পুণ্যসন্ধান: সংক্রান্তির স্নানের জন্য কপিল মুনির মন্দিরের সামনে জনসমাগম, গঙ্গাসাগর। ১৪ জানুয়ারি, ২০২১
কোভিড-এর তৃতীয় ঢেউয়ের মধ্যেই গঙ্গাসাগর মেলা এসে পড়ল। আর দু’-চার দিন পর থেকে মেলায় ভিড় বাড়তে শুরু করবে। গঙ্গাসাগরের পুণ্যার্থীদের অধিকাংশই প্রধানত হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলি থেকে কাল-পরম্পরায় আসেন এই সাগরসঙ্গমে মকর সংক্রান্তির স্নান করতে।
তার আগে সাধু-সন্ন্যাসীদের একাংশ ডেরা বাঁধেন ময়দানের ধারে। শহরের এ দিক-ও দিক ঘুরে বেড়ানো গঙ্গাসাগর যাত্রীর সংখ্যাও নেহাত কম হয় না। সব মিলিয়ে কলকাতা ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় তাঁদের আনাগোনা বাড়ে।
কয়েক লক্ষ লোকের সমাবেশ যেখানে, সেখানে সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে সরকারকে বিবিধ কার্যকর ভূমিকা নিতেই হয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্বসূরিরা নিয়েছেন। এখন তিনি নিচ্ছেন। তবে সঙ্গমে ডুব দিয়ে পুণ্যের কলস পূর্ণ করতে যাঁরা আসবেন, তাঁদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়ার কোনও কারণ নেই। বরং মেলার পরে রাজ্যে সংক্রমণ এক লাফে বেড়ে যেতে পারে, এটাই চিকিৎসক মহলের আশঙ্কা।
প্রতি বারের মতো এ বারেও মেলার প্রস্তুতি সরেজমিন দেখতে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশাসন ও পুলিশ কর্তাদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বন্দোবস্তের খুঁটিনাটি জেনেবুঝে এসেছেন তিনি। সরকার জানিয়েছে, মেলায় কোভিড-সতর্কতা বজায় রাখতে সব ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু লাখ লাখ লোকের উন্মুক্ত বিচরণ-ক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত করা বস্তুত অসম্ভবের চেয়েও দুরূহ।
গত বছরও কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেই গঙ্গাসাগরে অন্তত আট লক্ষ লোকের ভিড় হয়েছিল। ভার্চুয়াল প্রথায় ই-স্নান এবং পুজোর ব্যবস্থা সত্ত্বেও আট লক্ষের সমাগম বুঝিয়ে দিয়েছিল, নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি প্রকৃতপক্ষে হাতের বাইরে। মেলা হলে লোকসমাগম হবেই।
কোভিডের তৃতীয় ঢেউ মাথা চাড়া দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এগুলি উদ্বেগের বাড়তি উপাদান। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের দিক থেকে আরও কিছু করার থাকে কি না, আদালত কিছু বলে কি না, সে সব পরের কথা। কিন্তু আপাত ভাবে যা হতে চলেছে, তাতে স্বস্তির কোনও জায়গা থাকবে বলে মনে হয় না।
তবুও গঙ্গাসাগর মেলা বন্ধ করা হচ্ছে না কেন? এর কারণ কি প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, না কি ধর্মীয়? ধর্ম ও রাজনীতি এখন একাকার। তাই বিষয়টি আরও বেশি করে প্রশ্ন জাগায়।
সাধারণ ভাবে আমরা দেখেছি, বিভিন্ন পালা-পার্বণ, উৎসব-অনুষ্ঠানকে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা গোড়া থেকেই বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। সেগুলিকে আরও বড়, আকর্ষণীয় ও সুবিন্যস্ত করার কাজে তাঁর উদ্যোগ যথেষ্ট। আর তা শুধু কোনও নির্দিষ্ট ধর্ম বা ভাষাভাষীর উৎসবেই সীমিত নয়। এই আমলে রাজ্যে সকল ধর্ম, সম্প্রদায়, ভাষাভাষীর উৎসব গুরুত্ব অনুযায়ী মমতার পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে।
এর পিছনে উদ্দেশ্য অবশ্যই অনেক। বলা চলে, এক চালে অনেকগুলি কিস্তি মাত! ২০১১ থেকে ’২১-এর পথে হেঁটে আসতে আসতে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা পরতের রাজনীতি।
সিপিএমের নেতৃত্বে চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনে বাংলার ধর্মীয় ও সামাজিক কোনও বড় উৎসব-অনুষ্ঠানের সঙ্গে শাসকবর্গের তেমন প্রত্যক্ষ সংস্রব ছিল না। জ্যোতি বসু কখনও পুজোর প্যান্ডেলে, ইদের জমায়েতে বা গির্জার প্রার্থনায় যোগ দিয়েছেন বলে মনে পড়ে না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও তাই। কারণ, এ সব তাঁদের রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে খাপ খায় না। তাঁদের ভূমিকা থাকত পুলিশ ও প্রশাসনিক বন্দোবস্ত পর্যন্ত।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমেই ওই জায়গাটি বেছে নিলেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর উপলব্ধি হল, ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব-অনুষ্ঠানগুলির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হতে পারলে মানুষের মনের কাছাকাছি পৌঁছনো যায়। তাদের আবেগ স্পর্শ করা যায়। শুধু প্রশাসনিক আয়োজন করে দিয়ে দূরে থাকার চেয়ে এটা অনেক বেশি ‘কার্যকর’।
অতএব সিপিএম যা করেনি, তিনি সেখান থেকে শুরু করলেন। সরকারের প্রধান হিসাবে প্রথমেই যুক্ত হলেন দুর্গাপুজো, ইদ, ক্রিসমাসের মতো উৎসবের সঙ্গে। তাঁর উপস্থিতি ছটপুজো, গণেশ উৎসব থেকে গুরু নানকের জন্মোৎসব, এমনকি রবিদাসের মিছিলেও।
নেপথ্যে রাজনীতি? আছেই, কোনও সন্দেহ নেই। তবে এটাও ঠিক, এই ধরনের নীতিগত পদক্ষেপ করার আগে যে কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তি তাঁর লাভ-অলাভের দিকটি খতিয়ে দেখবেন। মমতা সেটাই করেছেন। তাঁর চেষ্টা, যেখানে যত বেশি মানুষের সঙ্গে সম্ভব, সরাসরি সংযোগ তৈরি করা।
এতে এক দিকে যেমন ধর্মনিরপেক্ষ অবয়ব তুলে ধরার সুযোগ থাকে, তেমনই বিভিন্ন সংস্কৃতিকে ‘মর্যাদা’ দেওয়ার সংহতিসূচক বার্তাও তুলে ধরা যায়। এই সময়, প্রধানত হিন্দুত্ব-রাজনীতির মোকাবিলা করতে গিয়ে, এগুলিকে মমতা কাজেও লাগাচ্ছেন। সত্যি বলতে, তিনি দুর্গাপুজোর বিরোধী কি না, সেই বিতর্ক কি আজ আদৌ হালে পানি পায়?
তবে শুধু পালা-পার্বণই নয়, নন্দন-এর ঘেরাটোপ থেকে চলচ্চিত্র উৎসবকে নেতাজি ইন্ডোরে নিয়ে আসা হোক বা পাড়ায় পাড়ায় গান মেলা ইত্যাদিরও মূল উদ্দেশ্য কিন্তু একই। এতে আবার অন্য রকম ‘সাপোর্ট বেস’ তৈরি হয়।
কেউ এ সব সমর্থন করতে পারেন, কেউ বিরোধিতা করতে পারেন। সেটাই স্বাভাবিক। তবে অস্বীকার করা যাবে না, উৎসবের মরসুমগুলি অনেক বর্ণময় হয়েছে। কলকাতা-সহ জেলাগুলিতেও তার ছাপ পড়েছে। সাধারণ মানুষের উপভোগ ও বিনোদনের ক্ষেত্রগুলি এখন অনেক বিস্তৃত। এর আর্থ-সামাজিক দিকগুলিও উপেক্ষণীয় নয়।
গঙ্গাসাগর নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগ তারই এক অঙ্গ। তৃণমূলের আমলে সাগরদ্বীপের ভোল বদল চোখে পড়ার মতো। যাঁরা বাম রাজত্বে সেখানে গিয়েছেন এবং এখনও যান, তাঁদের চোখে এই পরিবর্তন ধরা না পড়ে উপায় নেই। দ্বীপখণ্ডটির রাস্তাঘাট, জল, আলো, থাকার বন্দোবস্ত, এমনকি কপিল মুনির মন্দির চত্বর— সর্বত্র উন্নত ব্যবস্থা। স্নানের পথ পরিচ্ছন্ন। দোকান পসারগুলিও অনেক গোছানো।
এর সবটাই অবশ্য সাম্প্রতিক কালেই হয়েছে। আগে মেলার দিনগুলি বাদ দিলে গঙ্গাসাগর নিঝুম পড়ে থাকত। এখন জায়গাটি সারা বছরের পর্যটন-তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। মকরস্নান ছাড়াও সাধারণ পর্যটকেরা এখন সেখানে বেড়াতে যান। ফলে বেড়েছে স্থানীয় লোকেদের আয়ের পরিমাণ।
কিন্তু এর পরেও একটি জরুরি প্রশ্ন থাকে। তা হল, গঙ্গাসাগর মেলা থেকে রাজ্যের সরকার কী পায়? এ বার মেলার প্রস্তুতি দেখতে গিয়ে মমতা নিজেই দাবি করেছেন, কুম্ভমেলার মতো গঙ্গাসাগরকেও ‘জাতীয় মেলা’র স্বীকৃতি দিতে হবে। যার অর্থ, গঙ্গাসাগরের জন্য কেন্দ্রীয় বরাদ্দ।
এই মেলার খাতে রাজ্যের একটি খরচ ধরা থাকে। সব মিলিয়ে সেটা এখন কমবেশি একশো কোটি। বাম সরকার এক সময় যাত্রী-পিছু পাঁচ টাকা তীর্থকর নিতেন। মমতা সরকারে আসার আগে এই ভাবে আনুমানিক পনেরো লক্ষ টাকা আদায় হত। মমতা তা-ও রদ করে দিয়েছেন। সুতরাং তিনি নিজেই সব দায় কাঁধে নিয়েছেন বলা ভুল নয়।
অন্য দিকে, কপিল মুনির আশ্রমে প্রণামী বাবদ যে বিপুল আদায় হয়, তার কিছু অংশ রাজ্যকে দেওয়ার জন্যও সিপিএমের রাজত্বে দাবি উঠেছিল। ২০০১ সালে সাগরের তৎকালীন সিপিএম বিধায়কের ওই দাবি নিয়ে শোরগোলও পড়ে। মন্দির কর্তৃপক্ষ রাজি হননি। আজ তো দাবিও নেই! একই ভাবে প্রণামীর টাকা এখনও চলে যায় অযোধ্যায়।
গঙ্গাসাগরকে জাতীয় মেলা করতে মমতার দাবি হয়তো অন্যায্য নয়। এর পিছনেও রাজনীতির হিসাব পরিষ্কার। কিন্তু প্রতি বছর গঙ্গাসাগরের জন্য কোষাগারের উপর বিপুল চাপ রাজ্যই বা মুখ বুজে বহন করে কেন? মূলত ভিনরাজ্যের লক্ষ লক্ষ লোকের ‘পুণ্যার্জন’-এর এই আয়োজন কি রাজ্য সরকারের ‘কল্যাণমূলক প্রকল্প’ বলে ধরতে হবে?
কোভিড-সঙ্কটের মধ্যে আশঙ্কা বাড়ানো গঙ্গাসাগর মেলা নিয়ে প্রশ্নগুলি আজ ভেবে দেখার।