ভারতীয় টাকার মূল্যমান কমেছে! গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
২০২২-এর শুরু থেকেই অর্থনৈতিক দিগন্তে দুর্যোগের আলো কমে এসে মেঘ জমতে শুরু করেছে। কারণ, স্বল্পমেয়াদি উন্নতির সম্ভাবনা কমে এসেছে, জ্বালানি ও অন্যান্য শক্তির দাম বেড়েছে, বাণিজ্য-সাম্য নেতিবাচকতার দিকে ঢলেছে, ফিসক্যাল ব্যালান্স (রাজস্বের সঙ্গে সরকারি ব্যয়ের তুলনামূলক হিসাব) উচ্ছন্নে গিয়েছে, ভারতীয় টাকার মূল্যমান কমেছে, সংস্থাগুলি আগের থেকে বেশি মাত্রায় সাবধানী হয়ে পড়েছে, বাজার এক রকমের শঙ্কিত অবস্থায় বিরাজ করছে, ভোক্তারা মূল্যবৃদ্ধির আঁচ খুব ভাল করেই অনুভব করছেন।
এই সমস্ত কিছুরই সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। তার মধ্যে কিছু কারণের শিকড় বিশ্ব অর্থনীতির মধ্যে প্রোথিত। কিন্তু এই সঙ্কটের কারণ শুধু মাত্র সেখানে খুঁজতে যাওয়া বৃথা। এর কারণ অনুসন্ধান করতে হলে দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতাগুলির দিকে তাকাতে হবে।
‘এনট্রপি’ বা কোনও ব্যবস্থার মধ্যে বিশৃঙ্খলা দিয়ে কিন্তু সর্বদা অর্থনৈতিক প্রবণতাসমূহকে বোঝা যায় না। তবে এর দ্বারা সাম্প্রতিক বিশৃঙ্খলার বিবরণ এবং খামখেয়ালি চরিত্রকে বোঝা যায়। যদিও সেই বিশ্লেষণে ঘটনাক্রমের দীর্ঘমেয়াদি চরিত্রকে খাপ খাওয়ানো সম্ভব নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ‘এনট্রপি’ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে যদি বোধ হয়, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবণতাগুলি চক্রাকারে আবর্তিত হয়। কিন্তু সেই চক্র দীর্ঘ সময় ধরে চললে (যেমন রুশ অর্থনীতিবিদ নিকোলাই কোন্ড্রাটিয়েভ বর্ণিত ‘প্রযুক্তি চক্র’ অর্থাৎ প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের ফলে জাত অভিঘাতে পড়া পণ্যমূল্যের উপরে ইতিবাচক প্রভাব অর্থনীতির অধোগতির পরেই দৃশ্যমান হয় এবং তা সাধারণত ৬০ বছর মতো স্থায়ী হয়) যে পার্থক্য হয়, তা কিন্তু বস্তুতান্ত্রিক নয়।
বিবর্ধিত অর্থনৈতিক ‘এনট্রপি’ বা বিশৃঙ্খলার মধ্যে যে জটিল বিন্যাস বিরাজ করে, তার ভিতর নিহিত থাকে বিবিধ বিষয়। এই বিষয়গুলির মধ্যে প্রথমেই যেটি নজরে আসে, সেটি হল দুর্বল স্কন্ধে ভুবনায়নের গুরুভার চাপিয়ে দেওয়া। এই কাণ্ডটি বিশ্বে ধনী-গরিব দেশ নির্বিশেষে ঘটতে দেখা যায়। এর সঙ্গেই থাকে জাতীয় ও বিশ্ব-স্তরে সেই সব ধনাঢ্যের জন্ম, যাঁদের সম্পদের পরিমাণের আঁচটুকু পর্যন্ত আগে থেকে পাওয়া সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়ত, আকস্মিক ভাবে লব্ধ সম্পদের এই নাটকীয় প্রকাশ ‘ফিনানশিয়াল ক্যাপিটালিজম’ (শিল্প ব্যতিরেকে অর্থনীতির অন্য ক্ষেত্র থেকে পুঁজির অধিকতর মাত্রায় জারণ)-এর আদর্শগত বিজয়কে সূচিত করে (২০০৮-এর অর্থনৈতিক সঙ্কটের অন্যতম কারণ ছিল এটিই), তার অনুবর্তী হয়ে আসে ‘ভেঞ্চার ক্যাপিটালিজম’ (ন্যূনতম দায়বদ্ধতায় সেই সব সংস্থার ইক্যুইটিতে বিনিয়োগের প্রবণতা সম্পন্ন পুঁজিবাদ, যারা উন্নতির এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা ব্যক্ত করছে) এবং তৃতীয় এবং এক সমান্তরাল স্তরে বৃহৎ প্রযুক্তি সংস্থার ক্ষমতায়ন ও প্রভাব বিস্তার দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
‘দ্য গ্রেট গ্যাটসবি যুগ’ (যে কালে এক প্রজন্মের হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভবন ঘটে এবং তার পরবর্তী প্রজন্ম অর্থনীতির সারণীতে পূর্ববর্তী প্রজন্মকে ছাপিয়ে উঠে আসে)-এর পুনরাগমনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকট হয় সর্বময় বিজেতা (বা মঞ্চের) বাণিজ্যের এবং তাদের অনাগত স্টার্ট-আপ ব্যবসার উদ্ভব, অস্থিরমতি অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তার দ্বারা নিশ্চিত জীবিকাগুলির নিশ্চিহ্নকরণ এবং বাণিজ্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের বিচ্ছিন্নকরণ। এর তিনটি উদাহরণ হল— ডিজিটাইজেশন এবং তথ্যভারে নুয়ে পড়া প্রথাগত অর্থনীতি, কোনও রকম মধ্যস্থতা-বিহীন দূষিত বিষয়ে বৃহৎ প্রযুক্তি সংস্থার স্পনসরশিপের ফলে দীর্ণন গণমাধ্যম এবং ই-কমার্সের ফলে জন্ম নেওয়া খুচরো ব্যবসার রমরমা।
এই চরিত্রগত পরিবর্তনগুলি, যা থেকে অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী এবং দরিদ্র শ্রমজীবী সমাজের মতো পরস্পর বিপরীত ভাগে বিভাজিত হয়ে যাওয়ার প্রবণতা প্রতীয়মান হয়ে ওঠে, সেগুলি এক চতুর্থ প্রবণতার দ্বারা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। সেই প্রবণতাটি হল— বিশ্বের ধনী দেশগুলিতে (যেখানে এই গ্রহের এক-ষষ্ঠাংশ মানুষ বাস করেন) দরিদ্রতর দেশগুলি থেকে বিপুল সংখ্যক অভিবাসীর বলপূর্বক অনুপ্রবেশ। পঞ্চমত, চিনের উত্থানের ফলে ক্ষমতাবিন্দুর স্থানাঙ্ক পরিবর্তন (ভারতের মতো কিছু ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশের উত্থানকেও মাথায় রাখতে হবে) পূর্বতন শক্তিসাম্যকে ঝেড়ে ফেলেছে কিন্তু নতুন কোনও ব্যবস্থার এখনও জন্ম দেয়নি।
এর সঙ্গ দিচ্ছে জৈব-সঙ্কটের ক্রমপ্রবাহ— ম্যাড কাউ ডিজিজ, সার্স, বার্ড ফ্লু, কোভিড-১৯ এবং নবাগত মাঙ্কি পক্সের মতো অতিমারি বা মহামারি। এ সবের পিছনে রয়েছে কোনও অলক্ষিত গবেষণাগারে বসে চালিয়ে যাওয়া মারাত্মক বিপজ্জনক কোনও গবেষণা অথবা পশুপাখির ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল’ স্তরে পালন তথা উৎপাদন (যার বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে রীতিমতো প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, যেখানে ম্যাকডোনাল্ডেরই অন্যতম অর্থলগ্নিকারী কার্ল আইকান সংস্থার তরফে সন্তানসম্ভবা শূকর পালনের পদ্ধতি নিয়ে ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছেন)। এ সবের একটি ফল হল সরবরাহকে নিরবচ্ছিন্ন রাখা এবং অন্যটি পর্যটন ব্যবসার ক্ষতিসাধন। এর ফলে এক দিকে পণ্য পরিবহণ এবং গণপর্যটন বিপর্যস্ত হয়েছে।
পরিশেষে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিশ্ব উষ্ণায়নের মতো বিষয়, যা এখন আর কোনও বিশেষ শিল্পের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে না। বরং সামগ্রিক ক্ষেত্রের (শক্তি উৎপাদন, পরিবহণ, উৎপাদন) দিকেই আঙুল তুলে আকস্মিক বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে বলতে চায়।
পূর্বাবস্থায় অর্থনীতিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া নিয়ে বিতর্ক এখন আর স্থবিরতায় আটকে নেই। প্রতীকী ছবি।
বিশৃঙ্খলার এই সব বহুবিধ এবং অগণিত উপাদানের কারণে ঘটিত অর্থনৈতিক ফলাফলগুলিকে সর্বদা বোঝা যায় না। যেমন যায়নি ২০০৮-এর অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময়ে। অনিয়িন্ত্রিত ফিনানশিয়াল ক্যাপিটালিজমের সঙ্গে উদগ্র রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা মিশ্রিত হয়ে আমেরিকায় অর্থনৈতিক ভাবে স্থবির আয়ের গোষ্ঠীগুলিকে আবাসনের বন্দোবস্ত করে দিতে হয়। সামাজিক সমস্যার এই ‘সমাধান’ ইতিমধ্যেই সেখানে সরকারি ঋণের পর্বত তৈরি করেছে। যখন কোভিড-১৯ অতিমারি এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিল, তখন কিন্তু ‘স্বাভাবিকতা’র গণ্ডি লঙ্ঘন করে কোনও অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারিত হয়নি। পূর্বাবস্থায় অর্থনীতিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া নিয়ে বিতর্ক এখন আর স্থবিরতায় আটকে নেই। বরং তা মন্দায় পর্যবসিত হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও এক বিপজ্জনক মিশ্রণ, তা হল মুদ্রাস্ফীতি এবং শেয়ার বাজারে ধস।
রজনৈতিক-অর্থনীতি এই দুর্বোধ্যতাকে যেন আয়নায় প্রতিফলিত করে দেখাচ্ছে। অভিবাসী-বিরোধী ‘পলিটিক্যাল নেটিভিজম’ এবং পরিবর্ত সত্যকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রণীত অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ, যথা ব্রেক্সিট এবং ডোনাল্ড ট্রাম্প এর উদাহরণ। এর সামনে আদর্শগত চ্যালেঞ্জের পথটি হল উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পন্থায় বলীয়ান মানুষের শাসন প্রবর্তন। ক্ষমতার এই পরিবর্তনের (ঊর্ধ্ব ও নিম্ন উভয় ক্ষেত্রেই) আকাঙ্ক্ষা দেশের পর দেশে প্রতিরক্ষা খাতে খরচ বাড়াচ্ছে।
লক্ষণ মোটেই সুবিধের নয়। এই চক্র শেষমেশ চিনের মহা-উত্থান তত্ত্বে গিয়ে ঠেকতে পারে। তাতে ভারতের কিছু সুবিধা হয়তো হবে। ততক্ষণ এই বিশৃঙ্খলাকে বৃহত্তর বাস্তবতা হিসেবে স্বীকার করা ছাড়া সামনে অন্য কোনও পথ খোলা নেই।