জঙ্গলমহলের জহুরি-ক্রিকেটার

বছর আটচল্লিশের তরুণ। ১৯ বছর ইংল্যান্ডের গ্লস্টারশায়ারে খেলছেন মাইনর ক্রিকেট। প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্কুলে। কেনিয়ায় খেলেছেন মরিস ওদুম্বেদের সঙ্গে। মাঠের বাইরে তিনি আবার অভিনেতা। কোচ হিসেবে জঙ্গলমহলে প্রতিভা খোঁজেন। সুশীল শিকারিয়ার নানা ভূমিকার গল্প শুনলেন আরিফ ইকবাল খানবছর আটচল্লিশের তরুণ। ১৯ বছর ইংল্যান্ডের গ্লস্টারশায়ারে খেলছেন মাইনর ক্রিকেট। প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন ইংল্যান্ডের বিভিন্ন স্কুলে। কেনিয়ায় খেলেছেন মরিস ওদুম্বেদের সঙ্গে। মাঠের বাইরে তিনি আবার অভিনেতা। কোচ হিসেবে জঙ্গলমহলে প্রতিভা খোঁজেন। সুশীল শিকারিয়ার নানা ভূমিকার গল্প শুনলেন আরিফ ইকবাল খান

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৮ ০২:১৩
Share:

তারকা: যিশু সেনগুপ্তর সঙ্গে সুশীল শিকারিয়া। নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: আপনার ছোটবেলার কথা বলুন?

Advertisement

উত্তর: মেদিনীপুর শহরে আমার বাড়ি। বাবা প্রয়াত চিরঞ্জীব লাল শিকারিয়া। বাবার ছিল ব্যবসা। ক্রিকেটে আমার হাতেখড়ি হয় ১৭ বছর বয়সে। স্কুলে পড়ার সময়ই ব্যাট বলের সঙ্গে সংযোগ ঘটে। আমার পরিবারে ক্রিকেট খেলাকে প্রশ্রয় দেওয়া হত। পাড়ার মাঠে সেই সময় কিছু ভাল ক্রিকেটার ছিলেন। অমিয় দত্ত, সত্যব্রত সিন্‌হা। এঁদের দেখেই ক্রিকেট খেলতে শিখেছি। ডানহাতি ব্যাটসম্যান এবং স্পিন বোলার হিসেবে খেলা শুরু করেছিলাম। পরবর্তী সময়ে মেদিনীপুর স্পোর্টিং ক্লাব, ইয়ংম্যান অ্যাসোসিয়েশন, এই দু’টি ক্লাবে খেলতে শুরু করি।

Advertisement

প্রশ্ন: প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে কী ভাবে এলেন?

উত্তর: ১৯৮৬ সালে দাত্তু ফাড়কর স্কুল ক্রিকেটে খেলানো হত। সেই খেলায় ভাল খেলেই বাংলার নির্বাচকদের নজরে পড়ে যাই। সেই সময়ে কন্ডিশনিং ক্যাম্প হত। আমি ক্যাম্পে ডাক পেয়েছিলাম। শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়, স্নেহাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ক্যাম্পে ছিলাম। যদিও আক্ষেপ রয়েছে ভাল খেলার পরও রঞ্জি দলের প্রথম এগারোতে সুযোগ মেলেনি। বেশ কয়েক বছর ধরেই স্ট্যান্ডবাই রাখা হয়েছিল আমাকে।

প্রশ্ন: প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আপনার জার্নি যদি বলেন?

উত্তর: ১৯৯০ সালে আমি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে খেলি। সেই সময়ে আমি ৯টা ম্যাচে ৭০০ রান করি এবং পূর্বাঞ্চলে নির্বাচিত হই। এ ছাড়া কলকাতা লিগে একাধিক ক্লাবে খেলেছি। তালতলা, স্পোর্টিং ইউনিয়ন, উয়াড়ি-সহ একধিক ক্লাবে সুনামের সঙ্গে খেলেছি। আমার নেতৃত্বে কলকাতার ঐক্য সম্মিলনী এ এন ঘোষ ট্রফি চ্যাম্পিয়ন হয়। আমার সঙ্গে খেলেছেন অরুণলাল, অশোক মলহোত্রদের মতো নামী ক্রিকেটার। সেই সময়ের ঐক্য সম্মিলনীর খেলোয়াড় সন্দীপন দাস পরে ভারতীয় অনূর্ধ্ব ১৯ দলে সুযোগ পেয়েছিলেন।

প্রশ্ন: সিনেমায় নামার আগে যিশু আর আপনি এক দলে খেলতেন?

উত্তর: যিশু খুব ভাল খেলোয়াড় ছিলেন। সাবারবান ক্লাবে যিশু খেলতেন। বাংলা দলেও খেলেছেন। সিনেমায় পেশাদার অভিনেতা হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে চুটিয়ে ক্রিকেট খেলতেন যিশু।

প্রশ্ন: কাউন্টি ক্রিকেটে আপনার খেলার কথা বলুন?

উত্তর: টানা ১৯ বছর আমি ইংল্যান্ডে কাউন্টি ক্রিকেট খেলছি। মূলত গ্লস্টারশায়ারের মাইনর কাউন্টি দলে খেলি। এখন খেলার সঙ্গে ইংল্যান্ডে ক্রিকেট কোচিং করাই। সেখানকার বিভিন্ন স্কুলের ছেলে মেয়েদের কোচিং করাই। সেই সঙ্গে এখনও নিয়মিত ক্রিকেট খেলি। ব্রিটিশ কাগজে আমাকে নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন লেখা হয়েছে। আমার সঙ্গে খেলতেন বহু পাকিস্তানি ক্রিকেটারও। এক সময়ে আমার সতীর্থ ইংল্যান্ডের ডারমট রিভ, জ্যাক রাসেলরা কবে খেলা ছেড়ে দিয়েছেন। আর আমি এখনও খেলে যাচ্ছি। ইংল্যান্ড আমাকে দু’হাত ভরে দিয়েছে। রাজ্যে এক্সট্রা স্কোয়াডে দিনের পর দিন ফেলে রাখা হয়েছে আমাকে। কষ্ট হত। কিন্তু হতাশ হইনি। হতাশ হলে আজ হারিয়ে যেতাম। নিজের ফোকাস ঠিক রেখে এগিয়ে গিয়েছি। নিজেকে ধরে রেখেছিলাম বলে আজও ক্রিকেটের মূল স্রোতের মধ্যে আছি।

প্রশ্ন: আপনি মাঝে দুই বছর কেনিয়ায় ক্রিকেট খেলতে গিয়েছিলেন? সেই কথা আমাদের যদি বলেন?

উত্তর: আইসিসি আফ্রিকার ক্রিকেট উন্নতির জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করে। সেই সময় কেনিয়ায় ইংল্যান্ড থেকে অনেকেই খেলতে গেলেন। আমিও কেনিয়ায় খেলার ডাক পাই। বরাবর চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় পেতাম না। তাই হাসি মুখে কেনিয়া গেলাম খেলতে। সেই সময় নাইরোবি শহরের পরিস্থিতি ভাল ছিল না। আইন শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা। কেনিয়া সরকার বাড়ি আসার জন্য ফ্লাইটের টিকিট-সহ নানা সুবিধা দিত। সরকারের কথা হল, আমাদের দেশের ক্রিকেটের মান বাড়িয়ে দিতে হবে। সেই সময় কেনিয়ার ক্রিকেট দল বেশ ভাল ছিল। স্টিভ টিকোলো, মরিস ওদুম্বের মতো আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় সফলরা খেলতেন। আমি ওঁদের সঙ্গে খেলতাম। খুবই সরল মনের মানুষ ছিলেন টিকোলো। খেলা ছাড়া আর কিছু বুঝতেন না।

সহযোগী: কোচ ডেভ হোয়াটমোরের সঙ্গে। নিজস্ব চিত্র

প্রশ্ন: কেনিয়ায় কোনও বিশেষ অভিজ্ঞতার কথা বলুন?

উত্তর: সেই সময় কেনিয়ার আরেক বিখ্যাত ক্রিকেটার ছিলেন মরিস ওউমা। ওঁকে আমি একবার বোল্ড আউট করি। পরে ব্যাট করতে নামেন টিকোলো। নেমেই আমাকে বলেন, খুব ভাল বল করছ তুমি। কিন্তু পরের বলেই আমাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন সাইটস্ক্রিনের উপর দিয়ে। তবে খুব খোলা মনের মানুষ ছিলেন তাঁরা। কেনিয়াকে আমি মিস করি খুবই।

প্রশ্ন: কেনিয়ায় পাকাপাকি থাকার প্রস্তাব ছিল আপনার কাছে?

উত্তর: আমাকে খুব পছন্দ হয়েছিল ওঁদের। আমাকে কেনিয়া ক্রিকেট দলের সঙ্গে কাজ করার অনুরোধ করা হয়েছিল। আমি স্থানীয় স্কুলে গিয়ে ছোট ছোট ছেলেদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দিতাম। জঙ্গলের খুব কাছে বেশ কিছু স্কুল ছিল। প্রাকৃতিক দৃশ্য অপূর্ব। কিন্তু দারিদ্র দেখলে মন খারাপ হয়ে যেত। তবে ওঁরা খুব আন্তরিক ছিলেন। অর্থ দিতে পারতে না। কিন্তু খুব ভালবাসতেন। আইনশৃঙ্খলাজনিত ভয় আমার কেটে গিয়েছিল। রাস্তাঘাটে অনেক সময় জটলা দেখেছি। ভারতীয় ক্রিকেটার দেখলে ওরা কিছু বলত না। ক্রিকেটের ব্যাট আর বল অনেক সময় আমাদের রক্ষাকবচ ছিল।

প্রশ্ন: কেনিয়ায় আপনি ছাড়া এই সময় আর কোনও ভারতীয় ক্রিকেটার খেলতেন?

উত্তর: একটা মজার ঘটনা বলি। একদিন একটা ম্যাচ খেলে উঠেছি। সেদিন ম্যান অফ দ্য ম্যাচ। সকলের সঙ্গে বাংলায় কথা বলছি। এমন সময় দেখি, এক ক্রিকেটার আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলতে শুরু করেছেন। আমি বিস্ময়ে বললাম, আপনি বাঙালি? বিপক্ষের সেই সম্ভ্রম জাগানো ক্রিকেটার কেনিয়ার বিখ্যাত ডাক্তার ছিলেন। এক ডাকে সবাই চিনতেন। ডক্টর পলাশ নামেই তিনি খেলতেন। তিনি আমাকে তাঁর বাড়ি নিয়ে গেলেন। সেখানেই আমার দুর্গাপুজো পালন করা আজও মনে থাকবে। সেদিন দেখেছিলাম তিনি কেনিয়ায় কী রকম বিখ্যাত মানুষ। সম্ভ্রম দেখেছি ক্রিকেটারদের মধ্যেও। আজও পলাশবাবুকে মনে করি। তিনি কথা না বললে বোঝা যায় না বাঙালি বলে। তবে আজ আর ওঁর পদবি মনে নেই। ওই যে সবাই ডক্টর পলাশ বলত।

প্রশ্ন: এখন জেলা থেকে কলকাতায় ক্রিকেটার সরবরাহ লাইন আপনি?

উত্তর: সিএবি আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্যাম্প করে ক্রিকেটার খুঁজে আনার জন্য। সেই কাজে আমি বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়াই। ২০১১ সালে মাওবাদীদের হিংসা পর্বে পশ্চিম মেদিনীপুরে ৫৫০ জন ছেলেকে নিয়ে আবাসিক ক্যাম্প করেছিলাম। সেই সময় সন্দীপ পাটিল, ডেভ হোয়াটমোরকে এনেছিলাম। খুব ভাল হয়েছিল ক্যাম্প।

প্রশ্ন: এখনও আপনি সেই নতুন ছেলেদের তৈরি করে চলেছেন। নতুনদের সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?

উত্তর: ২০১৮ সালে অনূর্ধ্ব ১৭ সেরা খেলোয়াড় হয়েছে মেদিনীপুরের রাহুল কুণ্ডু। সে এ বছর একটি দ্বিশতরান-সহ ৪৬০ রান করেছে। এ ছাড়া অগ্নিভ পান এখন অনূর্ধ্ব ২৩ দলে রয়েছে, নতুন প্রতিভা বলতে অমিত কুইলা। সে এখন বাংলা দলে রয়েছে মহম্মদ সামি, অশোক ডিন্ডাদের সঙ্গে।

প্রশ্ন: ক্রিকেট খেলতে খেলতে কী ভাবে সিনেমায় এলেন?

উত্তর: সিনেমা করার শখ ছিল আগে থেকেই। যে কোনও কাজকে আমি পেশাদারিত্বের মোড়কে করতে ভালবাসি। যিশু আমার ক্রিকেট খেলার সময়কার বন্ধু। সেলিব্রিটি ক্রিকেটের সময় বহু তারকা সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁরা আমাকে সিনেমায় অভিনয় করার প্রস্তাব দেন। সেই প্রস্তাব আমি লুফে নিয়েছি। আমি ইতিমধ্যে দশটি সিনেমায় অভিনয় করে নিয়েছি। ‘হৃদয়’, ‘মন শুধু তোকে চায়’, ‘মুখোশ’, ‘ডিয়ার গড’, ‘নিঃশব্দ’ প্রভৃতি সিনেমা। অর্জুন, সাহেব, খরাজ, অনেকের সঙ্গেই কাজ করেছি। বুম্বাদা মানে প্রসেনজিতের প্রোডাকশনে কাজ করে খুব আনন্দ পেয়েছি। আমাকে খুব স্নেহ করেন।

প্রশ্ন: কী ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেন?

উত্তর: আমি খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করি।

আপনার স্বপ্ন কী?

উত্তর: ভারতের জার্সি গায়ে দিয়ে খেলছে এখানকার ছেলে মেয়েরা। এটাই আমার স্বপ্ন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement