Indian Cricket

দরকার আছে, ওই তিনটে শব্দ লেখার আলবাত দরকার আছে

সিরাজ। মহম্মদ সিরাজ। যাঁর জন্ম এক ‘আনলাকি থার্টিন’-এ (১৩ মার্চ)। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের মহাকাশে উত্থান এক আশ্চর্য রূপকথার মতো।

Advertisement

অনিন্দ্য জানা

শেষ আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১০:১৪
Share:

তিনি হায়দরাবাদের ‘অটোরিকশ চালকের সন্তান’ মহম্মদ সিরাজ। ফাইল চিত্র।

‘অটোরিকশ চালকের সন্তান’ লেখাটা কি খুব দরকার ছিল! মাঠের পারফরম্যান্সের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক? বিলেতের মাঠে জনৈক সিরাজের পারফরম্যান্স সম্পর্কে প্রশংসাসূচক লেখার কথা বলতে গিয়ে কিছুদিন আগে সবজান্তা টুইট করেছেন বিখ্যাত ইংরেজ ক্রিকেটলিখিয়ে।

Advertisement

সিরাজ। মহম্মদ সিরাজ। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত এই সিরিজে ১৪টা উইকেট নেওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ওভালের কাব্যে প্রায় উপেক্ষিত। সিরিজে ২-১ আগুয়ান ভারতীয় দলের হাডলে যিনি দাঁড়িয়েছিলেন বিরাট উল্লম্ফনরত কোহলীর একেবারে পাশে, তিনি প্রথম ইনিংসে তা-ও একটা উইকেট পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে ঝোলা ফাঁকা। কিন্তু সেই তিনিই সবচেয়ে আগে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন ম্যাচ-জেতানো সতীর্থ ফাস্ট বোলার যশপ্রীত বুমরাকে। বস্তুত, এই লেখা বুমরার যশোগান গেয়েই লেখা হতে পারত। সম্ভবত উচিতও ছিল। হাজার হোক, বুমরার পারফরম্যান্স ঢেকে দিয়েছে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের বিতর্ককে। এই লেখা হতে পারত বিলেতের মাঠে ইংরেজদের বার্মি আর্মিকে লক্ষ্য করে হাতের মুদ্রায় অবজ্ঞার ট্রাম্পেট-ফোঁকা বিরাট কোহলীকে নিয়েও। অথবা ম্যান অব দ্য ম্যাচ রোহিত শর্মা। যিনি ধ্রুপদী আলস্যে দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরিটা করে ভারতীয় বোলারদের কাজটা তুলনায় সহজতর করে দিয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁরা আপাতত মহাকালের কুলুঙ্গিতে আপামর দেশবাসীর দ্বারা ফুলচন্দন পেয়ে পূজিত হতে থাকুন। এই সাপ্তাহিক কলাম বরং লেখা হোক জনৈক সিরাজকে নিয়ে। যিনি নিজামের শহর হায়দরাবাদের এক অখ্যাত অটোরিকশ চালকের সন্তান। এবং যিনি ওভালের কাব্যে খানিকটা উপেক্ষিত।

সিরাজ। মহম্মদ সিরাজ। যাঁর জন্ম এক ‘আনলাকি থার্টিন’-এ (১৩ মার্চ)। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটের মহাকাশে উত্থান এক আশ্চর্য রূপকথার মতো। ২০১৫ সালে যাঁর সত্যিকারের ক্রিকেট বলে বল করা শুরু (তার আগে ইস্কুলের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে টেনিসবল ক্রিকেট খেলে বেড়াতেন। ক্রিকেট খেলা শুরু করেছিলেন ক্লাস সেভেনে)। হায়দরাবাদের হয়ে রনজি ট্রফিতে দ্বিতীয় মরসুমেই ৯ ম্যাচে ৪১ উইকেট। তার পর অবশিষ্ট ভারত দলে। অতঃপর ভারত ‘এ’ দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। ২০১৭ সালেই আইপিএলে আড়াই কোটিরও বেশি টাকায় চুক্তিবদ্ধ হওয়া। তার কয়েকমাস পরেই দেশের জার্সি পরে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টি টোয়েন্টি ম্যাচে অভিষেক। আপাতদৃষ্টিতে যাঁর রান-আপ দেখে মনে হয় বাঁ-হাতি বোলার। কিন্তু আসলে ডানহাতে গোলার মতো ডেলিভারি করেন। আইপিএলে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর পরিচিত সাংবাদিককে বলেন, ‘‘এবার অন্তত আব্বা-আম্মিকে একটা ভাল বাড়িতে রাখতে পারব।’’

Advertisement

আইপিএলে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর পরিচিত সাংবাদিককে বলেন, ‘‘এবার অন্তত আব্বা-আম্মিকে একটা ভাল বাড়িতে রাখতে পারব।’’ ফাইল ছবি।

তিনি হায়দরাবাদের ‘অটোরিকশ চালকের সন্তান’ মহম্মদ সিরাজ। হে ইংরেজ ক্রিকেটলিখিয়ে, ওই তিনটি শব্দ লেখার দরকার আছে। কারণ, হায়দরাবাদের গলি তস্য গলি, ওই অটোরিকশ চালক বাবা আর তাঁর দীনহীন পরিবারই মহম্মদ সিরাজের শিকড়। মহম্মদ সিরাজ আসলে এক বদলের প্রতীক। কারণ, মহম্মদ সিরাজের কাহিনিটাই নায়কোচিত। কারণ, মহম্মদ সিরাজ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী কোটি কোটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং স্বপ্নদ্রষ্টা ভারতীয়ের জয়ধ্বজা।

কোনও এক আইপিএলে হায়দরাবাদে খেলতে-আসা কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের ব্যাটসম্যানদের নেটে বল করতে ডাকা হয়েছিল সিরাজকে। ঘটনাচক্রে, সেই নেটে তখন হাজির প্রাক্তন বোলার এবং বিরাট কোহলীর দলের ভবিষ্যৎ বোলিং কোচ ভরত অরুণ। নেটে বল করার ফাঁকেই ২০ বছর বয়সী সিরাজ সটান অরুণের কাছে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘স্যর, আপ থোড়া এনকারেজমেন্ট দে দো। দেখো ম্যায় কিতনা আগে যাতা হুঁ। জান দে দুঙ্গা স্যর!’’ সেই ভরত-সিরাজের মেন্টর-ছাত্র সম্পর্কের শুরু। যা ক্রমশ গড়িয়ে গিয়েছে এক দীর্ঘস্থায়ী দ্রোণাচার্য-অর্জুন সম্পর্কের পথে। ভরত ভারতীয় দলের সঙ্গে বিদেশসফর করছেন। ছাত্রের কাতর ফোন গিয়েছে তাঁর কাছে— ‘‘স্যর, অব উধার বুলা লো! অওর কিতনে দিন ইন্ডিয়া-এ খেলুঙ্গা!’’ এই বেশরম আকুতি, এই সাফ-সাফ আর্জি কনভেন্ট শেখায় না। শেখায় নিজের সম্পর্কে অর্জিত এবং অধীত আত্মবিশ্বাস। শেখায় ওই শিকড়— অটোরিকশ চালকের সন্তান হয়ে বেড়ে ওঠা।

মহম্মদ সিরাজ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী কোটি কোটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং স্বপ্নদ্রষ্টা ভারতীয়ের জয়ধ্বজা। ফাইল ছবি।

অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়েছেন। শুনতে পাচ্ছেন, বাবা অসুস্থ। শেষপর্যন্ত বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়েছেন। কিন্তু শেষকৃত্যে যোগ দেওয়ার জন্য দেশে ফিরে আসেননি। তাঁর মা-ও বলেননি দেশে ফিরতে। উল্টে বলেছিলেন, দেশের হয়ে পারফর্ম করতে। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে। আর ‘অটোরিকশ চালকের সন্তান’ সিরাজ বলেছিলেন, ‘‘বাবা ছিলেন আমার সবচেয়ে বড় সহায়। বাবার চলে যাওয়াটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি। বাবা চাইতেন, আমি যেন দেশের হয়ে খেলি। যেন দেশকে ক্রিকেট মাঠে জেতাই। এখন থেকে যতবার দেশের হয়ে খেলব, বাবার সেই ইচ্ছে পূরণ করার জন্যই খেলব।’’ অটোরিকশ চালকের সন্তান!

দূর বিদেশে বাবার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর সিরাজকে পক্ষপুটে নিয়েছিলেন ভারতের ফিল্ডিং কোচ শ্রীধর এবং ব্যাটসম্যান হনুমা বিহারি। একে তো হায়দরাবাদি বেরাদরি। তার উপর হনুমা ছিলেন ২০১৫ সালে সিরাজের রনজি ট্রফি অভিষেকের সময় তাঁর প্রথম অধিনায়ক। হনুমা অনর্গল সিরাজের সঙ্গে বসে হায়দরাবাদের জীবনের গল্প করতেন। শ্রীধর সারা রাত ধরে অগুন্তি ভিডিও কল করতেন। এটা দেখতে যে, সিরাজ ঠিকঠাক ঘুমোচ্ছেন তো? সময়মতো জল খাচ্ছেন তো? কারণ, তাঁর ভয় ছিল, পিতৃবিয়োগের শোকে কান্নাকাটি করে সিরাজ না নিজেকে ক্লান্ত করে ফেলেন। বাবার মৃত্যুর পরদিন সিরাজকে প্র্যাকটিস থেকে ছুটি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গোটা ভারতীয় দল অবাক হয়ে দেখেছিল, সিরাজ মাঠে পৌঁছে গিয়েছেন। নেটে বল করতে যাওয়ার আগে হেড কোচ তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘‘দেখ্, তেরা আব্বা কা দুয়া তেরে সাথ হ্যায়। কঁহি না কঁহি তু টেস্ট ম্যাচ খেলেগা ইস ট্যুর পে। অওর পাঁচ উইকেট ভি লেগা।’’ রবি শাস্ত্রীর ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যে হয়নি। পাঁচ উইকেট নিয়ে দু’হাত আকাশে তুলে মেঘের দিকে তাকানো সিরাজের ছবি সম্ভবত ক্রিকেট-বীরত্বের ইতিহাসে অন্যতম গভীর মুহূর্ত তৈরি করেছিল। পাশাপাশি সম্ভবত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতিও দিয়েছিল— দেখুন, আমি কোথা থেকে কোথায় এসে পৌঁছেছি।

দূর বিদেশে বাবার মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর সিরাজকে পক্ষপুটে নিয়েছিলেন ভারতের ফিল্ডিং কোচ শ্রীধর এবং ব্যাটসম্যান হনুমা বিহারি। ফাইল ছবি।

অটোরিকশ চালকের সন্তান। হে ইংরেজ ক্রিকেটলিখিয়ে, ওই তিনটি শব্দ আলবাত লেখার দরকার আছে!

অস্ট্রেলিয়ার মাঠে গ্যালারি থেকে উড়ে-আসা বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য শুনে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রথমে বুঝতে পারেননি। বিরতিতে ড্রেসিংরুমে গিয়ে বন্ধু শ্রীধরকে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘পতা নহি কেয়া ইয়ে লোগ বোল রহে হ্যায় মিঁয়া। ফিল্ডিং নহি করনে দেতে হ্যায়।’’ পরে কান পেতে শোনেন বর্ণবিদ্বেষী কটূক্তি আসছে। কালক্ষেপ না করে রোহিত শর্মাকে গিয়ে বলেছিলেন সিরাজ। তার পর সিধে আম্পায়ারের কাছে। গ্যালারির কোথা থেকে তাঁর কানে অনবরত বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য ভেসে আসছে, আঙুল তুলে দেখাতে দ্বিধা করেননি। আগুপিছু ভাবেননি। কারণ, তিনি অটোরিকশ চালকের সন্তান। জীবন তাঁকে শিখিয়েছে, লড়ে নিতে হয়। অটোরিকশ চালকের সন্তানের অনাদরের জীবন তাঁকে শিখিয়েছে, ছাড়তে নেই! যে নাছোড় মনোভাবের বীজ পোঁতা থাকে আসমুদ্রহিমাচলের কোটি কোটি অটোরিকশ চালকের সন্তানের জীবনে।

অস্ট্রেলিয়ার মাঠে গ্যালারি থেকে উড়ে-আসা বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্য শুনে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ফাইল ছবি।

অতএব, হে সবজান্তা ইংরেজ ক্রিকেটলিখিয়ে, ওই তিনটি শব্দ লেখার দরকার আছে। কারণ, ওই অটোরিকশ চালকের সন্তানের মাঠের পারফরম্যান্সের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর শৈশবের কাহিনি, তাঁর সামাজিক লড়াই, তাঁর গরিব ঘরের মালিন্য।

প্রথমে কী লিখেছিলাম? ওভালের কাব্যে প্রায় উপেক্ষিত? ভুল লিখেছিলাম! ডাহা ভুল! ভারতের অটোরিকশ চালকের সন্তানেরা কাব্যে উপেক্ষিত হন না। তাঁরা কাব্য লেখেন। মহাকাব্য। মহা-ভারত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement