগে শুধু ছোট-মাঝারি চাষিদের বছরে ৬ হাজার টাকা দেওয়া হয়। সেই ধনী-গরিবের বিভাজন।
নোট বাতিলের পরে মোদী সরকার বুঝিয়েছিল, বড়লোক, কালো টাকার মালিকরা সমস্যায় পড়বেন। গরিব মানুষের ভোগান্তি হলেও বড়লোকরা বেকায়দায় পড়ছেন ভেবে অনেকেই খুশি মনে তা মেনে নিয়েছিলেন। এ বার কৃষি আইনের পক্ষেও কেন্দ্রের মন্ত্রীরা বলছেন, গরিব চাষির লাভ হবে। পঞ্জাব-হরিয়ানার বড়লোক চাষি ও ফড়েরা আন্দোলনে নেমেছেন। এই জমিদার চাষিদের কাছেই ছোট চাষিরা দেনার দায়ে জমি বিক্রি করেন। সরকার সিংহভাগ চাল-গম বড় চাষিদের থেকেই এমএসপি-তে কেনে। তাই এমএসপি নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা। বাকিরা তো এমএসপি পানই না। তাই তাঁরা প্রতিবাদও করছেন না।
পবন যাদবের কথা মনে পড়ে। গত বছর অর্থনীতির ঝিমুনি ও গাড়ি শিল্পের মন্দার জেরে যখন গাড়ি ও তার যন্ত্রাংশের কারখানায় হাজার মানুষ কাজ হারাচ্ছেন, তখন গুরুগ্রামে এক কারখানায় পবনের সঙ্গে আলাপ। বাম ঘেঁষা ট্রেড ইউনিয়নের নেতা। পারিবারিক চাষের জমি রয়েছে। ফসলের ঠিকমতো দাম মেলে না। কারখানাতেও ওভারটাইম বন্ধ। তার ক’দিন পরে হরিয়ানার ভোট নিয়ে প্রশ্নে পবন বলেছিলেন, ‘লোকসভায় ভোটটা মোদীজিকে দিয়েছিলাম। আবার বিজেপি-কেই ভোট দেব। বালাকোটে পাকিস্তানের ঘরে ঢুকে কেমন মেরে এসেছিলেন, বলুন তো! এ বার কাশ্মীরে ৩৭০ তুলে দিয়ে সবাইকে সিধে করে দিয়েছেন!’
কৃষক নন। শ্রমিক নন। ভোটের সময় কৃষক-শ্রমিকদের এই অন্য সত্তাই শাসকের স্বস্তির কারণ।