লাদাখ-পর্যটনের দু’টি অধ্যায়। একটি ২০০৯-এর আগে, অন্যটি ২০০৯-এর পরে। এই আগে-পরের মাঝে রয়েছে হিন্দি ছবি ‘থ্রি ইডিয়টস’। পর্যটন দফতরের পরিসংখ্যান বলিউডের অতিনাটকীয়তাকেও ছাপিয়ে যায়। ২০০৯ সালে লাদাখে পর্যটক সংখ্যা ছিল আটাত্তর হাজার। ‘থ্রি ইডিয়টস’ মুক্তি পাওয়ার দু’বছরের মধ্যে, ২০১১ সালে, তা দ্বিগুণ বেড়ে দেড় লক্ষ ছোঁয়। ২০১৮ সালে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ মানুষের পা পড়েছে এই শীতল মরুপ্রান্তরে, যেখানে জনসংখ্যাই সাকুল্যে আড়াই লক্ষ। হিন্দি ছবির প্রভাবে, মাত্র এক দশকের মধ্যে এক বৃহৎ ভৌগোলিক অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক মানচিত্র পাল্টে যাওয়ার নজির ভূভারতে এমন আর দুটো আছে কি?
প্যাংগংয়ের স্বর্গীয় নীলাভ প্রেক্ষাপটে, স্প্যাংমিক নামক ছোট্ট একটি কুড়ি ঘরের গ্রামের কথা বলি। এই গ্রামে আগাছার মতো মাথাচাড়া দিয়েছে কয়েকশো লাক্সারি তাঁবু, যার সংখ্যা ফি বছর বেড়েই চলেছে। ইন্টারনেট পরিষেবা দুর্বল, মোবাইল চলে না বেশির ভাগ জায়গায়। অভ্যস্ত বিনোদন নেই, তাই এখানে আরও বেশি করে প্রয়োজনীয় হয়ে ওঠে প্যাকেজড তাঁবু, প্যাকেজড গদি, প্যাকেজড গাড়ি, প্যাকেজড জল, প্যাকেজড আরাম। অক্টোবরে পর্যটক-ফুর্তির সমাপ্তি হয়। তুষারপাতের হাত থেকে বাঁচাতে তাঁবু-দেহ সরিয়ে নেওয়া হয় তখন। পড়ে থাকে সহস্র লোহার তাঁবু-কঙ্কাল, উন্মুক্ত কমোড, বেসিন, পাইপ— দ্রব্যের মহাজঞ্জাল।
বাবুদের স্বাদ-আহ্লাদ মেটাতে বেশির ভাগ জমিই স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতছাড়া হয়েছে। বছরে দু’এক লক্ষ টাকার লিজ়ে গ্রামের বেশির ভাগ পরিবার তা সঁপেছেন ধনী ব্যবসায়ীদের, যাঁরা সপ্তাহে লাখ টাকার মুনাফা করে থাকেন প্রতি পাঁচ-দশ কাঠা পিছু। পর্যটকদের চাহিদা মেটাতে গিয়ে বিপর্যস্ত প্রাকৃতিক ভারসাম্য। একশো মানুষের গ্রামে এখন হাজার মানুষের রাত্রিবাস। যেখানে প্রকৃতি সবুজ-আবরণ-শূন্য, সেখানে চলেছে জলের যথেচ্ছ অপব্যবহার। জল গরম করার জন্য বসেছে পেল্লায় মাপের ডিজেল জেনারেটর। খোলা আকাশের নীচে আবর্জনা।
ছুটি ফুরোলে আমরা ফিরে আসি যে যার চেনা দুঃখ ও চেনা সুখে, কিন্তু ফেলে আসা প্রান্তর জুড়ে পড়ে থাকে চায়ের গেলাস, সিগারেটের টুকরো, প্লাস্টিকের থালায় ম্যাগি, কোক-পেপসির প্লাস্টিক ও আরও কত উচ্ছিষ্ট। পড়ে থাকে আমাদের শোয়ার ও বসার ঘরের আরামগুলোকে সতেরো হাজার ফুট উচ্চতায় চরিতার্থ করার তীব্র বাসনা। কত সহজেই, কত দূরবর্তী প্রান্তরে আমরা উড়ে গিয়ে জুড়ে বসতে সক্ষম। এসইউভি-র চাকার চিহ্ন ও গর্জনে জেগে ওঠে নীরব প্রান্তর। বায়ুযানের গতি ও আমাদের আর্থিক সামর্থ্যের জোরে আমরা নিমেষে পৌঁছতে পারি পছন্দের গন্তব্যে। যেখানে যাচ্ছি, সেখানে কী ফেলে আসছি তা নিয়ে ভাবার অবকাশ কতটুকু?
দূষণমুক্ত প্রাঙ্গণে ডিজেলের ধোঁয়া উড়িয়ে, হিমশীতল মরুপ্রান্তরে গরম জলে স্নান করে, ঘাসবিহীন পাথুরে এলাকায় বাটার-চিকেন চেয়ে, প্যাংগং পারে সেলফি-স্পৃহাকে তোল্লাই দিলে— তবেই না সম্পন্ন হয় আমোদের পর্যটন প্রক্রিয়া! শান্ত হয়ে সৌন্দর্য উপভোগ করার পাবলিক আমরা নই। জনমানবশূন্য অঞ্চল, খোলা উপত্যকায় চলন্ত মেঘের ছায়া-খেলা, মহাজাগতিক পরিসর, অদ্ভুত সমস্ত রঙের রকমফের— এ সবকে ছাপিয়ে যাবে মানব উপস্থিতি, তবেই না সার্থক পর্যটন। বরদাস্ত করতে করতে স্থানীয় মানুষজনও বুঝতে শেখেন পুঁজির দাপট ও টুরিস্ট বাহিনীর অসামরিক শক্তি। এ সমস্যা শুধু প্যাংগংয়ের নয়। এ ব্যাধিকে পর্যটক পায়ে পায়ে নিয়ে যান সর্বত্র— পাহাড়ে, সমুদ্রে, জঙ্গলে— পৃথিবীর সর্বশেষ প্রান্তেও। স্থান, কাল, পাত্র, প্রকৃতি— সকলই আকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে বা পর্যটনের বিজ্ঞাপনে পরিণত, এবং আমরা কিস্তিতে কিনে ভোগ করি সে সকল দৃশ্য-পণ্য।
গত আট বছরে যথেষ্ট ঘিঞ্জি হয়েছে লে শহর। পাথর মাটির বাড়ি ভেঙে চারিদিকে মাথাচাড়া দিয়েছে বহুতল কংক্রিট। লে-র প্রায় সব বাড়িই এখন হোটেল বা গেস্ট হাউস। শহরের জলসঙ্কট উপেক্ষা করে ২০২৫ সালের ভিশন ডকুমেন্ট জোর দিয়েছে দ্রুত পর্যটন পরিষেবার উন্নয়নে। সদ্য প্রকাশিত সরকারি বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, চরম শীতেও নাকি পর্যটক আকর্ষণের অভিসন্ধি করছে মন্ত্রক। বরফ-ক্রীড়া আয়োজনের চিন্তাভাবনা চলছে। বছরব্যাপী মরসুম চললে স্থানীয় বাসিন্দাদের আয় বৃদ্ধি পাবে ও জীবিকার সুরাহা হবে।
আর প্রকৃতি, পরিবেশ, পরিমণ্ডল? প্রকৃতি না থাকলে পর্যটন কী ভাঙিয়ে খাবে? লাদাখের ভৌগোলিক অবস্থান ১২০০০ ফুটের ঊর্ধ্বে। উচ্চতা, অক্সিজেন ও জলের অভাব, অনুর্বর জমি, সীমিত ফলন— সব মিলিয়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য এখানে সূক্ষ্ম তারে বাঁধা। ছ’মাসে সাড়ে তিন লাখ পর্যটকের প্রয়োজন মেটানোর সক্ষমতা লাদাখের আদৌ আছে কি? থাকলেও, তার ধারণক্ষমতার মেয়াদ কতটুকু বা কত দিনের? এখনই কথাগুলো না ভাবলে ইতিহাসের চোখে আমরা ‘ইডিয়ট’ সাব্যস্ত হব।
সমাজতত্ত্ব বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়