অর্থমনর্থম্্: রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বৈঠকে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন, পাশে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক গভর্নর শক্তিকান্ত দাস, দিল্লি, ৮ জুলাই। এএফপি
বিশ্বকর্মা পুজো মানেই লাটাই-মাঞ্জা হাতে ঘুড়ি ওড়ানোর দিন। ঘুড়ি ওড়ানোর নেশায় অনেকেই খেয়াল করেন না, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিয়ম করে প্রতি বছর বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে গোটা দেশের মানুষকে শুভেচ্ছা জানান।
এমনিতেই ১৭ সেপ্টেম্বর নরেন্দ্র মোদীর জন্মদিন। সাধারণত ওই দিনেই বিশ্বকর্মা পুজো পড়ে। নিজের জন্মদিনে হাজারো শুভেচ্ছার মধ্যেও প্রধানমন্ত্রী বিশ্বকর্মা পুজোর কথা ভোলেন না। মনে করিয়ে দেন, বিশ্বকর্মা পুজো রাজমিস্ত্রি, কলের মিস্ত্রি বা ছুতোরদের মতো হাতেকলমে কাজ করে রোজগার করা মানুষদের দিন।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যত বারই বছরে ২ কোটি নতুন চাকরির প্রতিশ্রুতি নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন নরেন্দ্র মোদী, বার বারই তিনি যুক্তি দিয়েছেন, কেউ হাতেকলমে কাজ শিখে স্বনির্ভর হলে, সেটাও রোজগার। কেউ তাঁর মুদ্রা যোজনায় বিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ছোট ব্যবসা খুললে সেটাও রোজগার। এই সুরে একটু বেড়ে খেলতে গিয়ে ‘পকোড়া বেচাটাও রোজগার’ বলতে গিয়ে হাজারো কটাক্ষ শুনতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু তা বলে তিনি নিজের ভাবনা থেকে সরেননি।
যদি ভাবেন এই সব ভাবনা নরেন্দ্রভাইয়ের নিজস্ব উদ্ভাবন, ভুল করবেন। সব কিছুর পিছনেই রয়েছে তাঁর আরএসএস প্রচারক হিসেবে দীর্ঘ দিনের প্রশিক্ষণ। এমনকি ওই বিশ্বকর্মা পুজোর শুভেচ্ছাটিও!
সঙ্ঘ-পরিবারের অন্দরমহলে আরএসএস-এর অর্থনৈতিক চিন্তাধারা তৈরিতে যাঁর প্রভাব সবচেয়ে বেশি, তাঁর নাম দত্তোপন্ত বাপুরাও ঠেঙ্গড়ী। ১৯২০ সালে মহারাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া দত্তোপন্তের হাতেই তৈরি হয় ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘ বা বিএমএস, ভারতীয় কিসান সঙ্ঘ এবং স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ। দত্তোপন্ত মনে করতেন, হাতের কাজ শিখে বা ছোট ব্যবসা করে স্বনির্ভর হয়ে ওঠা হিন্দু সংস্কৃতির অভিন্ন অঙ্গ। তাই মিস্ত্রি, স্বনির্ভরদের জন্য হিন্দু ধর্মে এক জন বিশ্বকর্মা নামক পৃথক দেবতা রয়েছেন। দত্তোপন্তের আমলেই বিএমএস বিশ্বকর্মা পুজোর দিনকে জাতীয় শ্রম দিবস হিসেবে পালন করতে শুরু করে।
দত্তোপন্তের ভাবশিষ্য, স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের নেতারা এখন দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্বর হয়ে উঠেছেন। মঞ্চের সদর দফতর, দিল্লির আর কে পুরমের ‘ধর্মক্ষেত্র’ নামের ভবনের ঠিকানা কয়েক বছর আগে পর্যন্তও খুব বেশি লোকে জানতেন না। এখন এই ‘ধর্মক্ষেত্র’ই শিল্পপতি থেকে অর্থনীতিবিদদের তীর্থক্ষেত্র। মোদী সরকারের আর্থিক নীতি কোন পথে চলবে, তার ইঙ্গিত মিলছে এই ধর্মক্ষেত্র থেকেই।
এই ‘ধর্মক্ষেত্র’র শক্তি কতখানি, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ মিলেছে গত এক সপ্তাহে। নতুন মোদী সরকারের প্রথম বাজেটের পরেই অর্থসচিব সুভাষচন্দ্র গর্গকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে তলব করা হয়। বলে দেওয়া হয়, অর্থসচিবের পদ থেকে সরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকুন। কারণ গর্গের মস্তিষ্কপ্রসূত বিদেশ থেকে ডলারে ঋণ নেওয়ার ভাবনা স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের পছন্দ হয়নি। সরকারের সর্বোচ্চ স্তরে তাঁরা সে কথা জানিয়ে দেন। সংসদে বাজেট পাশের পরেই অর্থসচিবকে বদলি করে দেওয়া হয়।
আরএসএস-এর অর্থনৈতিক দর্শন অনেকেরই মতে বামপন্থী গোঁড়ামির সঙ্গে গরুর যোগফল। দত্তোপন্তের লেখা প্রবন্ধের সঙ্কলন ‘দ্য থার্ড ওয়ে’ থেকেই স্পষ্ট, সঙ্ঘের মতাদর্শে বামেদের মতোই বিদেশি লগ্নির প্রতি বিতৃষ্ণা। আর্থিক উদারীকরণ, কঠিন আর্থিক সংস্কার, মুক্ত বাণিজ্যের বিরোধিতা। তার বদলে ভারতীয় সংস্কৃতির কথা বলে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের ‘অন্ত্যোদয়’-এর পক্ষে সওয়াল। মোদী সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে নরেন্দ্র মোদীর নিখরচায় রান্নার গ্যাস, সাধ্যের মধ্যে চিকিৎসার জন্য আয়ুষ্মান ভারত, দীনদয়ালের নামেই গরিব বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগের প্রকল্পে তারই ছাপ। এমনকি নতুন সরকারের প্রথম প্রকল্প, ঘরে ঘরে নলবাহিত পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার মধ্যেও সেই শেষের সারির মানুষের জন্য ভাবনা। এই নীতি মেনেই মোদী সরকার সাহসী আর্থিক সংস্কার থেকে গরিব মানুষের হাতে অল্প অল্প সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার রাস্তা ধরেছে।
সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের নেতাদেরও প্রভাব-প্রতিপত্তি বেড়েছে। মঞ্চের নেতা এস গুরুমূর্তিকে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের পরিচালন বোর্ডে বসিয়েছেন মোদী। চেন্নাইয়ের এই চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বরাবর নোট বাতিলের পক্ষে সওয়াল করে এসেছেন। তাঁর কথামতোই মোদী সরকার অবস্থান নিয়েছে, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের জমানো সঞ্চয়ের পুরোটাই সরকারি রাজকোষে পাঠানো উচিত।
নতুন মোদী সরকারের জমানায় সেই আরএসএস-এর স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ এ বার শক্তিশালী হয়ে উঠে মোদী সরকারের নীতিতে আরও প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। সংঘাতও বাধছে। সব গরিব মানুষের উপকার করতে হলে আর্থিক বৃদ্ধির হারকে ১০ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। তার জন্য নরেন্দ্র মোদীর প্রধান ভরসা— বিদেশি লগ্নি। কিন্তু স্বদেশি জাগরণ মঞ্চ তথা আরএসএস-এর তাতে প্রবল আপত্তি। মোদী মুখে বলেছেন, তিনি বিদেশি লগ্নির জন্য লাল ফিতের ফাঁস নয়, লাল কার্পেট বিছিয়ে দিতে চান। আরএসএস-এর শাখা করে উঠে আসা বিজেপি-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও তাঁকে অনুসরণ করছেন। কিন্তু গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ‘শিল্পপতিদের বন্ধু’ বলে পরিচিত নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর পদে বসে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বহু ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নির রাস্তা খুলতে পারেননি।
প্রশ্ন উঠতেই পারে, লোকসভায় ৩০৩ আসনে জিতে আসা নরেন্দ্র মোদীর কি আদৌ আরএসএস-এর কথায় কান দেওয়ার দরকার রয়েছে?
আপাত ভাবে নেই। কিন্তু মোদী ও আরএসএস-এর মতাদর্শ যে আলাদা, তা-ও তো নয়। মোদী যেমন নিজের ‘শিল্পপতিদের বন্ধু’ ভাবমূর্তি থেকে সরে আসার চেষ্টা করছেন, তেমনই আরএসএস-ও আর্থিক উদারীকরণ, বিদেশি লগ্নির কড়া বিরোধিতা থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। তারা আর আগের মতো বিশ্বায়নকে গাল পাড়ে না। গত বছর মুম্বইয়ের স্টক এক্সচেঞ্জে শিল্পপতিদের সামনে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত বলেছিলেন, আরএসএস একটিমাত্র ফিতে দিয়েই আর্থিক নীতিকে মাপে। তা হল, এতে গরিব মানুষের উপকার হচ্ছে কি না। দত্তোপন্ত বলতেন, সব থেকে ধনীদের সঙ্গে একেবারে গরিবদের ফারাক বেশি বাড়তে দেওয়া চলবে না। ভাগবত বলেন, ধনীদের উচিত গরিব মানুষের সঙ্গে নিজেদের আয় ভাগ করে নেওয়া। দত্তোপন্ত মুক্ত বাণিজ্যের বিরোধিতা করতেন। অশ্বিনী মহাজনের মতো স্বদেশি জাগরণ মঞ্চের নেতারা বলেন, দেশের অর্থনীতিকে স্বনির্ভর হতে হবে। তার জন্য কিছুটা রক্ষণশীল বাণিজ্যনীতির দরকার রয়েছে। দেশের শিল্পকে বাঁচাতে আমদানি আটকাতে দেওয়াল তুলতে হবে।
প্রথম পুরো সময়ের মহিলা অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের ২০১৯-এর বাজেটে আরএসএস-এর সেই ভাবনারই প্রতিফলন। নির্মলা অতি-ধনীদের উপর বাড়তি আয়কর বসিয়েছেন। ভাগবতের সুরেই বলেছেন, ধনীদের উচিত কম আয়ের মানুষের সঙ্গে নিজের আয় ভাগ করে নেওয়া। তার ধাক্কায় যে শিল্পপতিরা দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে লগ্নি করতে পারেন, সেই আশঙ্কা শিকেয় তুলে রাখা হয়েছে।
বাজেটের আগে ২৮টি মার্কিন পণ্যে শুল্ক বাড়ানো হয়েছিল। বাজেটে নির্মলা ইলেকট্রনিক্স, রাসায়নিক, প্লাস্টিক, অটোমোবাইল, ইস্পাত শিল্পের একগুচ্ছ পণ্যে আমদানি শুল্ক বাড়িয়েছেন। স্বদেশি জাগরণের মতোই যুক্তি দিয়েছেন, দেশীয় শিল্পকে বাঁচাতে হবে। ওই সব পণ্যের অনেক কিছুই যে দেশের কারখানায় রফতানি করা পণ্যে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয়, তা ভেবে দেখেননি।
ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ তাঁর অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় আফশোস করতেন— সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোর থাকলে অনেক কঠিন সংস্কার করে ফেলা যেত। শরিকদের নিয়ে ৩৫৩ আসনে জিতে আসা মোদী সরকারের বাজেটে আশা ছিল, এ বার অর্থনীতির আকাশে সাহসী সংস্কারের ঘুড়ি উড়বে।
প্রয়াত দত্তোপন্ত ঠেঙ্গড়ীর শিষ্যরা লাটাই থেকে সুতো ছাড়তেই নারাজ। সংস্কার তাই ভো কাট্টা।