সময়টা যেন কেবল জল মাপার: কোন আন্দোলনটা বড়, কোন অনশনটা ছোট। কলকাতা যখন রাত জাগছে ডাক্তারদের আন্দোলনে, ঠিক সেই সময় দিল্লির লাদাখ ভবনের বাইরে সোনম ওয়াংচুক ও তাঁর সঙ্গীরাও অনশনে পড়ে রইলেন— ষোলো দিন। অথচ কোনও উচ্চবাচ্য নেই, হল না। দিল্লি-সহ গোটা উত্তর ভারতের নাগরিক গোষ্ঠী ও পরিবেশ অধিকার আন্দোলনের কর্মীরা, আর বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কেউ কেউ মুখ খুলেছেন। এত বড় দেশ ভারত, কিংবা প্রতিবাদের মুখ বলে এত নামডাক বাঙালি জাতটার— কী হল তাদের?
না কি এ শুধু লাদাখিদের, ‘পাহাড়ি’দের ব্যাপার বলে? বাঙালি কি আদৌ চেনে লাদাখকে? কথা বলার সময় এক নিঃশ্বাসে সে জুড়ে দেয় ‘লেহ-লাদাখ’, আর মাঝেমধ্যে প্ল্যান ছকে: একটু বেশি ছুটি পেলে, পয়সা জমলে সে লাদাখ বেড়াতে যাবে। দেশের মধ্যেই একটা বিদেশ-বিদেশ ‘এগজ়োটিক’ অনুভব, এর বাইরে তার লাদাখ নিয়ে জ্ঞান নেই। ভাবনা তো নেই-ই। হ্যাঁ, সোনম ওয়াংচুক সম্পর্কে এটুকু জানা: থ্রি ইডিয়টস ছবিতে আমির খানের করা র্যাঞ্চো চরিত্রটা তো ওঁর ছায়াতেই! তা মেঘে মেঘে সে ছবিরও বয়স হল পনেরো। আসল র্যাঞ্চো কোন দাবিতে দিল্লিতে অনশনে বসেছেন, তা নিয়ে সে কেন মাথা ঘামাবে?
একটু ‘ক্রোনোলজি’ বুঝিয়ে দেওয়া যাক। ১ সেপ্টেম্বর শুরু হয় সোনম ও তাঁর সঙ্গী প্রায় শ’দেড়েক মানুষের ‘ক্লাইমেট মার্চ’, লেহ থেকে দিল্লি অভিমুখে। উদ্দেশ্য, রাজধানী পৌঁছে তাঁরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে তাঁদের চার দফা দাবির চিঠি দেবেন, আলোচনা চাইবেন। তা না হলে অনুমতি চাইবেন যন্তর মন্তরে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের। লাদাখ, হিমাচল প্রদেশ, পঞ্জাব, হরিয়ানা হয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর দলটা যে-ই পৌঁছল দিল্লি সীমান্তে, আটকাল দিল্লি পুলিশ। সেই এক গল্প: আন্দোলন, মিছিল, জমায়েত বারণ। প্রায় আশি জনকে আটক করে রাখা হল দিল্লির কয়েকটা থানায়, সত্তরোর্ধ্ব প্রতিবাদীও ছিলেন তার মধ্যে। তার পর দিল্লি হাই কোর্টের হস্তক্ষেপে মুক্তি, কিন্তু আসল কাজ সুদূরপরাহত: কেন্দ্রীয় সরকারের সময় নেই, কারও দেখাটি নেই। এর পরই লাদাখ ভবনে ৫ অক্টোবর থেকে অনশন শুরু সোনমদের, শুধু নুন আর জলটুকু খাওয়া। ষোলো দিন পর, গত ২১ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের চিঠি এসেছে, সরকার আলোচনায় বসতে রাজি, আগামী ৩ ডিসেম্বর।
অনশন উঠেছে, প্রতিবাদ নয়। ভুক্তভোগী লাদাখিরা জানেন, সরকারের সঙ্গে কথা আগেও হয়েছে, কাজ হয়নি। ২০১৯-এ জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা মুছে দেওয়ার পর লাদাখকে আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করে দেওয়া হল, অবহেলাও শুরু হল। কাশ্মীরে সম্প্রতি ভোট হয়ে গেল, লাদাখ সেই তিমিরেই। লাদাখিদের আজ পর্যন্ত কোনও আইনসভা নেই, সবেধন নীলমণি একটি সাংসদ আসন ছাড়া কোনও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নেই। তাই সোনমদের দাবি: লাদাখকে রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হোক, লেহ ও কারগিল জেলার আলাদা লোকসভা আসন হোক। ততোধিক জরুরি: সংবিধানে বলা ‘সিক্সথ শিডিউল’ প্রয়োগ করা হোক লাদাখে; গড়া হোক অটোনমাস ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল (এডিসি), অটোনমাস রিজনাল কাউন্সিল (এআরসি)— জনজাতিদের নিজস্ব প্রশাসনতন্ত্র, যেমন আছে মেঘালয় মিজ়োরাম অসম ত্রিপুরায়। এডিসি-র সদস্যেরা আইন তৈরি করতে পারেন নিজেদের জমি, জল, জঙ্গল কৃষি, স্বাস্থ্য, গ্রাম ও শহরের পুলিশব্যবস্থা নিয়েও। লাদাখিদের সিংহভাগ জনজাতি, কেন তাঁরা এ সুবিধা পাবেন না?
শাসনতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণের প্রশ্নটি সরাসরি জড়িয়ে লাদাখের পরিবেশ ও অর্থনীতির সঙ্গে। সোনমরা বলছেন, হিমালয়কে লাদাখিরা যে ভাবে চেনেন, দিল্লি (বা কলকাতাও) তা ঠাহরই করতে পারবে না। তাঁরা সামনে থেকে দেখছেন জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল: হিমবাহের তুরন্ত গলে যাওয়া। এক দিকে বন্যা হচ্ছে, অন্য দিকে লাদাখি কৃষক দেখছেন তাঁর জমিতে সেচের জল নেই। ও দিকে কেন্দ্রীয় সরকার গাদাগুচ্ছের প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে: হাইওয়ে, পাওয়ার প্রোজেক্ট, সামরিক পরিকাঠামো নির্মাণ। সোনমরা বলছেন, উন্নয়ন নিশ্চয়ই হোক, কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কোপে পড়া হিমালয়ের পরিবেশ ধ্বংস করে কখনওই নয়। চাই ‘সাসটেনেবল গ্রোথ’। লাদাখ অন্য রকম, লাদাখ ‘ইউনিক’, অন্য কোনও রাজ্যের মডেলে উন্নয়নে এখানে সমূহ বিপদ, উত্তরাখণ্ড মডেলে কদাচ ন!
রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব না থাকা মানে এই সব দাবিদাওয়া ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় বলার কোনও লোকই না থাকা। লাদাখিরা তাই রুদ্ধকণ্ঠ। এ দিকে জীবনও হতশ্বাস: এত সব উন্নয়ন হচ্ছে মানে কি তাঁরা কাজ পাচ্ছেন, স্থানীয় ব্যবসায়ীদের লাভ হচ্ছে়? আদৌ তা নয়। লাদাখে বেকারত্ব প্রবল। অথচ হিমালয়ের প্রকৃতি, পর্যটন থেকে শুরু করে তার ভৌগোলিক-সামরিক অবস্থান, সব দিক থেকেই কী অসম্ভব গুরুত্ব লাদাখের! এই সবই কাজে লাগানো যেত, একটু সহানুভূতি নিয়ে, লাদাখের মানুষের সঙ্গে কথা বলে কেন্দ্র উপযুক্ত পদক্ষেপগুলি করলে।
কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। সেই জন্যই সোনম ওয়াংচুকদের হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে দিল্লি আসতে হয়, পুলিশের হাতে আটক হতে হয়, অনশনে বসতে হয়। এর আগেও লেহ-র ঠান্ডায় অনশনে বসেছেন সোনমরা। এ বছর এপ্রিলে যেতে চেয়েছিলেন ‘পশমিনা মার্চ’-এ: পশমিনা পশমওয়ালা ভেড়া চরান যে মেষপালকেরা, তাঁদের চারণভূমি যে ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে ‘লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি)’ বরাবর চিন-ভারত উত্তেজনায়! সে বারও আটকে দেয় পুলিশ।
৩ ডিসেম্বরের তো এখনও দেরি। ‘জাস্টিস ফর লাদাখ’ বলবে না আসমুদ্রহিমাচল ভারত?