Opportunity Cost

বিকল্পের খেসারত ও রাজনীতি

ভারতে শিক্ষিত মানুষরা উঠতে-বসতে রাজনৈতিক নেতাদের তুলোধনা করেন; অর্থনীতিবিদ আর সমাজবিজ্ঞানীরা বিবিধ তত্ত্ব রচনা করেন রাজনীতিকদের দুর্নীতিপ্রবণতা ও অন্যান্য ব্যাধি নিয়ে।

Advertisement

সুগত মারজিৎ

শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:০৫
Share:

অপরচুনিটি কস্ট’ শব্দটার সঙ্গে যদি পরিচয় না-ও থাকে, ধারণাটির সঙ্গে বিলক্ষণ পরিচয় আছে আমার-আপনার সকলেরই। ধরুন, কোনও একটি মুহূর্তে আপনার পক্ষে দু’টি কাজের মধ্যে যে কোনও একটি করা সম্ভব— প্রথম কাজটি করলে পাবেন ৫,০০০ টাকা; দ্বিতীয়টিতে ১,০০০ টাকা। অতি বিশেষ কোনও কারণ না-থাকলে আমরা প্রত্যেকেই প্রথম কাজটিকে বাছব। এবং, ঠিকই করব— ১,০০০ টাকার চেয়ে ৫,০০০ টাকা সব সময় ভাল। এর মধ্যে অপরচুনিটি কস্ট বা ‘বাছাইয়ের খেসারত’ কোথায়? এই যে, প্রথম কাজটি বাছা মানে দ্বিতীয় কাজটিকে না-বাছা, এবং তার থেকে ১,০০০ টাকা রোজগারের সুযোগ হারানো— অর্থাৎ, প্রথম কাজটির বাছাইয়ের খেসারত হল দ্বিতীয় কাজটি থেকে সম্ভাব্য আয়ের পরিমাণ, ১,০০০ টাকা; এবং, দ্বিতীয় কাজটির বাছাইয়ের খেসারত হল ৫,০০০ টাকা। যে বিকল্প বাছাইয়ের খেসারত সবচেয়ে কম, সেটাকে বাছাই যুক্তিযুক্ত কাজ, এটা বোঝার জন্য অর্থশাস্ত্রের ছাত্র হওয়ার প্রয়োজন নেই, কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট।

Advertisement

ভারতে শিক্ষিত মানুষরা উঠতে-বসতে রাজনৈতিক নেতাদের তুলোধনা করেন; অর্থনীতিবিদ আর সমাজবিজ্ঞানীরা বিবিধ তত্ত্ব রচনা করেন রাজনীতিকদের দুর্নীতিপ্রবণতা ও অন্যান্য ব্যাধি নিয়ে। আমরা সবাই নিজের মতো করে ‘দেশের ভাল’ চাই। কিন্তু, পেশাদার হিসাবে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত মানুষদের মধ্যে প্রায় কেউই প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে চান না। এঁদের যে ক্ষমতার লোভ নেই, তা বলা যাবে না। কিন্তু সেই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে গেলে এবং সত্যি সত্যি প্রতি দিন জনগণের উপকারের জন্য কাজ করতে গেলে এত বেশি খেসারত দিতে হবে যে, তাঁরা সে কাজটি করতে চান না। রাজনীতির দৈনন্দিন কাদা ঘাঁটাঘাঁটি করতে গেলে যা ক্ষতি হবে, তার বিনিময়ে প্রত্যাশিত লাভের সম্ভাবনা সফল পেশাদারদের ক্ষেত্রে খুবই কম হতে পারে। অর্থাৎ, তাঁদের কাছে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার ‘বিকল্পের খেসারত’ বেশ চড়া। অন্য দিকে, যাঁদের হারাবার তেমন কিছু নেই, রাজনীতির থেকে প্রাপ্য সম্ভাব্য যে কোনও লাভই তাঁদের কাছে আকর্ষণীয়, কারণ তাঁদের কাছে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার বিকল্পের খেসারত অতি সামান্য। ফলে তাঁরা রাজনীতি করেন।

আদর্শের জন্য মানুষ কখনও আত্মত্যাগ করে না, সে কথা নিশ্চয়ই ঠিক নয়। কিন্তু, অন্তত বর্তমানে সেটা ব্যতিক্রম। নিয়ম হল, শিক্ষিত পেশাদারদের পক্ষে রাজনীতিতে যোগ দেওয়া তাঁদের অর্থনৈতিক স্বার্থবিরোধী— এমনকি, তাঁরা অত্যন্ত সফল ভাবে রাজনীতি করতে সক্ষম হলেও— ফলে তাঁরা প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন, এবং রাজনীতিকদের গালিগালাজ করেন। এটা আসলে আমাদের ভণ্ডামি।

Advertisement

এক ভাবে দেখতে গেলে, যে কোনও পেশায় শিক্ষার পর, বিভিন্ন ধরনের শিক্ষানবিশি, ট্রেনিং এবং কর্মপ্রসূত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে উত্তম-অধমের বিচার হয়। এক ধরনের আত্মত্যাগ সেখানেও থাকে। সে জন্যই হয়তো সাফল্যের ভেদাভেদ নির্ধারিত হয়, সেটা যে পেশাই হোক না কেন। রাজনীতিও ব্যতিক্রম নয়। শুধু পরিসরগুলো অর্থাৎ কী ভাবে নেতানেত্রী সংগ্রাম করে এসেছেন, কী ভাবে দলের মধ্যেই অন্য অনেককে টপকে যাওয়ার ক্ষমতা অর্জন করছেন, কী ভাবে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করছেন, কেন মানুষ অন্যদের চেয়ে তাঁদের পছন্দ করেন— এই সব নিয়ে ভাবনাচিন্তা করলে আমাদের ক্রোধের প্রতিফলন আর একটু সংযত হতে পারে। এ দেশে এখন কেন্দ্রে যে সরকার শাসন করছে, তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে বা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে অনেক সময় সঠিক ব্যবহার করেনি। বিরুদ্ধ মতামতকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে শাসনযন্ত্রের মাধ্যমে। কিন্তু, শিক্ষিতমহলের বিপুল সমালোচনার পরও তারা এখনও ক্ষমতাসীন, খানিকটা দুর্বল হলেও। মানুষদের সিদ্ধান্তের উপর ভর করে পর পর তিন বার শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করছেন। কেউ বলতেই পারেন যে, সুচেতন, সচেতন এবং প্রাজ্ঞ সমালোচনার তেমন কোনও দাম নেই সাধারণ মানুষের কাছে। খানিকটা একই অবস্থা এ রাজ্যেও। দুর্নীতির ফলে কারারুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা। কিন্তু সাধারণ মানুষের সমর্থনে কতটা ঘাটতি দেখছি আমরা?

একটা কথা সাধারণ মানুষ হয়তো বোঝেন যে, সমালোচকরা— তিনি যে-ই হোন না কেন— রাজনীতিতে এসে মানুষের উপকার করার জন্য যে দায়িত্ব পালনের প্রয়োজন, তার জন্য খেসারত দিতে কখনও প্রস্তুত নন। সমালোচকদের পৃথিবী আর সাধারণ মানুষদের পৃথিবীর মধ্যে ফারাক অর্থনৈতিক বৈষম্যের জন্য বেড়ে চলেছে। সেটাও একটি কারণ। তবে সব পেরিয়ে রাজনীতির চত্বরে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির প্রয়োজন গগনমুখী। দূরে দাঁড়িয়ে থাকলে সেই দায়িত্ব সামলানো যাবে না। আর তার জন্য খেসারত দিতেই হবে। তা না হলে আমাদের নাম ও মুখের পরিচিতি ছাড়া আমাদের সমালোচনা রাজনৈতিক ভাবে কোনও দিনই তেমন গুরুত্বপূর্ণ হবে না। হয়তো আমরা সেটাই চাই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement