করোনা অতিমারির কি সবই খারাপ? ভাল দিকটা দেখতে পাচ্ছেন সফিকুল মল্লিক। আনাজের ট্রাক চলছে, অথচ পয়সা নিচ্ছে না পুলিশ। বাহান্ন বছর ব্যবসা করছেন তিনি, রোজ তাঁর আট-দশটা ট্রাক যায় দেগঙ্গা থেকে কলকাতা, বা পাঁশকুড়া। এক পয়সাও ঘুষ দিতে হচ্ছে না, এমন কখনও দেখেননি। লকডাউন হতে আনাজের ট্রাকের রাস্তা খুলে গিয়েছে।
শুরুটা সহজ হয়নি। আনাজের ট্রাক আটকানো চলবে না, উপরমহলের এই নির্দেশের পরেও ২৯ মার্চ নবান্নের অদূরে, বিদ্যাসাগর সেতু টোল প্লাজ়ায় ট্রাক আটকে পয়সা চাওয়ার জন্য সাত পুলিশকর্মীকে সাসপেন্ড করা হয়। ব্যবসায়ীদের মতে, ঘুষের এমন শাস্তি অভূতপূর্ব। কেবল তো এ রাজ্যে নয়, ভারতে ট্রাক চলা মানেই পুলিশের হাত বাড়ানো। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা বলছে, ট্রাকচালকরা পুলিশকে ঘুষ দেয় বছরে অন্তত সাতচল্লিশ হাজার কোটি টাকা। তা হলে পশ্চিমবঙ্গের চাষির থেকে আনাজ বয়ে বাজার অবধি পৌঁছে দেয় যত বড় ট্রাক (২০-২৫ টন) আর ছোট ট্রাক (চার-পাঁচ টন), তাদের কত ঘুষ দিতে হয় বছরে? এর উত্তর সহজ নয়। রাজ্যের প্রায় সর্বত্র আনাজ উৎপাদন হয়, ছোট-বড় মিলিয়ে বাজারের সংখ্যা ন’হাজারের মতো। চল্লিশ শতাংশের মতো আনাজের পরিবহণ হয় ট্রাকে। লাইসেন্সের সংখ্যা দিয়ে যদি বা মালবাহী যানের আন্দাজ হয়, কে কী বহন করে, তার খোঁজ মিলবে কী করে?
অথচ কথাটা ভাবাচ্ছে। রাজ্যের ১০৯টি কৃষি চেকপোস্ট উঠে গেল পয়লা এপ্রিল থেকে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নবান্নে বললেন, কৃষিপণ্যের মাসুল উঠে যাওয়ায় রাজ্য সরকারের বছরে ২০০ কোটি টাকা ক্ষতি হবে, কিন্তু চাষিরা হয়রানি, ক্ষতির থেকে বাঁচবেন।
ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন, এক বার লকডাউন উঠে গেলে পুলিশের ঘুষ কি এড়ানো যাবে? অনেক থানায় চলে মাসকাবারি ব্যবস্থা, তিনশো থেকে পাঁচশো টাকায় গাড়িপিছু কার্ড। ভাঙড় থেকে কলকাতা আসার পথে চারটে এমন কার্ড লাগে, জানালেন এক ব্যবসায়ী। তার পরেও রয়েছে রাস্তার মোড়ের পুলিশ। কোনও এক অজুহাতে মাসে এক-দু’বার গাড়ি ধরা পড়বেই। সব মিলিয়ে পুলিশের জন্য গাড়ি-পিছু মাসে কত ধরতে হয়? আট-দশ জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে আন্দাজ হয়, মাসে তিন হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। এর ফলে কিলোগ্রাম পিছু আনাজের দাম কত বাড়ে? তাঁদের হিসেব, ষাট পয়সা থেকে দু’টাকা।
কলকাতায় আনাজের প্রধান পাইকারি বাজার কোলে মার্কেট। আলু-পেঁয়াজ, আদা-রসুন বাদ দিয়ে কাঁচা আনাজের বড় ট্রাক আর ছোট গাড়ি ঢোকে রোজ অন্তত আড়াইশো। সেখান থেকে ফের গোটা পঞ্চাশ ট্রাক শহরের নানা বাজারে পৌঁছে দেয় আনাজ। যদি ধরা যায় তিনশো গাড়ির প্রত্যেকটাকে মাসে গড়ে চার হাজার টাকা ঘুষ দিতে হচ্ছে, তা হলে দাঁড়ায় মাসে বারো লক্ষ, বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকা। আরও একুশটা জেলা ধরলে ছবিটা কেমন, আন্দাজে বুঝতে হবে। এ ছাড়াও আনাজ পরিবহণে কাজ করে প্রচুর ভ্যান। কোনওটা মোটর-চালিত, কোনওটা প্যাডেল। এর চালকদেরও স্থানীয় থানায় তিনশো-চারশো টাকার কার্ড করাতে হয়, সইতে হয় হঠাৎ ভ্যান আটকানোর উৎপাত।
কোলে মার্কেটের কর্ণধার এবং কৃষি বিপনন টাস্ক ফোর্সের সদস্য কমল দে অবশ্য মনে করেন, ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে বলেন ঘুষের অঙ্ক। “এ স্রেফ আনাজের দাম ইচ্ছেমতো বাড়ানোর অজুহাত।” কথাটা ভুল নয়, করোনা-সঙ্কট তা স্পষ্ট করল। চাষি নগণ্য দামে বিক্রি করেছে, পরিবহণের খরচ কমেছে, কিন্তু আনাজের দাম কলকাতার বাজারে কমেনি। তবু হিসেবটা কেবল ঘুষের টাকা দিয়ে করলে হবে না। পুলিশ ধরা মানেই দেরি, আর দেরি মানেই ক্ষতি। প্রতি ঘণ্টায় প্রতি কিলোগ্রামে আনাজের দর কমে অন্তত এক টাকা। এক গাড়িতে দশ লক্ষ টাকার মাল থাকলে প্রতি ঘণ্টায় কমপক্ষে দশ হাজার টাকা ক্ষতি। পুলিশ তা জানে বলেই নিশানা করে আনাজের গাড়িকে। কাগজপত্র যতই ঠিক থাক, ওভারলোডিং, সিগন্যাল ফেল, কোনও এক অজুহাতে আটকাবেই, নালিশ ট্রাক চালকদের।
মুখ্যমন্ত্রী দেখালেন, প্রশাসন কড়া হলে পুলিশের দুর্নীতি থামানো সম্ভব। এখন প্রশ্ন, লকডাউন উঠলেও এমনই থাকবে তো?
প্রশ্ন আরও আছে। চেকপোস্ট তুলে দিয়ে সরকারের বৈধ প্রাপ্য দুশো কোটি টাকা মমতা ছাড়লেন চাষির স্বার্থে। কিন্তু চাষির কি সত্যিই কিছু লাভ হল কর মকুব, ঘুষ মকুবে? ব্যবসায়ী ঘুষের টাকাটা জুড়ে দেন আনাজের দামে। ঘুষের টাকা বাঁচলে খদ্দেরের লাভ। চাষির কী এসে গেল?
ঠিকই, কৃষিপণ্য বিপননের যে ব্যবস্থা এখন চলছে, তা-ই যদি চলতে থাকে, তা হলে এতে চাষির লাভ নেই। বাজার মধ্যস্বত্বভোগীর দখলে, চাষি দাঁত ফোটাতে পারেন না বলে দাম পান না। তাই চাষিকে বাজারে আনার নানা চেষ্টা চলছে। যেমন, চাষির থেকে সরাসরি ধান কেনা। চালকল মালিক আর ফড়েদের চক্রে সেই চেষ্টা সম্পূর্ণ সফল হয়নি। তবে তৃণমূল আমলে অনেকটা ধান (মোটা ধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ) সরকার কিনছে বলে ধানের বাজার খুব বেশি পড়তে পারে না। ধানের অভাবী বিক্রি কমেছে, পরোক্ষে লাভ হয়েছে চাষির।
তৃণমূল সরকারের অপর কৌশলটি ছিল প্রতি ব্লকে কিসান মান্ডি নির্মাণ। যেখানে চাষি নিজের ফসল নিজে বিক্রি করবেন। এই উদ্যোগ ব্যর্থ, অধিকাংশ মান্ডি ভূতের আস্তানা।
চাষিকে বাজার ধরাতে মোদী সরকারের নিদান ছিল দেশের সব বাজারের নেট-সংযোগের মাধ্যমে বৈদ্যুতিন বেচাকেনা (ই-নাম)। এ রাজ্যে সে প্রকল্পের অবস্থা কহতব্য নয়। মাত্র দু’কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে চলতি অর্থবর্ষে, কুড়ি শতাংশ চাষিরও নথিভুক্তি হয়নি। চাষি নিজের ফসল অনলাইনে নিলাম করছেন দেশের সর্বোচ্চ দাম অফার-করা ক্রেতার কাছে, এ ছবি এখনও স্বপ্ন।
বড় বড় পরিকল্পনা যখন কাজ করছে না, তখন ছোট ছোট পথগুলো অন্তত খুলে দিক রাজ্য সরকার। কাছের বাজারে দাম একেবারে পড়ে গেলে একটা মোটর ভ্যান কি ম্যাটাডোরে ফসল নিয়ে যাতে কিছু দূরের বাজারে যেতে পারেন চাষি, তার ব্যবস্থা হোক। তাতে বাধা দুটি। রাস্তায় পুলিশ, আর বাজারে ব্যবসায়ী-চক্র। দুটোই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ চায়, ছুটকো কারবারির উপর এমন ‘কর’ বসায় যে সে হঠে যেতে বাধ্য হয়। এমনকি ব্যবসায়ীর কাছেও বাজার সঙ্কুচিত হয়। এক জন বললেন, ‘‘ধরুন বাঁকুড়ায় কুমড়ো ভাল হয়েছে, কি হুগলিতে তরমুজ। হয় বেশ কিছু টাকা পুলিশের জন্য ধরে বেরোতে হবে, না হলে ঝামেলা এড়াতে যাবই না।’’
এ দিকে আনাজ পচনশীল, ধরে রাখার উপায় নেই। ও দিকে দরকারে দূরের ক্রেতা ধরার উপায় নেই চাষির। তাই উচ্ছে, টম্যাটো, বেগুন এক সঙ্গে অনেক উঠলেই দাম পড়ে। ভারতে সর্বাধিক আনাজ উৎপাদন করেন পশ্চিমবঙ্গের চাষি। তাঁদের উৎপাদনের অর্ধেক যায় অন্য রাজ্যে। গোটা দেশকে পটল আর কাঁকরোল তাঁরাই খাওয়ান। কিন্তু তাঁদের জন্য নেই আনাজের হিমঘর, হিমায়িত পরিবহণ। চাষির কত শ্রম, বিনিয়োগ জলে যাচ্ছে, কে তার হিসেব কষেছে?
কৃষি বিশেষজ্ঞরা ফসলের দুই রকম ভাগ করে থাকেন। খাওয়ার ফসল, আর নগদ পাওয়ার ফসল। পশ্চিমবঙ্গে আনাজই কিন্তু চাষির “ক্যাশ ক্রপ”। লকডাউন বহু চাষির কাছে সহনীয় হয়েছে কেবল আনাজের বাজার খোলা আছে বলে। লাভ কম হয়েছে, তবু হাত খালি হয়নি। পশ্চিমবঙ্গে চাষিকে দুঃসময় পার করার শক্তি দিতে হলে, তাকে আনাজের বাজার ধরতে দিতে হবে। তার ফসলকে পুলিশের থেকে সুরক্ষা দিতে হবে। ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’ কিংবা ‘মা-মাটি-মানুষ’, ফের যেন না মিথ্যে হয়ে যায় দুটো শব্দে।
“সাইড কর।”