JNU

শিশুরাও আজ জেনে গিয়েছে

শাহিনবাগের প্রতিরোধ আন্দোলনে মেয়েদের এবং বাচ্চাদের অংশগ্রহণের ধরন থেকে একটা কথা পরিষ্কার যে, এ দেশে মেয়েরা এবং বাচ্চারা আর শুধু অত্যাচারের শিকার নয়, তাঁরা অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম প্রতিরোধ শক্তি।

Advertisement

দোলন গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২০ ০০:২৯
Share:

পনেরো ডিসেম্বর থেকে আজ পর্যন্ত শাহিনবাগের মেয়েরা নয়া নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে ও জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে পথে ধর্নায় বসে আছেন। দিল্লির রেকর্ড ঠান্ডাও ওঁদের রাস্তা থেকে সরাতে পারেনি। অশীতিপর বৃদ্ধা থেকে কুড়ি দিনের বাচ্চা কোলে তরুণী রাস্তায় বসে আছেন। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাধারণ মানুষ ওঁদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন। এলাকার মানুষ কেউ কম্বল নিয়ে এসেছেন, কেউ বিরিয়ানি আর চা, কেউ বা আগুন জ্বালানোর কাঠ। ডাক্তারবাবুরা মেডিক্যাল ক্যাম্প খুলে বসেছেন স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে। মেয়েরা বলছেন, কেন একটি নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষকে লক্ষ করে এমন বৈষম্যমূলক আইন চালু হবে?

Advertisement

শাহিনবাগের প্রতিরোধ আন্দোলনে মেয়েদের এবং বাচ্চাদের অংশগ্রহণের ধরন থেকে একটা কথা পরিষ্কার যে, এ দেশে মেয়েরা এবং বাচ্চারা আর শুধু অত্যাচারের শিকার নয়, তাঁরা অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের অন্যতম প্রতিরোধ শক্তি। ভারতের শাসক ‘বেটি বঁাচাও, বেটি পড়াও’ স্লোগানের মাধ্যমে এ দেশের মেয়েদের যে ‘বেচারা’মার্কা ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চান, প্রধানমন্ত্রী যে ভাবে নিজেকে দেশের ‘অবলা’ নারীজাতির উদ্ধারকর্তা হিসেবে আত্মপ্রচার করেন, তাতে সপাট থাপ্পড় এই আন্দোলন। এই সরকারের দ্বিচারিতা ভূতপূর্ব সব সরকারকে হার মানিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার সত্যিই নারীদরদি হলে ধর্না তুলে দেওয়ার জন্য পুলিশ বা গুন্ডাবাহিনী না পাঠিয়ে, শাহিনবাগে এসে দাবিগুলি শুনতেন।

লক্ষণীয়, শাহিনবাগের মেয়েদের বেশির ভাগ মুসলিম। রাস্তায় বসে রাতের পর রাত জাগছেন তাঁরাই, যাঁরা অনেকেই কখনও নাইট শো-তে সিনেমা দেখেননি, জীবনে একা বাজার যেতে পারেননি। যে মুসলিম মেয়েদের তাঁদের সম্প্রদায়ের পুরুষের হাত থেকে ‘রক্ষা করার জন্য’ মোদী-শাহের রাতে ঘুম হচ্ছিল না, আজ সেই তরুণীরা কোলে বাচ্চা নিয়ে, দিদিমারা শীতে কাঁপতে কাঁপতে সরকারের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছেন। এই মেয়েরা এক মুহূর্তের জন্য নিজেদের হাত থেকে আন্দোলনের লাগাম ছাড়েননি। কোনও রাজনৈতিক দাদা, বিরোধী পক্ষ, এনজিও, এমনকি নারী আন্দোলনের নেত্রীদেরও আন্দোলন হাইজ্যাক করতে দেননি। নারী আন্দোলনের এর থেকে বড় সাফল্য আর কী হতে পারে!

Advertisement

অবধারিত সমালোচনা কানে আসছে। ঘর-সংসার ছেড়ে যাঁরা পথে বসে আছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই মা। কেউ সদ্যোজাতের মা। অনেকে বলছেন, মেয়েরা বসুক, কোলের বাচ্চাকে শীতে কষ্ট দেওয়া কেন? কিন্তু মায়েরা কী করবেন! দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে! বাচ্চাদের জন্যই তাঁরা আতঙ্কিত। বাচ্চার স্বার্থেই মা-কে ধর্নায় বসতে হয়েছে।

আর, শাহিনবাগে যে বাচ্চারা ছুটে ছুটে মা-বাবা, পিসি-মাসিদের সঙ্গে নানা কাজে ব্যস্ত, যারা জানে এবং মানে, ‘এখন বায়না করার সময় নয়’, ‘এখন যা পাওয়া যায় তা-ই খেয়ে নিতে হয়’, তারাও এই প্রতিরোধের সচেতন অংশীদার। শিশু হলেও তাদের বোধের ওপর আমাদের ভরসা রাখতে হবে। তারাও ধর্নায় বসেছে, ধর্নামঞ্চে নিজেদের মতো করে ‘আজাদি’ বুঝে নিয়েছে— ঠিক কি ভুল, সে বিচার এখানে গৌণ। কিন্তু যখন বড়রা ঠান্ডায় ঝিমিয়ে পড়ে, আর বাচ্চারা উঠে মাইকে ‘ইয়ে বাচ্চা মাঙ্গে আজাদি’ স্লোগান দেয়, তখন তাদের ‘অবুঝ’, ‘শিখিয়ে দেওয়া বুলি আওরাচ্ছে’ বলে ছোট করে দেখা অত্যন্ত অন্যায়।

যে সুরক্ষিত নাগরিকবর্গ, শিশু-অধিকারকর্মী বাচ্চাদের এই মঞ্চে শামিল করার বিপক্ষে, তাঁদের মনে রাখা দরকার বাচ্চার কোনও একমাত্রিক পরিচিতি হয় না। বাচ্চাদের মধ্যেও ভেদাভেদ আছে, সে কথা বাচ্চারাও বিলক্ষণ জানে! উচ্চবর্ণের পরিবারের বাচ্চার সঙ্গে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাচ্চার, দলিত ঘরের বাচ্চার, শ্রমিক-কৃষকের বাচ্চার, ভিন্ন যৌন পরিচিতির বাচ্চা, প্রতিবন্ধী বাচ্চার, ফুটপাতবাসী বাচ্চার অবস্থান ও অবস্থাগত পার্থক্য আছে। বিরাট দুর্ভাগ্য হলেও শাহিনবাগের যে বাচ্চাগুলি মঞ্চে স্লোগান দিচ্ছে, তারা ঠিক বুঝতে পারছে যে এ দেশের নতুন আইনে তাদের হয়তো এত দিনের চেনাশোনা বাড়ি ছেড়ে কোনও অজানা শিবিরে চলে যেতে হবে। কাশ্মীরে যে বাচ্চাদের বাড়ি থেকে তুলে উধাও করে দেওয়া হচ্ছে, তারা কি জানে না, এ দেশের পুলিশ-মিলিটারির মানে কী? তাই শিশুদের ‘অধিকার’ কী ভাবে নষ্ট করা হচ্ছে, সেটা না ভেবে আমরা বরং এটাই ভাবি যে আজ শিশুদের মনে দেশের রাজনীতি আর দেশ সম্পর্কে ঠিক কী বোধ জমা হচ্ছে। সেই বোধ ভাল কিছু নয় নিশ্চয়। মোদী ও শাহের চেষ্টায় যা ঘটছে, তাতে মেয়েদের, ছাত্রদের, বাচ্চাদের, সাধারণ মানুষের ভাবনার ও বেঁচে থাকার অধিকারই নস্যাৎ হচ্ছে। ওঁরা কখনও ছাত্রদের বলছেন ‘ক্যানন ফডার’, কখনও শাহিনবাগের মেয়েদের বলছেন বিরোধী রাজনৈতিক দলের ঘুঁটি। মানুষকে তাঁরাই আসলে ঘুঁটি বানিয়ে দিচ্ছেন।

শাহিনবাগ থেকে জামিয়া, জেএনইউ— এই মেয়েরা নাগরিক তো বটেই, রক্তবীজের ঝাড়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement