পঙ্গপালের মতো ধেয়ে এসেছে ভাইরাসের তরঙ্গমালা— জনজীবন বিপর্যস্ত। বিধিনিষেধের বহর দেখে প্রশ্ন জাগে, ডাক্তারি শাস্ত্র কি এমনই প্রবল শাসনপটু? সে কথা ভাবলেই মনে পড়ে জনস্বাস্থ্যবিদ, ডাক্তার ডোনাল্ড এ হেন্ডারসনের কথা, গুটিবসন্তের বিলুপ্তিতে যাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
গুটিবসন্তের মহামারি বার বার ঘটেছে আমেরিকায়, আমাদের দেশে শেষ ঘটেছে ১৯৭৪-এ। তাতে মৃত্যুযোগের আশঙ্কা ছিল প্রায় ত্রিশ শতাংশ; আধুনিক, ‘নতুন’ ভাইরাস সে-তুলনায় নিতান্ত শিশু। অথচ অমন ভয়ঙ্কর ভাইরাস-এর বিরুদ্ধেও দলবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে নিষেধের জেলখানায় সকলকে পুরে দিতে হবে, অমন কথা বলেননি তিনি। বলেছিলেন, লুকিয়ে মোটেই বাঁচা যাবে না, ভরসা কেবল বিজ্ঞান। চাই প্রতিরোধ ক্ষমতা, প্রাকৃতিক অথবা টিকার্জিত। তা হলে ভাইরাস দমন আর মানব দমন এখন গুলিয়ে গেল কেন?
ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় ভাইরাস থেকে পরিত্রাণ পেতে সমাজের স্বচ্ছন্দ চলন বন্ধ করে রাখা, ‘কোয়রান্টিন’, ‘লকডাউন’ ইত্যাদি ছিল প্রাক্-আধুনিক ধারণা। কিন্তু ২০০৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়রের আমলে সেই ধারণাগুলোরই পুনরুত্থান ঘটেছিল। এর পর সাব্যস্ত হল, এগুলোই হবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রাথমিক যুদ্ধবিধি। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ হল। এই ধারণাগুলোর পিছনে বিজ্ঞানের সাক্ষ্য ছিল না, ছিল বিশ্বাসের প্রাবল্য।
মহামারি বা এই ধরনের দুর্যোগ যখন সমাজের গায়ে আছড়ে পড়ে, তখন আমাদের প্রথম কাজ হল মানুষকে নিরুদ্বিগ্ন রাখার বন্দোবস্ত। লোকে তখনই সবচেয়ে বেশি সাড়া দেবে, যখন জীবনযাত্রার স্বাভাবিকতা সবচেয়ে কম ব্যাহত হবে। কেউ বিপদে পড়লে যাতে যথাসম্ভব যত্ন পান, তার ব্যবস্থা করতে হবে। যত্নের জন্য দরকার মজবুত জনস্বাস্থ্য, যার নির্মাণে যত কম মনোযোগ, বিপদ ততটাই মর্মান্তিক। অতিমারি নিয়ন্ত্রণে বিধি বা নিষেধ নিশ্চয় দরকার, কিন্তু কোনওটাই স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ নয়। এক-একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে, এক-একটা বিধির কিছু তাৎপর্য থাকে— কিন্তু সেগুলোর পাইকারি প্রয়োগ নির্বুদ্ধিতা।
বিজ্ঞান চর্চা থেকে উৎপন্ন সমস্ত কিছুই যে শেষ পর্যন্ত মানবসভ্যতার উপকারে লাগবে, এমন কোনও কথা নেই। পরমাণু বিজ্ঞানচর্চা আর পরমাণু বোমা এক কথা নয়। তেমনই, বিজ্ঞানের অনুমতিসিদ্ধ কোনও বাধানিষেধ যদি সাধারণ নাগরিকের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে অন্য কোনও স্বার্থের কথা ভাবে, তবে তা পরিহার করাই উচিত কি না, তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। তার মানে এই নয় যে, বিজ্ঞানের প্রতিপাদ্যগুলো ভুল; সেগুলো স্থান, কাল, পাত্র নিরপেক্ষ নয়, এইমাত্র। বিজ্ঞান নিয়ে আমাদের অহঙ্কার থাকতে পারে; কিন্তু আধুনিক মানুষ হিসাবে যদি প্রাণজীবনের সারকথাটুকু ভুলে যাই, তবে তার পরিণতি মর্মান্তিক। প্রকৃতি ভারসাম্য চায়, প্রাণজীবন তার সঙ্গেই বোঝাপড়া করে নেয়।
দু’দশক পুরনো একটা কথা ফের তোলা যাক। ইরাক হানা ছিল ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। আমেরিকার সন্ত্রাসে বিপুল ভাবে ধ্বস্ত হল ইরাক। অথচ তার পর প্রমাণিত হয়েছে, জনবিধ্বংসী মারণাস্ত্র লুকিয়ে রাখাটা ছিল নিছক কল্পকথা। একই ভাবে, ইদানীং শুনছি, জনস্বাস্থ্য এমন বিপর্যয়ের মুখে যে, এই মুহূর্তে আমাদের একমাত্র অভীষ্ট হবে স্বাস্থ্যের নিরাপত্তা। কিন্তু সেই নিরাপত্তা আমাদের চেনা পথে আসবে না, আসবে স্বাস্থ্যবিমার হাত ধরে, বিচিত্র সামাজিক বিধিনিষেধের রামধুন গাইতে গাইতে। এগুলো বাধ্যতামূলক হবে, ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ, বিচার-বুদ্ধি নির্বাসিত হবে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে।
২০১৪-১৫ সালে আফ্রিকায় ইবোলা সংক্রমণের পর থেকেই দুনিয়ার প্রধানতম শ্রেষ্ঠীদল জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে উতলা হয়ে উঠেছিল। ডাক্তারি জার্নালগুলোতে তাদের লেখাপত্র বেরোচ্ছিল। তারা সরাসরিই জানিয়ে দিয়েছিল যে, জনস্বাস্থ্যকে কড়া শাসনে রাখতে হবে। তার জন্য বৈশ্বিক স্বাস্থ্য নিয়ন্ত্রক দরকার, সেই নিয়ন্ত্রণও আসবে পশ্চিমি বিশ্ব থেকেই। ছোট-বড় যাবতীয় স্বাস্থ্যঘটিত সমস্যার জন্য আপনাকে ওই নিয়ন্ত্রকের মুখের দিকেই তাকাতে হবে। স্বাস্থ্যের বৈচিত্র নয়, বরং মূল কথা ‘এক বিশ্ব, এক স্বাস্থ্য’— শ্রেষ্ঠীনির্দেশিত নিরাপত্তা। এমনকি ব্যাধি, অতিমারি, প্রতিষেধক, এই শব্দগুলোর সংজ্ঞাও দরকার মতো পাল্টে যাবে।
বিজ্ঞানচর্চা ধনকুবেরদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়েছে অনেক আগেই, ডাক্তারি গবেষণার জগতে ‘পাবলিশ অর পেরিশ’ স্লোগান তাঁদেরই নির্দেশে। ২০০২ সালে প্রকাশিত হল ভ্যাকসিন্স নামে একটি ডাক্তারি পাঠ্য বই; ২০১৩ সালে প্রকাশিত এর ষষ্ঠ সংস্করণের মুখবন্ধ লিখে দেন বিল গেটস। ডাক্তারি পাঠ্য যখন শ্রেষ্ঠীর অনুকম্পাপ্রার্থী হয়, তখন বিজ্ঞানচর্চার গতিপথ নিয়ে আর সংশয় থাকে কি? আমরা জানতাম যে, জনস্বাস্থ্যের জাতীয় রূপ থাকে, আন্তর্জাতিক রূপও; কিন্তু এখন ক্রমশ বোঝা যাচ্ছে, জনস্বাস্থ্য আসলে হয়ে যাবে অধিজাতিক, ‘সুপ্রান্যাশনাল’। সেখানে একমাত্র শাসক হবে বিরাট মাপের ওষুধ নির্মাতা সংস্থাগুলি— বিগ ফার্মা।
রাষ্ট্রমুগ্ধ বিদ্বজ্জনেরা সামাজিক নীতির কথা বলেন অনেক, সামাজিক ন্যায়ের কথা বলেন না। অথচ নীতি পরিস্থিতি-নির্ভর, তার আকার পাল্টায়; আর ন্যায় মানে বর্গক্ষেত্র, সক্কলের সমান অধিকার। সেই ন্যায্যতা এখন পুড়ছে, ধোঁয়া উঠছে; কিন্তু ‘প্রতিটি দগ্ধ গ্রন্থ সভ্যতাকে নতুন আলো দেয়’, সে কথা ভুললে তো আমাদের চলবে না।