PLI

রফতানি বাণিজ্যে কি ভারত পিছিয়ে পড়ছে? পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে আমাদের মূল পার্থক্য কোথায়?

ভারত যদি বিশ্ববাণিজ্যের সুবিধাগুলি না ব্যবহার করতে পারে, তবে তা এক প্রতিযোগিতাহীন বদ্ধ অর্থনীতিতে পরিণত হবে। এ থেকে মুক্তির উপায় ঠিক কী?

Advertisement

টি এন নাইনান

শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০২৩ ১০:২০
Share:

ক্রমবর্ধমান এবং দৃঢ় রফতানি ক্ষেত্র ছাড়া কোনও দেশের অর্থনীতিতেই দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধি সম্ভব নয়। ছবি: সংগৃহীত।

বাজারকেন্দ্রিক অর্থনীতির ভাষ্যকারেরা যে দু’টি বিষয়ে সাধারণত নরেন্দ্র মোদী সরকারের সমালোচনা করে থাকেন তার একটি হল— এই সরকার আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য ব্যবস্থা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে ভুল করেছে। দ্বিতীয়টি— শুল্কপ্রাচীরের ভিতরে দেশজ উৎপাদনকে সুরক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই সরকারের ‘প্রোডাকশন লিঙ্কড ইনসেনটিভ’ (পিএলআই) প্রকল্প আগাগোড়া ভুল ভাবে নির্ধারিত। ‘প্রোডাকশন লিঙ্কড ইনসেনটিভ’ বা পিএলআই মূলত দেশজ উৎপাদন সংস্থাকে তাদের পারফরম্যান্স-ভিত্তিক অনুদান। এই দুই সমালোচনার মধ্যেই কিছু সত্য রয়েছে। ভারত বাণিজ্যের সুযোগ-সুবিধাগুলির অংশভুক হয়ে উঠতে না পারলে আঞ্চলিক স্তরে উৎপাদন ও সরবরাহের এক চক্রে আটকে থাকবে এবং ভর্তুকি তথা শুল্কচালিত উৎপাদননীতি এক প্রতিযোগিতাহীন ক্ষেত্রে এ দেশকে আটকে রাখবে।

Advertisement

সামগ্রিক অর্থনীতির সাপেক্ষে দেখলে বোঝা যায়, এর ফলাফলগুলি চিন্তার। ক্রমবর্ধমান এবং দৃঢ় রফতানি ক্ষেত্র ছাড়া কোনও দেশের অর্থনীতিতেই দ্রুত আর্থিক বৃদ্ধি সম্ভব নয়। সঙ্গে প্রয়োজন এমন এক উৎপাদন ক্ষেত্রের, শুধু সুরক্ষা এবং ভর্তুকি পেলেই যার উন্নতি সম্ভব। এমন অবস্থাকে কেউ শিল্পের জন্য সুস্থসবল এবং দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ বা পরিস্থিতি বলতে পারবেন না। সুতরাং এ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট— ভারত আঞ্চলিক বাণিজ্য ব্যবস্থাগুলির মধ্যে প্রবেশ করবে এবং সেখানে এমন সব পরিবর্তন ঘটাবে, যার দ্বারা সে আন্তর্জাতিক সরবরাহ চক্রের অংশ হয়ে দাঁড়াবে।

কিন্তু এই সমালোচনাগুলিকে সত্য বলে ধরে নেওয়া হলেও সমালোচকরা কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির একটি বিশেষ বিষয় খেয়াল করছেন না। সেটি হল, পণ্য রফতানি (যা নিয়ে মূলত এশিয়ার আঞ্চলিক বাণিজ্যচুক্তিগুলি সম্পাদিত হয়) আর ভারতের রফতানি ক্ষেত্রের বৃদ্ধিতে কাজ করছে না। তার জায়গা নিয়েছে পরিষেবা রফতানি।যার বৃদ্ধি দ্রুততর। পরিষেবা রফতানি এ দেশের গত বছরের সামগ্রিক রফতানির ৪২ শতাংশ জুড়ে রয়েছে। সাম্প্রতিক প্রবণতা বজায় থাকলে এই সংখ্যা কয়েক বছরের মধ্যে ৫০ শতাংশও হয়ে দাঁড়াতে পারে। তখন তা অনিবার্য ভাবে পণ্য রফতানির পরিমাণকে ছাড়িয়ে যাবে। রফতানি বাণিজ্যের সাফল্যের ব্যাপারে সমালোচকরা ভুল জায়গায় মনোনিবেশ করছেন।

Advertisement

সমালোচকরা রফতানিভিত্তিক উন্নতির এশীয় মডেলের আর একটি রূপ খুঁজতে গিয়ে রেডিমেড পোশাকের মতো কম মূল্যের, কম লভ্যাংশের, শ্রমনিবিড় একটি পণ্যের রফতানিকে চিহ্নিত করে সেই ভুলটাকে আরও জটিল করে তুলছেন। বিষয়টি নেহাত আকাশকুসুম। কারণ, ভারতের পরিচালন ব্যবস্থা পূর্ব এশিয়ার চেয়ে আলাদা এবং তাতে পরিবর্তন আনাও দুঃসাধ্য। এমনকি, এখনও এমন দেশ প্রচুর, যেখানে শ্রম বেশি সস্তা এবং/ অথবা যারা বেশি মাত্রায় উৎপাদনক্ষম। ভারতের ক্ষেত্রে শ্রমনিবিড় রফতানির বিষয়টি সফল হলে সস্তা শ্রমে উৎপাদিত পণ্যের শ্রমমূল্য উৎপাদিত পণ্যের দামের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র হত। বা যেখানে দেশীয় বাজার স্থানীয়করণের ব্যাপারে ইনসেনটিভ দিয়ে থাকে, সেখানেই থাকত। যেমন দেওয়া হয়েছে মোবাইল ফোন এবং কিছু কম হলেও বৈদ্যুতিন জিনিসপত্রের ক্ষেত্রে। বাকি উৎপাদিত পণ্যের রফতানি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পুঁজি অথবা জ্ঞাননির্ভর। যেমন পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্য, ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্য, ওষুধপত্র এবং রাসায়নিক।

উন্নয়নের যে স্তরে ভারত রয়েছে, সেখান থেকে পরিষেবা রফতানি খুব অস্বাভাবিক। কিন্তু এখন এই বিষয়টি রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত যে, প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রে এ দেশের সব থেকে বড় সুবিধা হল এখানকার শিক্ষিত, অফিসবাবু-সুলভ শ্রমশক্তি। এই শ্রমশক্তিকে ‘ব্লু-কলার’ বাহিনী বলা যাবে না। অর্থাৎ, এই শ্রমশক্তি দফতরের চেনা আরাম ছেড়ে মেশিনচালনা বা নির্মাণশিল্পের ধুলো মেখে কায়িক শ্রম করবে না। এই পরিষেবা ক্ষেত্র যত বেশি মাত্রায় বাণিজ্য উদ্বৃত্তের জন্ম দেবে, ভারতীয় টাকার ভিত তত পোক্ত হবে। সুতরাং, পূর্ব এশীয় ধাঁচে কম লভ্যাংশের শ্রমনিবিড় পণ্য রফতানির অনুসরণ বা অনুকরণ সহজে সাফল্য এনে দেবে না। তবে এটা কোনও নতুন উপলব্ধি নয়। অর্থনীতিবিদেরা দীর্ঘ কাল ধরেই বিষয়টি জানেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের শিল্প-বাণিজ্য নীতি সংক্রান্ত বোধের ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রয়োগ করতে পারেন না।

দ্বিতীয় বিষয়টি হল পিএলআই। সে ক্ষেত্রে আবারও সমালোচনার সত্যতাই প্রমাণিত। কিন্তু সমস্যা হল, পিএলআই ব্যর্থ হলে কী হবে? সামগ্রিক অর্থনীতির নিরিখে প্রস্তাবিত ইনসেনটিভের পরিমাণ যৎসামান্য। সামগ্রিক ভাবে পিএলআই-এর পরিমাণ ২ লক্ষ কোটি টাকার নীচে রয়েছে। পাঁচ বছর পরে সম্ভবত সেটি সেই কালপর্বের সম্ভাব্য মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ১ শতাংশের এক-দশমাংশ হয়ে দাঁড়াতে পারে। পিএলআই-কে কোনও স্থায়ী বাজে খরচ হিসাবে ধরে না নিয়ে এটুকু ভার বহন করাই যায়।

কিন্তু পিএলআই সফল হলে? সরকারের দাবি, বিনিয়োগের পরিমাণ তা হলে ৩ লক্ষ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়াবে। সে ক্ষেত্রে তার পাঁচ বছরের যোগফল চলতি বছরের জিডিপি-র ১ শতাংশের সমান হবে। নির্ধারিত সম্পদে বার্ষিক বিনিয়োগের পরিমাণ, অর্থাৎ জিডিপি-র প্রায় ৩০ শতাংশের তুলনায় তা কিছুই নয়। কিন্তু অনুমান করা হচ্ছে, সামগ্রিক মূলধনী ব্যয়ের মধ্যেকার উৎপাদিত অংশের পরিমাণকেই বাড়িয়ে তুলবে, রফতানির যথেষ্ট পরিমাণ বিকল্প তৈরি হবে, রফতানি বাড়বে এবং ৬০ হাজার কোটি কর্মসংস্থান হবে (উৎপাদন ক্ষেত্রে বর্তমানে যা রয়েছে, তার এক-দশমাংশ)। এই সব দাবিকে সন্দেহাতীত ভাবে মেনে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। কিন্তু বহনযোগ্য ব্যয়ে এটা সম্ভব হলে পিআইএল-এর পাল্লা ভারী হবে। কারণ, তখন হেড-টেল দিয়ে জয়-পরাজয় হবে। হেড পড়লে জিত। টেল পড়লে সামান্য হার, যা ততটা গায়ে লাগবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement