ভারতীয়দের নীতিবোধ দাঁড়িয়ে রয়েছে ভক্তি ও আনুগত্যের উপর

ভোটে জেতেন ধর্ষক নেতাও

ভোটের আগে পার্টির লোক আসে, কেউ দু’হাজার, কেউ তিন হাজার টাকা দেয়। গত বার এক পার্টি মোবাইল দিয়েছিল। যে পার্টি যা দেয় নিয়ে নিই। পছন্দের লোককে ভোট দিই— ভোটদাতা।

Advertisement

অশোক সরকার

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০৭
Share:

আমাকে ধর্ষণ করেছিল আমাদেরই এমএলএ। সঙ্গে আরও চার জন ছিল। তিন জন নির্যাতন করল, এক জন ছবি তুলছিল। অজ্ঞান অবস্থায় ঝোপে পড়েছিলাম। কে হাসপাতালে দিয়েছিল জানি না— মালতী।

Advertisement

নাম একটা আছে, সে নামে আমাকে কেউ চেনে না। সবাই ডাকে ‘ব্যাগম্যান’। আমার কাজ ভোটের পরে। এক জনের বাড়ি থেকে ক্যাশ টাকা ব্যাগে ভরি, আর এক জনের কাছে পৌঁছে দিই। কে কার সঙ্গে লেনদেন ঠিক করে, কেন করে, তা-ও জানি— ব্যাগম্যান।

ভোটের আগে পার্টির লোক আসে, কেউ দু’হাজার, কেউ তিন হাজার টাকা দেয়। গত বার এক পার্টি মোবাইল দিয়েছিল। যে পার্টি যা দেয় নিয়ে নিই। পছন্দের লোককে ভোট দিই— ভোটদাতা।

Advertisement

মন্ত্রীর নির্দেশে এমন অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, যা দেশের পক্ষে বিপজ্জনক। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক রীতিনীতি জলাঞ্জলি দিয়ে সেই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছি— আমলা।

প্রথমটি তামিলনাড়ুর এক মেয়ের কথা, দ্বিতীয়টি বিহারের। তৃতীয় ও চতুর্থটি কাল্পনিক সংলাপ, কিন্তু অবাস্তব নয়। চারটি আলাদা কথা, কিন্তু সেগুলি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি বিশেষ দিক তুলে ধরে। ধর্ষণে অভিযুক্ত নেতা বিরল নয়, বিরল হল সমাজের ধিক্কার। বিধায়ক ধর্ষণে অভিযুক্ত হলে মানুষ প্রকাশ্যে কৈফিয়ত চাইছেন, উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, এমন কোথাও ঘটছে কি? যাঁদের ভোট তিনি পেয়েছেন, যাঁদের ভোট পাননি, কোনও পক্ষ থেকেই জবাবদিহির দাবি ওঠে না।

তেমনই, কখনও কি শুনেছেন নির্বাচনের আগে টাকা বিলি করতে গিয়ে রাজনৈতিক কর্মীরা জনতার প্রতিবাদের মুখে পড়েছেন, তাঁদের পাড়া থেকে ভাগিয়ে দিয়েছে পাবলিক? সকলে প্রতিবাদ না-ই করুন, দশ শতাংশ মানুষই কি করেছেন?

বিধায়ক বা সাংসদ কেনা-বেচা আজ জলভাত। দলের ‘ব্যাগম্যান’রা নিখুঁত ভাবে কাজটি করেন। এঁদের কেউ সে কথা কোনও রিপোর্টারকে ‘লিক’ করেছেন, বা নিজেই লুকিয়ে ছবি তুলে ফাঁস করেছেন, এমন শোনাই যায় না। কিছু সাংবাদিক ‘ব্যাগম্যান’ সেজে স্টিং অপারেশন করেছেন, ব্যাগম্যানেরা কখনও কিছু করেননি। তেমনই, ছোট-বড় আমলারা বহু কুকর্মের সাক্ষী। রাফাল বিমান নিয়ে ক্যাগের বিচিত্র রিপোর্ট, নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক নানা সিদ্ধান্ত, প্রতিটা ক্ষেত্রে আমলারা ভিতরের খবর জানতেন। প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই কেউ মুখ খোলেননি।

পরিচিত দুষ্কৃতী কেন ভোট পায়? কেন জালিয়াতির দায়ে নেতা ধরা পড়লে কারও হেলদোল থাকে না? সাংসদ-বিধায়করা নির্বাচনের পরে দল বদল করলে ভোটদাতারা কেন প্রতিবাদ করেন না? দল ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত নিলে কেন কোনও নেতা জনসমক্ষে দ্বিমত প্রকাশ করেন না?

একটা চেনা উত্তর হল, এ দেশে জনতার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের সম্পর্কটা নাগরিক ও প্রতিনিধির নয়, দেনা-পাওনার। হিসেব ঠিক থাকলে নেতার চরিত্র বা কাজ নিয়ে মানুষ মাথা ঘামান না, হিসেব বিগড়ে গেলে তখন মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেন।

আরও কিছু আপাত-উত্তর আছে। যেমন, দলের বিরুদ্ধে কথা বললে দল থেকে বহিষ্কার করা হতে পারে। কথাটা ঠিক, কিন্তু সকলের তো সে ভয় নেই। সাংসদ কেনাবেচা হলে দলীয় কর্মীরা বা ভোটদাতারা চেঁচান না কেন? তেমনই, মানুষ গরিব বলে ভোটের আগে বিলি করা টাকা ফেরাতে পারেন না, তা বোঝা গেল। কিন্তু যিনি ভোটের আগে টাকা নিয়েছেন, নির্বাচিত নেতার কুকর্ম দেখে চুপ করার দায় তো তাঁর নেই। ব্যাগম্যান টাকার ভাগ পান বলে মুখ খোলেন না। কিন্তু দীর্ঘ দিন পরেও কি সত্যিটা বলতে মানা?

এই সব উত্তরকে অস্বীকার না করলেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। মনে করুন বিলেতের রাজনৈতিক দলের কথা। সেখানে রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা দলের সিদ্ধান্ত, বা (দল ক্ষমতাসীন হলে) সরকারের সিদ্ধান্ত খোলাখুলি ভাবে সমালোচনা করেন। দলের প্রতি বা নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখেও তা করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বা কানাডাতেও তাই। সেখানে দলের কোনও একটা সিদ্ধান্তের সঙ্গে দলের কোনও নেতা জনসমক্ষে অমত পোষণ করলে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না। কিন্তু এ দেশে হয়। দলের ভিতরে যদি বা সমালোচনা করা যায়, প্রকাশ্যে নয়।

অথবা ধরা যাক সেই ছোট-বড় আমলাদের কথা, যাঁরা প্রশাসনে অনৈতিক কার্যকলাপের সাক্ষী। তাঁরা চুপ করে থাকেন কেন? শুধু শপথরক্ষার তাগিদে, কিংবা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অভাবে? ভারতের প্রশাসনের সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে করে ট্রাম্পের প্রশাসনের। গত চার বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমলাদের পদত্যাগ বা বহিষ্কারে এক রেকর্ড গড়েছে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে নীতিগত আপত্তি জানানোর জেরে বিদায় নিয়েছেন এঁদের একটি বড় অংশ, এবং তাঁদের অনেকেই মার্কিন কংগ্রেসের সামনে মন খুলে কথা বলেছেন।

এ দেশ কেন আলাদা? একটা সম্ভাব্য উত্তর, যাকে আমরা ‘রাজনৈতিক’ বলছি তা আসলে ‘সাংস্কৃতিক’, সেখানে আচারটাই মুখ্য। ভোট দেওয়া, ভোট কেনা, নির্বাচিত সাংসদ-বিধায়ক কেনাবেচা, এ সবই নির্বাচনী আচারের মধ্যে পড়ে। সংসদ-বিধানসভায় চিৎকার করা, অন্যকে কথা বলতে না দেওয়া, সে-ও আচার। আচার পালন করতে হয়, বুঝতে হয় না। ভাবা হয়েছিল, লোকসভা-রাজ্যসভার ভিডিয়ো সম্প্রচার হলে প্রতিনিধিদের আচরণ বদলাবে। তা আদৌ হয়নি, তা এই কারণেই। রাজনৈতিক মঞ্চের অভিনেতা ও দর্শক, দু’জনেই যার যার আচার পালন করে চলেছেন। ভারতে মানুষ কেন ভোট দেন, তার কয়েকটি গবেষণায় সেই ইঙ্গিত মিলেছে।

আর একটা উত্তর মেলে সামাজিক মনস্তত্ত্ব থেকে। আমাদের সামাজিক সংস্কৃতিতে ‘পাবলিক কনফেশন’ বা জনসমক্ষে দোষ স্বীকার করার কোনও স্থান নেই। “আমি ব্যাগম্যান হিসেবে অনেক সাংসদ কেনাবেচায় অংশ নিয়েছি, আমার বিবেক তাতে সায় দেয়নি, আমি দুঃখিত”, কিংবা “কর্মজীবনে সরকারের অনেক কুকর্মের শামিল হওয়াতে বিবেকের দংশনে জ্বলেছি, কিন্তু কিছু করতে পারিনি”, ‘‘আমার নেতা মালতীকে ধর্ষণ করেছে জেনেও তাঁকে ভোটে জেতানোর জন্য কাজ করেছি, নিজের ওপর ঘেন্না হয়’’, এমন কথা শোনা প্রায় অসম্ভব। আমাদের সংস্কৃতিতে নিজের দোষ স্বীকার করলে পাপ আরও জোরালো হয়, মানুষ আরও ছোট হয়। খ্রিস্টানদের সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির এটা একটা বড় তফাত। তাদের সমাজে অকপট স্বীকারোক্তির মূল্য আছে। আমরা স্বীকারোক্তিকে সততা ও অনুশোচনার প্রকাশ বলে মনে করি না।

আর যুক্তির দিক? ‘দলের (বা সরকারের) অমুক কাজটা আমি ঠিক মনে করি, আর তমুক সিদ্ধান্ত আমি সমর্থন করি না’, যুক্তির এই সাধারণ নিয়ম আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে চলে না। তাতে সেই মানুষটিকে সুবিধাবাদী মনে করা হয়। পূর্ণ সমর্থন চাই, নচেৎ সম্পূর্ণ বিরোধিতা চাই। সেটাই নাকি নীতিবোধের পরিচয়! এর কারণটাও আমাদের বোধ হয় সমাজের গভীরে নিহিত। এ দেশে মানুষের নীতিবোধ দাঁড়িয়ে রয়েছে ভক্তি এবং আনুগত্যের উপর। যুক্তির উপরে নয়, সংশয়ে তো নয়ই। জনসমক্ষে প্রশ্ন তুললে তাকে আনুগত্যের অভাব মনে করা হয় এখানে। প্রশ্ন করা মানেই বিরোধিতা করা। এটা লোকাচারের ক্ষেত্রে যেমন সত্যি, তেমন রাজনীতির ক্ষেত্রেও।

বিজেপি তো আরও এক পা বাড়িয়ে বলছে যে প্রশ্ন করা মানে শুধু আনুগত্যের অভাব বা নৈতিক বিরোধিতা নয়, একেবারে দেশদ্রোহিতা। তারা রাজনৈতিক সংস্কৃতির কেন্দ্রে আনতে চাইছে প্রশ্নহীন আনুগত্যকে। এর বিপদ বুঝতে পারছেন বিরোধীরা, কিন্তু ‘লিবারাল’ নেতারাও কি এত দিন রাজনীতিতে আচার, আনুগত্য, ভক্তিকেই প্রাধান্য দেননি?

ব্যক্তির ন্যায়-অন্যায়ের বোধের সঙ্গে তার রাজনীতির সংযোগ কবে আর ঘটবে এ দেশে?

আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়। মতামত ব্যক্তিগত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement