প্রতীকী ছবি।
ভোটের দামামার মধ্যে ঘোষিত হল জাতীয় পুরস্কারের তালিকা। সামাজিক সমস্যা-বিষয়ক শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের খেতাব পেল মরাঠি ছবি আনন্দী গোপাল। প্রথম মহিলা ডাক্তার আনন্দীবাই জোশীর সত্যনিষ্ঠ বায়োপিক। পরিচালক সমীর বিদ্বংস।
মহারাষ্ট্রের কল্যাণের আনন্দীবাইয়ের চোদ্দো বছরে মা হওয়া, চিকিৎসার সুযোগের অভাবে সন্তান হারানো এবং পরে তাঁর চিকিৎসক হওয়ার সিদ্ধান্ত— এই অবিশ্বাস্য জীবনলেখকেই তথ্যানুগ ভাবে তুলে ধরেছেন পরিচালক। মরাঠিতে লেখা শ্রীকৃষ্ণ জনার্দন জোশীর আনন্দী গোপাল ও ক্যারোলিন হিলি ডাল রচিত দ্য লাইফ অব ডা. আনন্দীবাই জোশী অবলম্বনে ছবিটি নির্মিত। মাত্র আঠারোয় ইংল্যান্ড পাড়ি দেন আনন্দীবাই, শুধু চিঠির মাধ্যমে পরিচিত থিয়োডিসিয়া কার্পেন্টারের ভরসায়। সব বাধা পেরিয়ে, ১৮৮৬-র ১১ মার্চ ডাক্তারি পাশ করেন। কিছু দিন পর কলকাতায় ডাক্তারি পাশ করেন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়।
ছবিটি শেষ হয় আনন্দীবাই দেশে ফেরার পরেই। দেখানো হয় না, দেশে ফেরার কয়েক মাস পরেই যক্ষ্মায় অকালমৃত্যু হয় তাঁর। তাই ডাক্তারি প্র্যাকটিস করতে পারেননি। প্রথম প্র্যাকটিসিং মহিলা ডাক্তার হন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু দ্বিতীয় প্র্যাকটিসিং মহিলা ডাক্তার কে? রুকমাবাইয়ের নাম ক’জন জানেন? তিনি শুধুই দ্বিতীয় প্র্যাকটিসিং মহিলা ডাক্তার নন। তিনিই প্রথম মহিলা, যিনি ডাক্তারি শিক্ষার খরচ তুলতে সবার থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। নারীবাদের ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে ১৮৮৫-র ব্যতিক্রমী মামলার জন্য। তিনি স্বামীর সঙ্গে না থাকার অধিকার দাবি করেন। ইংরেজ আদালত সেই অধিকারে স্বীকৃতি না দিলে কারাবাসের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কারাবাসের শেষে ‘ক্রাউড ফান্ডিং’-এর অর্থে ডাক্তারি পড়তে বিদেশে যান।
এই মামলা সম্পর্কিত একটি বই আছে। সুধীর চন্দ্রের এনস্লেভড ডটারস: কলোনিয়ালিজ়ম, ল’ অ্যান্ড উইমেনস রাইটস। আনন্দীবাই সম্পর্কেও একটি বা দু’টি বই আছে। আছে মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাদম্বিনী গাঙ্গুলি: দি আর্কিটাইপাল উয়োম্যান অব নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি বেঙ্গল, গবেষক সুনন্দা ঘোষের চন্দ্রমুখী বসু: আ পায়োনিয়ারিং ডটার অব ইন্ডিয়া, ১৮৬০-১৯৪৪। ব্যস? নারীবাদের ‘আইকন’ মানুষগুলির জীবনালেখ্যর সংখ্যা এত নিরাশাব্যঞ্জক, এত অপ্রতুল?
কয়েক বছর আগে, অনন্ত মহাদেবন রুকমাবাইকে কেন্দ্র করে হিন্দি ছবি পরিচালনার কথা ঘোষণা করেন। শোনা যায়, বিদ্যা বালন কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ে স্বীকৃত হন। এই সময় পরিচালক ভুলবশত বলে ফেলেন যে, রুকমাবাই প্রথম মহিলা প্র্যাকটিসিং ডাক্তার। আইনি সমস্যায় জড়িয়ে পড়ায়, সেই চলচ্চিত্রায়ণ সম্ভব হয় ২০১৭-য়। কিন্তু ছবিটি হয় আঞ্চলিক ভাষা মরাঠিতে, নামভূমিকায় তন্নিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়। ছবিটি প্রাপ্য প্রচার থেকে বঞ্চিত হয়।
প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট চন্দ্রমুখী না কাদম্বিনী, প্রথম মহিলা ডাক্তারের শিরোপা কার— প্রশ্নগুলি ইতিহাসের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়েও প্রয়োজনীয় বিষয়, চন্দ্রমুখী, কাদম্বিনী, আনন্দীবাই, রুকমাবাইয়ের সম্মিলিত এই যাত্রা আর তার এক অভিজ্ঞতালেখ রাখা। সেই কাজে এত ঘাটতি কেন?
পুরস্কারপ্রাপ্ত বই ইনভিজ়িবল উইমেন: এক্সপোজ়িং ডেটা বায়াস ইন আ ওয়ার্ল্ড ডিজ়াইনড ফর মেন-এ ক্যারোলিন ক্রিয়াদো পেরেজ় বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা প্রযুক্তিগত নির্মাণের ক্ষেত্রে মহিলাসংক্রান্ত তথ্যের অনুপস্থিতি বা ফাঁক লক্ষ করেছেন। একেই বলেছেন ‘ইনভিজ়িবল উইমেন’। যেমন, ওষুধ বা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বাজারে আসার আগে ট্রায়াল অধিকাংশই পুরুষদের শরীরে হয়। ফলে মহিলাদের শারীরিক গঠনে সেই ওষুধের নেতিবাচক প্রভাব আছে কি না— তথ্যের ফাঁক থেকে যায়। প্রযুক্তিগত নির্মাণের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অধিকাংশ জিনিসই মহিলাদের জন্য কমসুরক্ষিত, শুধু এই তথ্যের ফাঁকের কারণে।
ঐতিহাসিক গবেষণার ক্ষেত্রেও একই ফাঁক লক্ষ করেছেন অ্যান্ড্রু কান আর রেবেকা অনিয়ন। ২০১৮’য় তাঁদের সমীক্ষা জানায়, প্রত্যেক বছর ইংরেজিতে প্রকাশিত ও বিক্রীত ঐতিহাসিক গ্রন্থের মাত্র ২৩% মহিলাদের রচনা। রচিত ও প্রকাশিত ঐতিহাসিক জীবনীর মাত্র ২৮% মহিলাদের নিয়ে, এবং অধিকাংশ মহিলাদেরই রচনা। ২০১৫ সালে অ্যানি চিপোন্ডা ও জোহান ওয়াসেরম্যান বিভিন্ন দেশে স্কুলপাঠ্য বইয়ে মহিলা ঐতিহাসিক চরিত্রদের উল্লেখের বিষয়ে সমীক্ষা করেন। আমেরিকায় পাঠ্যবইয়ের ঐতিহাসিক চরিত্রের ৩% মহিলা, ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে তা ৬%। তাও অধিকাংশই পুরুষ চরিত্রের মা, স্ত্রী বা কন্যা হওয়ার নিরিখে উল্লিখিত।
তাই হয়তো আনন্দীবাইয়ের ছবি তৈরি হয় কষ্টেসৃষ্টে, রুকমাবাইয়ের ছবি মনোযোগ পায় না। যাঁদের নিয়ে অসংখ্য গ্রন্থ প্রণীত হওয়ার কথা, সেই কাদম্বিনী, চন্দ্রমুখী, তারাবাই শিন্ডেরা তাকিয়ে থাকেন মানবীবিদ্যার কোনও গবেষকের দিকে, তাঁদের কথা ভবিষ্যতের কানে বলে যাওয়ার জন্য।