২০১৯ সাল জুড়ে নেটিজ়েনরা সাক্ষী রইল ফেসবুক, টুইটারের মতো ‘সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্ট’দের পুরনো অবস্থান বদলানোর এক মরিয়া প্রচেষ্টার। অবস্থান বদল, নেটিজ়েনদের আস্থা ফিরে পেতে। কারণ, দশকের গোড়ার দিকের তুমুল জনপ্রিয়তার সেই চেনা ছবি শেষ দু’বছরে অনেকটাই ম্লান হয়েছে। ব্যক্তিগত তথ্য চুরির অভিযোগ আর ফেক নিউজ়ের রমরমা ইতিমধ্যেই ভরসার গ্রাফটাকে বেশ খানিক টেনে নামিয়েছে। সেই হারিয়ে যাওয়া বিশ্বাস ফিরে পেতে নানা পরীক্ষানিরীক্ষার পথে হাঁটল ফেসবুক, টুইটার, গুগল— গত এক বছর ধরে।
যেমন, নভেম্বর মাসে টুইটার জানিয়েছে, তারা আর কোনও ধরনের রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন নেবে না। পিছিয়ে নেই গুগলও। তারা অবশ্য রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন নেওয়া সম্পূর্ণত বন্ধ করেনি। তবে নতুন নীতি স্থির করেছে। ব্যতিক্রম একমাত্র ফেসবুক। তারা সটান জানিয়েছে, রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন নেওয়া বন্ধ করবে না। এমনকি, তার সত্যি-মিথ্যে যাচাইও করবে না। কেন? জ়াকারবার্গ জানিয়েছেন, তাঁরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে হলে সেই আদর্শের সঙ্গে আপস করতে হয়। তিনি তাতে সম্মত নন। জ়াকারবার্গের বক্তব্য অনুযায়ী, গণতন্ত্রে কোনও প্রাইভেট সংস্থার অধিকার নেই রাজনীতিবিদের মত বা সংবাদের ওপর ছুরি-কাঁচি চালানোর। সোজা কথায়, রাজনীতিবিদেরা যতই বিজ্ঞাপনে মিথ্যে তথ্য দিয়ে বাক্-স্বাধীনতার অপপ্রয়োগ ঘটান না কেন, ফেসবুকের আপত্তি নেই।
আপত্তি নেই-এর একটা কারণ হিসেবে আর্থিক ক্ষতির কথা উঠে এসেছে। তবে, জ়াকারবার্গ নিজেই জানিয়েছেন, আগামী বছর কোম্পানির আয়ের মাত্র ০.৫ শতাংশ আসবে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন থেকে। সুতরাং, লোকসানের ভয় তাঁদের নেই। পড়ে থাকে আর একটিই সম্ভাবনা: ফেসবুক রাজনীতিবিদদের চটাতে চায় না। সমস্ত বাধানিষেধের বাইরে সত্যিকারের একটা মুক্তমঞ্চ তৈরি করতে হলে নেতারা বিলক্ষণ চটবেন। চাপতে পারে নিষেধাজ্ঞাও।
তাই রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে একটা মাঝামাঝি পন্থা নেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে ফেসবুক। তারা রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন বন্ধ করেনি ঠিকই, কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ-এর ‘এনক্রিপ্টেড মেসেজ’-এ ব্রিটেন, আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার নজরদারি চালানোর প্রস্তাবে অসম্মতিও জানিয়েছে। এই তিন দেশ ফেসবুককে অনুরোধ করেছিল এনক্রিপ্টেড মেসেজ-এর সুরক্ষাবলয়ে ছিদ্র রেখে দিতে, যাতে প্রয়োজনে সরকার সেই মেসেজ দেখতে পারে। আপাত-উদ্দেশ্য, চাইল্ড পর্নোগ্রাফি ও সন্ত্রাস ঠেকানো। ফেসবুক এখনও অবধি তাতে রাজি হয়নি। বরং স্পষ্ট জানিয়েছে, এই কাজ তাদের তথ্যসুরক্ষা ও গোপনীয়তা রক্ষার প্রতিশ্রুতির পরিপন্থী।
আপাত ভাবে, সোশ্যাল মিডিয়ার এই মধ্যপন্থার উদ্দেশ্য একটাই। সে যে নেহাতই রাজনীতির হাতের পুতুল নয়, সেটা প্রমাণের তাগিদ। এই অভিযোগ সম্প্রতি বার বারই তাদের বিরুদ্ধে উঠছে। এত দিনে স্পষ্ট, যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার জন্ম, সেই প্রতিশ্রুতি তারা রাখতে পারেনি। ফেসবুকের জন্মের পর ভাবা হয়েছিল এটাই তো গণতন্ত্র। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের সংবিধানপ্রদত্ত অধিকার হলেও তার আক্ষরিক প্রয়োগ সম্ভব হয়নি এত দিন। সোশ্যাল মিডিয়া সেই সুযোগ এনে দিয়েছিল। মোনোলগ-এর দিন শেষ, জন্ম নিল ডায়ালগ। বাধা-নিষেধ ছাড়াই মিলল নির্ভয়ে যে কোনও বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ!
কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক প্ল্যাটফর্মও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক যন্ত্রে পরিণত! রাজনৈতিক কাজে সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করার এক বিরাট সুবিধে হল, এর বিপুল জনভিত্তি। রাজনৈতিক বার্তা, ভিডিয়ো মুহূর্তে অসংখ্য মানুষের হাতে পৌঁছে যায়। তেমনই সরকারের নজরদারিতেও সুবিধে হয়। সম্প্রতি ভারতে পেগ্যাসাস কেলেঙ্কারিতে যেমন বিরোধীদের অভিযোগের তির কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে। ইজ়রায়েলে তৈরি হওয়া এই স্পাইওয়্যার বিশ্বের প্রায় ১,৪০০ জন কূটনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ এবং উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিকের হোয়াটসঅ্যাপের তথ্য ‘হ্যাক’ করেছে। তালিকায় নাম রয়েছে অন্তত ১২ জন ভারতীয়েরও। এঁদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এবং আইনজীবীরাও। কেন্দ্রীয় সরকারই নাকি পেগ্যাসাস-কে চাপ দিয়েছিল এই নজরদারি চালানোর, অভিযোগ তুলেছে বিরোধীরা।
তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। হোয়াটসঅ্যাপের কাছে জবাবদিহি চেয়ে জানিয়েছে, তারা বরাবরই ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় যত্নবান। আশ্চর্য হল, এই সরকারই আবার ২০২০-র গোড়ায় সোশ্যাল মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণের জন্য কড়া নিয়ম চালু করতে চলেছে, দেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতার পুরনো ধুয়ো তুলে। ফেক নিউজ় আটকানোর অজুহাতে অস্ট্রেলিয়া, চিন, আমেরিকার কায়দাতেই তারাও চায় প্রয়োজনে যে কোনও বার্তার উৎসে পৌঁছতে। কিছু দিন আগেই ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি অব ইন্ডিয়া (ইউআইডিএআই) ‘সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং এজেন্সি’র বরাত ডেকেছিল। তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের মামলার প্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত ইউআইডিএআই সুপ্রিম কোর্টে জানিয়েছে, তারা সেই বরাত প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। সুতরাং, ‘গণতান্ত্রিকতায় অপ্রত্যাশিত আঘাত’ আটকানোর বুলির আড়ালে চলছে সরকারি উদ্যোগে চরম অ-গণতান্ত্রিক কাজকর্ম।
এই নানাবিধ রাজনৈতিক কৌশলের চাপে এই বছর সোশ্যাল মিডিয়ার দিশাহারা চেহারাটা প্রকট। কোন নীতি নিলে দু’দিকই বজায় থাকবে, সেই পথের হদিস খুঁজছে বৃহৎ সংস্থাগুলো। পুরোপুরি মানুষের কথা ভাবতে হলে, সরকার চটবে। আবার, রাজনীতির কথা ভাবতে গেলে গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি মার খাবে, নষ্ট হবে বিশ্বাসযোগ্যতা। বিশ্বাসযোগ্যতা তাঁদের বিশ্বজোড়া ব্যবসা ফেঁদে বসার মূল চাবিকাঠি। ডিজিটাল মার্কেটিং-এর সিংহভাগ নিজেদের দখলে রাখতে সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্টস-দের দরকার আরও বেশি ডেটা। অর্থাৎ, আরও বেশি ‘ভিউয়ার’। এই ডেটায় টান পড়লে সর্বনাশ হবে তাদের দুনিয়াজোড়া ব্যবসার। তা ঠেকাতেই এই তৎপরতা।
বিশ্বাস নেই বাজারকেও। সেখানে সর্বক্ষণই ওঠা-নামার খেলা। নতুন নতুন নেটওয়ার্কিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি হচ্ছে। হয়তো ব্যবসার নিরিখে তারা ফেসবুকের এখনও ধারেকাছে আসতে পারেনি। কিন্তু, ইতিহাস সাক্ষী যে প্রযুক্তির দুনিয়ায় ওলটপালট হতে সময় লাগে না বিলকুল। ফেসবুক এসে যেমন এক সময় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল অর্কুটকে। প্রতিযোগিতায় সেরার আসন ধরে রাখতে গেলে অনবরত পরিবর্তনই একমাত্র পথ।
সেই দিক থেকে দেখলে সোশ্যাল মিডিয়ার এই ভোলবদল নতুন কিছু নয়। বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হচ্ছে বলে আত্মগ্লানির ফলও নয়, হঠাৎ জেগে ওঠা বিরাট সামাজিক দায়িত্ববোধের পরিণতিও নয়। ডিজিটাল মার্কেটিংয়েরই এক অবিচ্ছিন্ন অংশ এটা। রাজনীতি, সাধারণ মানুষকে ঘুঁটি বানিয়ে হরেক চালে কিস্তিমাতের চেষ্টা। ২০১৯ দেখিয়ে দিল সেই খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে।