প্রতীকী চিত্র।
এমন নয় যে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকের জন্যে গত ছ’বছরে কিছুই করেনি। ২০১৫ সালে কৃষি মন্ত্রকের নাম বদলে রাখা হয়েছে কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রক। কৃষকের কল্যাণের প্রশ্নটি সরকার যে আলাদা করে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে, এ থেকেই প্রমাণ হয় না কি? পরের বছরের গোড়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানালেন, ২০২২ সালে প্রত্যেক কৃষকের আয় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। সে বছর স্বাধীনতার ৭৫ বছর। তার সঙ্গে কৃষকের আয় দ্বিগুণ হওয়ার সম্পর্কটি অবশ্য খোলসা হয়নি। তড়িঘড়ি সংসদে পাশ হওয়া সাম্প্রতিক কৃষি বিল হয়তো সেই লক্ষ্য মাথায় রেখেই।
প্রধানমন্ত্রীর কথাকে মান্যতা দিয়ে কৃষকরা অন্তত আর দু’বছর অপেক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে বিলের বিরোধিতায় নেমে পড়লেন। দলে দলে কৃষকের রাস্তায় নেমে পড়া দেখে বিরোধীরা উদ্বুদ্ধ হলেন। অনেক দিন পর সংবাদে জায়গা করে নিলেন কৃষকরা। এ নিয়ে এই ক’দিনে লেখালিখি কম হয়নি। কৃষকদের বিল বিরোধিতার কারণটিও সেখান থেকে মোটামুটি জানা গিয়েছে। অথচ আশ্চর্যের কথা, একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, এই বিলের ফলে দেশের বৃহত্তর অংশের কৃষকদের অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হওয়ার কারণ নেই। তাই পঞ্জাব বা হরিয়ানা এ-বাবদে যতটা উত্তপ্ত হয়েছে, অন্য রাজ্য ততটা হচ্ছে না। কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিরোধীরা যদি দেশজুড়ে আন্দোলন সংগঠিত করতে পারেন, সে তাঁদের কৃতিত্ব। রাজনীতি ক্বচিৎ আর্থনীতিক লাভক্ষতির চুলচেরা হিসেবের পথে হাঁটে। আর এই কৃষি বিলের পরিণতিতে সম্ভাব্য লাভক্ষতির হিসেবটা যেহেতু সোজাসাপ্টা নয়, দুই বিপরীতমুখী দূরকল্পনায় আশ্রয় করেই রাজনীতি চলবে কিছু কাল।
বিশ্লেষকরা যা বলেছেন, তার মূল প্রতিপাদ্যটি হল, এই বিল বড় বড় কোম্পানির কৃষিপণ্যের বাজারে ঢুকে পড়ার অবাধ ছাড়পত্র দিচ্ছে। ফলে এপিএমসি বা ‘কিষান মান্ডি’র গুরুত্ব কমে যাবে। বর্তমানে রাজ্যে রাজ্যে সরকার-নিয়ন্ত্রিত এই মান্ডিগুলিতে কৃষকরা ফসল বিক্রি করে ন্যায্য দাম পাচ্ছিলেন। অবশ্য সবাই নয়, কারণ দূরত্ব ও অন্যান্য বাধা পেরিয়ে অনেকেই সেখানে পৌঁছতে পারেন না। তবে পঞ্জাব হরিয়ানার দাপুটে কৃষকরা যে পাচ্ছিলেন, তা সংশয়াতীত। মান্ডিতে নিলামের মাধ্যমে যে দামে কৃষকরা ফসল বেচেন, তা সরকার নির্ধারিত ‘ন্যূনতম সহায়ক মূল্য’র (সংক্ষেপে এমএসপি) থেকে কম হয় না। বড় কোম্পানি ঢুকে পড়লে মান্ডিগুলি অসম প্রতিযোগিতায় হেরে যাবে। আর মান্ডি না থাকলে সহায়ক মূল্যও থাকবে না, কৃষকরা কোম্পানির নির্ধারিত দামেই বিক্রি করতে বাধ্য হবেন।
সরকার দাবি করছে, নতুন আইনের পরেও মান্ডি যেমন ছিল থাকবে, এমনকি এমএসপি-ও থাকবে; পাশাপাশি অন্য পাইকারি ক্রেতারা যদি স্থানীয় কৃষিপণ্যের বাজারে ঢোকেন, তবে কৃষকের পছন্দের স্বাধীনতা বাড়বে— মান্ডিতে সুবিধা না হলে হাত বাড়ালেই চলে আসবে বড় কোনও কোম্পানি বা তার এজেন্ট। কোথাও কোম্পানির সংগ্রহস্থল বা গুদাম, আবার কোথাও প্রক্রিয়াকরণ-সংস্থা কিনে নেবে ফসল। কৃষকদের লাভ বই লোকসান নেই। কৃষকরা অবশ্য এ যুক্তি একেবারেই মানছেন না। তাঁরা ‘স্বাধীনতাহীনতা’তেই যেন বাঁচতে চান।
দু’পক্ষের যুক্তির মধ্যেই অনেক ‘যদি’ আর ‘কিন্তু’ ঢুকে আছে। তবে সব ছাপিয়ে যা উঠে আসে, তা হল আস্থাহীনতা। এমএসপি কিংবা মান্ডি থাকছে না, এমন কথা বিলের কোথাও বলা নেই, তবু কৃষকরা মনে করছেন সরকার কৃষিতে সব রকম সহায়তা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বড় বড় কোম্পানিকেও এঁরা দেখছেন অবিশ্বাসের চোখে। এমনকি টেলিকম ক্ষেত্রে ‘জিয়ো’র উত্থানের সঙ্গে বিএসএনএলের পতনের সম্পর্কের অনুষঙ্গ টেনে বলা হচ্ছে, এ রকমই ভবিতব্য।
অর্থাৎ, আপত্তির মূল উৎস অসরকারি ক্রেতার অবাধ অনুপ্রবেশে নয়, তাদের সর্বশক্তিমান একচেটিয়া হয়ে ওঠার সম্ভাবনায়। বাজারের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতে একচেটিয়া ও প্রতিযোগিতামূলক বাজারের এই মৌলিক পার্থক্যটি সাধারণত ঝাপসা হয়ে যায়। বাম বা দক্ষিণ, কোনও অর্থনীতির তত্ত্বেই নিয়ন্ত্রণহীন একচেটিয়া বাজার সমর্থনের কোনও অবকাশ নেই। সরকার মনে করছে কৃষিপণ্যের বাজার মুক্ত হলে কৃষকেরই স্বাধীনতা বাড়বে, কারণ বর্তমান এপিএমসি ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দখলদারি আছে যথেষ্ট। এ কথা ভুল নয়, কিন্তু সব রাজ্যে এপিএমসির দাপট সমান নয়, বা সমান কৃষকস্বার্থ বিরোধীও নয়। বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব এক এক রকম। গমের ক্ষেত্রে যেমন ৪২ শতাংশ কেনাবেচা হয় মান্ডিতে, ধানের ক্ষেত্রে মাত্র ১৮ শতাংশ। আর এখান থেকে পঞ্জাব হরিয়ানার সঙ্গে ধান-উৎপাদক রাজ্যগুলির বাস্তবতার তফাতটাও আন্দাজ করা যায়।
বর্তমান ব্যবস্থাটির যে সংস্কার প্রয়োজন, তাও কেউ অস্বীকার করবেন না। কিন্তু বাজারমুখী সংস্কার যে কাউকে একচেটিয়া সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার জন্যে নয়, এ ব্যাপারটাই আমরা ভুলতে বসেছি, কারণ বাস্তব যে বার বার এর উল্টোটাই দেখাচ্ছে। একের পর এক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট দু’টি ব্যবসা গোষ্ঠী যে ভাবে তাদের একচেটিয়া ক্ষমতা বাড়িয়ে নিচ্ছে, তা দেখে তথাকথিত বাজারমুখী নীতিতে আর ভরসা রাখতে পারছেন না কেউ। তত্ত্ব বলে, একচেটিয়া কারবারে অর্থনীতির ভাল হতে পারে না। তাই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থাকতেই হবে। একচেটিয়া কারবার প্রমাণ হলে বিল গেটসকেও কোটি কোটি ডলার ফাইন দিতে হয়েছে। আমাদের দেশেও আছে ‘প্রতিযোগিতা কমিশন’, যার এ বিষয়টি দেখার কথা।
সরকার কৃষি বিল নিয়ে জবরদস্তি করার আগে আর একটু হোমওয়ার্ক করে নিলেই বুঝতে পারত রাজ্যে রাজ্যে অবস্থা এক রকম নয়। কোনও রাজ্যের মান্ডিতে কেনাবেচা বাধ্যতামূলক, আবার কোথাও তা নয়। রাজ্যে রাজ্যে যে আইনবলে একে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, তাকে সংক্ষেপে বলা হয় ‘এপিএমসি আইন’। কেরলে তো তার অস্তিত্বই নেই। পশ্চিমবঙ্গে এই আইন হয় ১৯৭২ সালে। ২০১৪ সালের সংশোধনের পর এখন সে আইন যেখানে দাঁড়িয়েছে, সেখানে সরকারি ‘বিপণন অঙ্গন’গুলির সঙ্গে অসরকারি অঙ্গনগুলিও কেনাবেচা সংগঠনের কাজ করতে পারে আইন মেনেই। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কৃষিজ বিপণন পর্ষদের অধীনে বর্তমানে ৫১৫টি বিপণন অঙ্গন রয়েছে রাজ্য জুড়ে। আইনে বাধা না থাকলেও কর্পোরেট হাঙররা রাজ্যের কৃষকদের ঘাড় মটকাচ্ছে, এমন খবর পাইনি। কিন্তু কৃষকরা সব সময়ে ‘ন্যায্য’ দাম পান না, তা-ও সত্যি। তাই বিপণন অঙ্গনের সংখ্যা বাড়িয়ে চলাই পশ্চিমবঙ্গের নীতি হওয়া উচিত, এবং কৃষিজ বিপণন পর্ষদ এ কাজটি ধারাবাহিক ভাবে করেও চলেছে।
অবাক হতে হয়, এই ‘কৃষক’ বর্গটি কেমন অবলীলায় প্রশ্নাতীত ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষির রাজনৈতিক অর্থনীতি বিষয়ে যাঁরা একটু খোঁজখবর রাখেন, তাঁদের কাছেই এই ব্যবহার অসঙ্গত মনে হবে। কৃষক বর্গটি যে একেবারেই সমসত্ত্ব নয়, এ কথা যে কেউ মানবেন। বিহারের যে প্রান্তিক কৃষক কখনও মান্ডির ধার মাড়াননি, সামান্য যেটুকু ফসল ওঠে তা খেত থেকেই নিয়ে চলে যান কোনও ‘এগ্রিগেটর’, সেই প্রান্তিক কৃষকের সঙ্গে পঁচিশ একর জমির মালিক ট্র্যাক্টরবাহী গমচাষির স্বার্থ এক হতেই পারে না। গত কয়েক দশকের মধ্যে মূলত অবস্থাপন্ন কৃষকদের জোরালো আন্দোলন অনেক বারই হয়েছে। মহারাষ্ট্রে শরদ জোশী, উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে মহেন্দ্র সিংহ টিকায়তের নেতৃত্বে এই আন্দোলনগুলিকে তখন নতুন ধরনের কৃষক আন্দোলন হিসেবেই দেখা হত, কারণ সেগুলি শুরু হয়েছিল দলীয় সাংগঠনিক রাজনীতির বাইরে। কৃষকদের এই শ্রেণিটি তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি সংগঠিত। এঁদের আন্দোলনের সাফল্যের সঙ্গে সব শ্রেণির কৃষিজীবী পরিবারের ভালমন্দের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক সামান্যই। এই বাস্তবতাটুকু মাথায় রাখলে কৃষকদের এই আন্দোলনে গ্রামীণ ভারতের অধিকাংশ মানুষ কী ভাবে শামিল হবেন, এবং আন্দোলন সঙ্ঘবদ্ধ রূপ পাবে কি পাবে না, তা নিয়ে ভাবা শুরু করা যায়।
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ, কলকাতা