বইয়ের জায়গা দখল করে নিচ্ছে অ্যাপ্লিকেশন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় সব। পাল্টে যাওয়ার সঙ্গেই বলা যেতে পারে এগিয়ে যাওয়া। এই যেমন মানুষের চাঁদে পা রাখা। সেও অনেককাল আগে। এই যেমন বাক্সের মধ্যে পৃথিবীকে বন্দি করা। সেটাও দেখতে দেখতে যেন অনেক কাল চলে গিয়েছে। ‘মহীনের ঘোড়া’র গানেই ছিল— ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে/ স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে/ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দি’। আর এখন তো গোটা পৃথিবী বন্দি মুঠোফোনে।
ভূতের রাজার বর
সারা পৃথিবী এখন যেন আমাদের হাতের মুঠোয় বন্দি। যখন যেখানে চোখ বোলাতে ইচ্ছে করছে, করে নিচ্ছি। কখনও ঘুরে আসছি নিউইয়র্ক তো কখনও আফ্রিকার জঙ্গল। আদিম আদিবাসীদের সঙ্গেও সময় কেটে যাচ্ছে মুঠোফোনে। আবার কখনও অবগাহন মুকবুল ফিদা হুসেনের ছবিতে বা সুকুমার রায়ের ছড়ায়। সব যেন এক নিমেষেই হাজির। অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ যেন! সেই ভুতের রাজার বর পাওয়ার মতো! হাতে হাতে তালি দিতেই দেশবিদেশ যাত্রা!
ফেলে আসা দিন
হাতে তালি দিতে দিতেই আমরা আমাদের পছন্দের গ্রন্থেও ডুবে যেতে পারি। একটা সময় ছিল, আজ থেকে খুব বেশিদিনও নয়, তিন দশক বা চার দশক পিছনে ফিরে গেলেই জানা যায়, উত্তরবঙ্গে একটি বইয়ের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করে বসে থাকতে হত। প্রথমে দোকানে গিয়ে বইয়ের নাম জমা দেওয়া। তার পরে কলকাতা থেকে বাসে বা ট্রেনে চেপে কবে সেই বই পৌঁছবে, তার জন্য অধীর অপেক্ষা। তার পরেও প্রয়োজনীয় বই পাওয়া না যাওয়ার মতোও উদাহরণ রয়েছে। শুধু সাহিত্যের সম্ভারই নয়, পাঠ্যবইয়ের জন্যও অপেক্ষা করতে হত। কেউ কেউ অন্য কারও বই থেকে ফোটোকপি করে নিতেন নিজের প্রয়োজনীয় পাতা। কিন্তু সে সব এখন অতীত। এখন কড়ি ফেললেই বই হাজির। দোকানেও পৌঁছতে হয় না। মোবাইল ফোনেই পড়ে নেওয়া যেতে পারে নিজের পছন্দের বই। একটি-দু’টি নয়, অগুন্তি বই পড়ার জন্য অ্যাপস নেমেছে বহু। ডাউনলোড করে সেই অ্যাপস নিজেদের মোবাইলে বন্দি করে রাখলেই বইয়ের জগৎ হাতের মুঠোয়! সেখান থেকেই পড়ে নেওয়া যেতে পারে পাতার পর পাতা। ক্রমশ উত্তরের প্রত্যন্ত জনপদেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সেই সব অ্যাপস।
সব আছে অ্যাপসে
কিন্তু কেন বই পড়া ছেড়ে মানুষ অ্যাপসের দিকে ঝুঁকছেন? বইয়ের মতো সেই সুবাস কি আর অ্যাপস বা মোবাইলে আছে? হয়তো নেই। হয়তো নয়, হলফ করেই বলা যেতে পারে, নেই। কিন্তু এই সময়ের মানুষের কাছে এই পড়াটা অনেক সহজ। সময় এগিয়ে চলছে। দিনে দিনে মানুষের গতিও বাড়ছে। মুম্বই বা কলকাতার মতো মেট্রোপলিটন শহরে সেই গতির যাত্রা শুরু হয়েছিল বহু আগেই। যা এখন উত্তরবঙ্গের মফস্সল শহরেও পা রেখেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই মানুষের ব্যস্ততা শুরু। যেন দম নেওয়ার ফুরসৎ নেই। সংসার–অফিস সামলে সবাই ক্লান্ত। রাতে বাড়ি ফিরে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে নিদ্রা যাওয়া ছাড়া আর তাঁদের কিছুই করার থাকে না। বই পড়ার সময় কোথায়? সেই সঙ্গেই স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও অনেক সময়েই নিজেদের পছন্দের বই সংগ্রহ করে উঠতে পারেন না। তাই হাতের কাছে রাখা মোবাইল ঘেঁটে নিজেদের পছন্দের সেই বিষয় একবারেই পেয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। তাই বই পড়ার অ্যাপস এখন অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ। চাকুরিজীবী লোকজনের পক্ষেও সবসময় বই কেনা এবং ব্যাগে রাখা সম্ভব হয় না এখন আর। মোবাইল ফোনে অ্যাপস ডাউনলোড করে সহজেই তাঁরা যে কোনও বিষয় পড়তে পারছেন। এ ছাড়া ফোনের মাধ্যমে আরও নানা কাজও করতে পাচ্ছেন তাঁরা। তাই বইয়ের বদলে অ্যাপসই তাঁদের কাছে এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
সেলফোন-শ্রেণিকক্ষ
এখানেই শেষ নয়, এখন সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ অ্যাপসের মাধ্যমেই ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের হাতে তুলে দিচ্ছে পড়াশোনার বিষয়। প্রতিদিন কোন ক্লাসে কী পড়াশোনা হল, তা জানা যাচ্ছে অ্যাপস থেকেই। ছাত্রছাত্রীদের প্রত্যেককে পাসওয়ার্ড দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সময়মতো সেই অ্যাপস খুললেই ক্লাসে কী পড়াশোনা হল, তা জেনে যাচ্ছেন অভিভাবকেরাও। কেউ স্কুলে একদিন না যেতে পারলে সেখান থেকেই ‘আপডেট’ করে নিতে পারছে নিজেদের। স্কুলগুলিও মনে করছে, ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের এগিয়ে যেতে এখন অ্যাপস খুবই সহায়ক। এ ছাড়া ওই অ্যাপ্লিকেশন থেকে গতানুগতিক পড়ার বাইরেও অনেক কিছু জানা যায়।
টলস্টয় থেকে হকিং
অ্যাপস নানা ধরনের। নানা ধরনের অ্যাপ্লিকেশন। মহাকাশ ও বিজ্ঞান জানার জন্য যেমন নির্দিষ্ট অ্যাপস রয়েছে, তেমনই গণিত, ভাষার দক্ষতা নিয়েও রয়েছে অ্যাপস। রয়েছে নানান সার্চ ইঞ্জিন। ভুগোল, মানচিত্র থেকে শুরু করে গান-গিটার-তবলা শেখার জন্যও অ্যাপস রয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার পরিকল্পনা করা থেকে নোট নেওয়ার জন্যও নির্দিষ্ট অ্যাপস রয়েছে। মাউসে হাত দিলেই হাত ধরছেন টলস্টয় থেকে স্টিফেন হকিং। সাহিত্যের সুবিশাল সম্ভার এখন অ্যাপস-বন্দি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উত্তরবঙ্গও এখন অনেকাংশেই সেলফোনের অ্যাপস-নির্ভর। নতুন বইয়ের গন্ধ হয়তো ক্রমে দূরতম দ্বীপ হয়েই যাচ্ছে। কিন্তু সময়ের দাবিকে অস্বীকার করে, কার সাধ্য!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)