Farmers Protest

উত্তরণের সম্ভাবনা

সমকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে এই প্রতিস্পর্ধী সমন্বয় কেবল সমাদরণীয় নহে, অপরিহার্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০২০ ০২:০০
Share:

ছবি পিটিআই।

কৃষক আন্দোলন বিরোধী রাজনৈতিক ঐক্যের অনুঘটক হইয়া উঠিবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভে। তবে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে সংগঠিত বিক্ষোভ নিঃসন্দেহে শাসকের প্রতিস্পর্ধী রাজনীতিকে একটি মঞ্চ সরবরাহ করিয়াছে। মঞ্চটি জোরদার এবং সম্ভাবনাময়। প্রস্তাবিত ভারত বন্‌ধ উপলক্ষে সেই সম্ভাবনার একটি প্রত্যক্ষ রূপ ইতিমধ্যেই উন্মোচিত— বিভিন্ন বিরোধী দলের সমর্থনে বন্‌ধের পরিধি বিস্তৃত হইতে চলিয়াছে। বন্‌ধ নামক জনস্বার্থহানিকর আচারটির উপাসকরা তাহাতে আহ্লাদিত হইবেন। কিন্তু এই সমর্থনের রাজনৈতিক তাৎপর্য গভীরতর। লক্ষণীয়, কৃষকদের সপক্ষে সমবেত বিরোধী দলগুলির নানা বিষয়ে মতানৈক্য আছে, স্বার্থের বিভিন্নতা আছে, এমনকি বৈপরীত্যও। কিন্তু তাহাতে এই বিশেষ প্রশ্নটিতে সমস্বর হইতে তাহাদের বাধে নাই। অন্য দিকে, আন্দোলনকারী কৃষকরা জানাইয়া দিয়াছেন, বিরোধীরা স্বাগত, কিন্তু রাজনৈতিক পতাকা লইয়া যেন তাঁহারা না আসেন। তাঁহাদের দিক হইতে এই অবস্থান গ্রহণের কারণ সহজবোধ্য, তবে এই ‘শর্ত’ বিরোধী দলগুলির পক্ষেও এক অর্থে সুবিধাজনক, কারণ দলীয় পরিচয়ের অভিজ্ঞানটি আড়ালে থাকিলে নিজেদের বিভেদ সরাইয়া রাখিয়া ‘বিষয়-ভিত্তিক’ ঐক্য ঘোষণা ও অনুশীলন করা অনেক সহজ হয়। এবং, এই অনুশীলন বিরোধী রাজনীতির প্রসারে এক গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনাও সৃষ্টি করে— গণতন্ত্রের সম্ভাবনা, যে গণতন্ত্র বহু স্বার্থ এবং বহু স্বরকে সম্মান জানাইয়াই তাহাদের মধ্যে প্রতিস্পর্ধী সমন্বয় সাধন করিতে পারে।

Advertisement

সমকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে এই প্রতিস্পর্ধী সমন্বয় কেবল সমাদরণীয় নহে, অপরিহার্য। নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি যে শাসনধারা প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, নিরঙ্কুশ একাধিপত্যই তাহার ধর্ম। এক দেশ, এক দল, এক নায়ক— ইহাই সেই ধর্মের অদ্বিতীয় মন্ত্র। শরিক বা মিত্রদের পক্ষেও এই একতন্ত্র ক্রমে অসহনীয় হইয়া উঠিতেছে, কৃষি আইন উপলক্ষে তাহা এখন স্পষ্ট। আবার, শাসক দলের মধ্যেও ভিন্নস্বরের কোনও স্থান নাই, অষ্টপ্রহর ভক্তমণ্ডলীর বৃন্দগান চলিতেছে এবং চলিবে। এই তন্ত্র যে কোনও প্রতিবাদকে রাষ্ট্রদ্রোহ আখ্যা দিয়া দমন করিতে বদ্ধপরিকর, বিনা আলোচনায় আইন জারি করিতে ব্যগ্র। সংসদে কৃষি বিল যে ভাবে পাশ করানো হইয়াছে, তাহা এই মানসিকতার একটি দৃষ্টান্ত। আইন প্রত্যাহারের দাবিতে কৃষকদের অনমনীয় অবস্থানটি এই অসহিষ্ণু আধিপত্যবাদেরই প্রতিক্রিয়া। প্রধানমন্ত্রী এই উপলক্ষে নিউটনের তৃতীয় সূত্র স্মরণ করিতে পারেন। এমন নাছোড় বিরোধিতার অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার পরে তিনি এবং তাঁহার সহযোগীরা গণতান্ত্রিক আলোচনার নূতন ধর্ম অভ্যাস করিতে চাহিবেন, তেমন ভরসা কম। শাসকের সর্বগ্রাসী আধিপত্য হইতে গণতান্ত্রিক পরিসরটিকে রক্ষা করিবার প্রধান দায় বিরোধীদেরই।

সেই পরিপ্রেক্ষিতেই বিরোধী রাজনীতির সমন্বয় অপরিহার্য। বিভিন্ন সরকারি নীতি ও সিদ্ধান্ত বিভিন্ন গোষ্ঠী বা বর্গের উপর আধিপত্য জারি করিতে চাহিতেছে, অন্যদের হয়তো সেই বিশেষ নীতি বা সিদ্ধান্তে সরাসরি কোনও ক্ষতি নাই। কিন্তু যাহার ক্ষতি, কেবল সে-ই প্রতিবাদ করিবে, এই মানসিকতা অনুসরণ করিয়া চলিলে গণতান্ত্রিক প্রতিস্পর্ধার পরিসরটিই বিনষ্ট হইতে বাধ্য। মোদী-শাসিত ভারতে সেই পরিসর অনেকাংশে সঙ্কুচিত হইয়াছে। তাহার পিছনে বিরোধীদের ক্ষুদ্রস্বার্থ-কেন্দ্রিক আচরণের দায় কম নহে। কৃষক আন্দোলন সেই ধারায় পরিবর্তনের সূচনা করিয়াছে। বিরোধী শিবিরের একটি বড় অংশ নিছক গোষ্ঠীস্বার্থের বলয়ে সীমিত না থাকিয়া শাসকের অসহিষ্ণু দাপটের বিরুদ্ধে সরব ও সক্রিয় হওয়ার দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হইয়াছে। এই পরিবর্তন বিরোধী রাজনীতির উত্তরণে পরিণত হয় কি না, তাহার উপরে গণতান্ত্রিক ভারতের ভবিষ্যৎ বহুলাংশে নির্ভর করিতেছে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement