বিহারের নির্বাচনে তাঁদের সাফল্য দেশের নজর কেড়েছে। বাংলায় বামেদের কর্তব্য নির্ধারণে তিনি যা বলছেন, তাতে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কী ভাবছেন সিপিআই (এমএল) লিবারেশনের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।
প্রশ্ন: বিহারের নির্বাচনের ফলাফলকে কী ভাবে দেখছেন? কী উঠে এল এই নির্বাচন থেকে?
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য: খুবই আশাব্যঞ্জক। আশা করেছিলাম যে সরকার পাল্টে যাবে, সেই আশা পূরণ হয়নি ঠিকই। মহাগঠবন্ধনের সব দলই কিছু আসন খুব কম ভোটের ব্যবধানে হেরেছে। কিছু আশঙ্কার অবকাশ আছে ভোটগণনায়। সব প্রার্থী গণনার সিসিটিভি ফুটেজ চেয়েছেন, যাতে আশঙ্কার নিরসন হয়। ফুটেজ খতিয়ে দেখা হোক।
যদি মেনেও নিই যে এনডিএ-র সরকার থেকে গেল, তবুও ভোটের ফল খুব তাৎপর্যপূর্ণ। শক্তিশালী বিরোধীপক্ষ সামনে এল। কংগ্রেসমুক্ত ভারত দিয়ে শুরু করে বিজেপি এখন চায় বিরোধীপক্ষ-বিহীন গণতন্ত্র! সেখানে বিহারে শক্তিশালী বিরোধী উঠে আসার ফল হাতেনাতে টের পেলাম আমরা। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত এক জনকে শিক্ষামন্ত্রী করা হল, তিন দিনের মাথায় তাঁকে পদত্যাগ করতে হল। বৈশালীতে গুলনাজ়কে পুড়িয়ে মারার ঘটনার প্রতিবাদ হচ্ছে প্রথম দিন থেকেই। এই যে শক্তিশালী বিরোধী থাকার ফল, এটা চমৎকার দিক।
আরও চমৎকার, জনগণের আন্দোলনের প্রশ্নগুলো নির্বাচনের প্রশ্ন হয়ে উঠতে পারল। অধিকাংশ প্রশ্নই বেকার যুবকদের দাবি, শিক্ষকদের দাবি বা সেবিকা-সহায়িকাদের দাবি। জনগণের আন্দোলনের চলমান দাবিগুলোই এ বার নির্বাচনের বিষয় হয়ে উঠে এসেছে, এটা স্বস্তিদায়ক।
প্র: এই যে চলমান আন্দোলনের দাবিকে নির্বাচনের বিষয় করে তুলতে পারা, সেটাই কি বিহারে বামপন্থীদের সাফল্যের কারণ? সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বাইরে জনজীবনের সমস্যার দিকে নির্বাচন এবং মানুষের নজরকে টেনে নিতে পারা?
উ: এটা একটা কারণ অবশ্যই। আবার বামপন্থীদের কারণেই এই বিষয়গুলি নির্বাচনের অ্যাজেন্ডা হয়ে উঠতে পেরেছে। শিক্ষা, কাজের দাবিতে আন্দোলন চলছে দীর্ঘ দিন ধরে। রেলের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ আমার মনে হয় বিহারেই হয়েছে। সাসারামে ছাত্র-যুবদের ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে। মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনের মধ্যেই বামপন্থী ছাপ আছে।
লকডাউনের অভিজ্ঞতা মানুষকে অনেক কিছু শেখাল। ‘ডাবল এঞ্জিন সরকার’-এর প্রচার চালু আছে ওখানে। কেন্দ্র ও রাজ্যে একই দলের সরকার থাকলে উন্নয়নে গতি আসে, এটাই এই প্রচারের বক্তব্য। বাংলাতেও বিজেপি এটা বলবে। তা সেই ‘ডাবল এঞ্জিন সরকার’ মানুষ অনুভব করল লকডাউনের সময়ে। মানুষ দেখল, কোনও ইঞ্জিনেই ড্রাইভার নেই! কেন্দ্র বা রাজ্যের সরকার পাশে নেই। পাশে আছে বামপন্থী কর্মীরা।
পরিযায়ী শ্রমিকদের বিহারের সীমানায় আটকে দেওয়া হল। নীতীশ কুমার বললেন, শ্রমিকেরা করোনা নিয়ে আসছে। আমাদের প্রচেষ্টায় তারা ঢুকতে পারল। এর পরে কোয়রান্টিন সেন্টারে গেল, সেখানে ন্যূনতম সুবিধা নেই। সেই লড়াইটাও বামপন্থীরা লড়েছে। লকডাউনের সময়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং এই আন্দোলন, এটা কাজে লেগেছে।
প্র: জন-আন্দোলনের প্রশ্নকে সামনে এনে লকডাউনের সময়ে কাজের যে ফল বিহারে পাওয়া গিয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা অন্যত্র প্রসার করা সম্ভব?
উ: অবশ্যই সম্ভব। সেটা করা খুব জরুরিও বটে। বিহারে আন্দোলনের বিষয়ই নির্বাচনে বিষয় হিসেবে এল। শুধু তা-ই নয়, নির্বাচনটাই একটা আন্দোলন হয়ে উঠল। বিশেষ করে, ১৮ থেকে ২৫ এবং ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সিদের বিরাট অংশের কাছে এই নির্বাচন এক ধরনের অভ্যুত্থানের মতো ছিল। এই চেষ্টাটাই আমাদের অন্য জায়গাতেও করতে হবে। বাংলাতেও করোনা আবহে ভোট হবে। আমার ধারণা, খুব বেশি পরিবেশ পাল্টাবে না। বাংলায় অতিমারি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার চরম উদাসীন, রাজ্যও ব্যর্থ। সরকারি ব্যর্থতা ও উদাসীনতা বড় প্রশ্ন এখানে। বাংলার উপরে একটা অতিরিক্ত বোঝা আমপান। মানুষের পাশে বামপন্থীরা যে ভাবে দাঁড়িয়েছে, যে ভাবে বিপন্ন মানুষের জন্য কাজ করেছে, তাকে নির্বাচনে নিয়ে যেতে হবে।
প্র: বাংলার প্রসঙ্গ যখন এল, এই রাজ্যে বামপন্থীদের আদর্শ কৌশল কী হওয়া উচিত?
উ: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের মতো জনগণের মূল দাবিগুলি নিয়ে বাংলার নির্বাচনের বিষয় তৈরি করার ক্ষেত্রে বামপন্থীদের বড় ভূমিকা থাকা উচিত। বাংলার রাজনীতিতে একটা একমুখী প্রবাহ গড়ে উঠেছে। ‘তৃণমূল সরাও’ বলে ডাক দেওয়া হচ্ছে বলে বিজেপি ক্রমেই বাড়ছে। দেশের চরম আর্থিক সর্বনাশ, ঢালাও বেসরকারিকরণ, নতুন শিক্ষানীতি বা কৃষিনীতিকে নির্বাচনের অ্যাজেন্ডা করে তুলতে হবে। সরকারের বাইরেও বিজেপির রাজনীতি যে সর্বনাশা, তাকে বাংলার নির্বাচনের প্রধান আলোচ্য করে মানুষকে সংগঠিত করতে হবে। বিজেপি ফিসফিস করে ডাক দিয়েছে ‘একুশে রাম, ছাব্বিশে বাম’! বিষয় তো এটা নয়। গোটা দেশ বরং বলছে ‘ত্রাহি মাম্’! বিজেপির সর্বনাশা নীতি থেকে দেশকে বাঁচাও, এই পূর্ণাঙ্গ চিত্র বাংলায় দেখাতে হবে।
প্র: বিজেপি যে সর্বনাশা, সেই প্রশ্নে বামপন্থীদের মধ্যে কোনও দ্বিমত আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল, নির্বাচন বিধানসভার। রাজ্য সরকারের বিরোধিতার প্রশ্নটাও তো আছে?
উ: বিধানসভা নির্বাচনে গণতন্ত্র বা দুর্নীতির নানা প্রশ্নে রাজ্যের কাছ থেকে হিসাব নেওয়ার কাজটাও মানুষ করবে। কিন্তু বামপন্থীদের ভোট সমানে বিজেপির দিকে চলে যাচ্ছে, তাদের সম্বিৎ ফিরিয়ে আনতে হবে! যে রাজ্যে ৩৪ বছর বাম শাসন ছিল, যে রাজ্যকে বামপন্থীদের ‘দুর্জয় ঘাঁটি’ বলতে আমরা গর্ব বোধ করি, সেখানে বিজেপি সরকারে এসে গেলে বামপন্থীদের জন্য তার চেয়ে বেশি লজ্জা ও অপমানের আর কিছু হতে পারে না! জীবনের কোনও পর্যায়ে বামপন্থী কোনও মিছিলে যে হেঁটেছে, সে যেন পদ্মফুলের বোতামটা টিপতে লজ্জাবোধ করে— এই সচেতনতা জাগাতে হবে।
প্র: আপনার এই কথার পরে বামপন্থী মহলে বিতর্ক শুরু হয়েছে। সিপিএম নেতারা বলছেন, তৃণমূলকে ছাড় দিয়ে বিজেপি-বিরোধিতা কী ভাবে বাস্তবে সম্ভব! গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের দিক থেকে কি এমন বিতর্ক খুব সহায়ক?
উ: সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, বিজেপি গোটা দেশেই এক নম্বর টার্গেট। যদি সিপিএমের বন্ধুরা বাংলায় এটাই মনে করেন, তা হলে এই বিতর্ক ওঠা উচিত নয়। আমি কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে হাত মেলাতে বা তাদের ছাড় দিতে বলিনি! বিজেপি গোটা দেশের মতো বাংলাকেও ছারখার করবে। এইটাকে প্রধান বিপদ মনে করা জরুরি। কী করা যায়, তা নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। যদিও দু’রাজ্যের পরিস্থিতি আলাদা, তবু আমাদের কিছু অভিজ্ঞতা বিহারে আছে। ১৯৯০ থেকে ২০০৫, আরজেডি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি কিন্তু তা করতে গিয়ে বিজেপি যে এক নম্বর শত্রু, সেটা আড়াল করিনি।
বাংলায় তৃণমূল কৃষক ও শ্রমিকের কথা বলে ক্ষমতায় এল, তার পরে কী অবস্থা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে বামপন্থীরা অবশ্যই প্রধান বিরোধীপক্ষ। কিন্তু এই বিরোধিতা করতে গিয়ে রাজ্যে ক্রমাগত বিজেপি বাড়ছে। চারটে কথা রাজ্যের বিরুদ্ধে বললাম আর দুটো কথা কেন্দ্রের বিরুদ্ধেও বললাম, এমন যান্ত্রিক সমন্বয়ে কাজ হবে না। বিপজ্জনক প্রবণতা বন্ধ করলে বামপন্থা বাড়বে না। বামপন্থী শক্তিবৃদ্ধিই বিজেপির জবাব, তৃণমূলেরও জবাব!
প্র: তৃণমূলের বিরোধিতায় বামেদের সুর অনেক ক্ষেত্রেই বিজেপির সঙ্গে মিলে যাওয়ায় বিজেপির সুবিধা হয়ে যাচ্ছে। তৃণমূলের সমালোচনার একটা বামপন্থী ভাষ্য নির্মাণের কথা বলছেন?
উ: হ্যাঁ, এটাও বলছি। তৃণমূলের বিরোধিতা বাম, গণতান্ত্রিক অবস্থান থেকে করা দরকার। ‘প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা’ কথাটা ভুল মনে করি। যদি বোঝানো হয়, বিজেপির হিন্দুত্বের মোকাবিলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নরম হিন্দুত্ব করছেন, সেটা খোলাখুলি বলা হোক! প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার কথা বললে মানুষ বোঝে বিজেপি হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা আর তৃণমূল মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা করছে। তাতে বামেদের লাভ হয় না। বিজেপির কথারই অনুরণন হয়। বিজেপির রাজনীতির মুখোশ খুলে তৃণমূলের রাজনীতির বিরুদ্ধে বামেদের দাঁড়াতে হবে।
প্র: বিহারে কিন্তু শ্রমিক, কৃষক বা যুব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরাই নির্বাচনে সাফল্য পেয়েছেন। বাংলায় বামদের মুখের অভাব। ওখানে আলাদা কোনও মুখ লাগেনি, বক্তব্যটাই মুখ। এখানে কি তা হতে পারে?
উ: এই মুখের বিষয়টা ‘ব্র্যান্ডিং-এর প্রশ্ন, কর্পোরেট আদল থেকে এসেছে। বলা হচ্ছে, আগে মোদীর বিকল্প দেখাতে হবে! সংসদীয় রাজনীতিতে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তারাই সরকারের নেতা নির্বাচন করে। আজকাল পদ্ধতিটাই উল্টে দিতে চাওয়া হচ্ছে। বামপন্থার ক্ষেত্রে আন্দোলনটাই বার্তা। আন্দোলনের কর্মীরাই অজস্র মুখ হয়ে উঠতে পারে।
সাক্ষাৎকার: সন্দীপন চক্রবর্তী