সংঘাত: নিরাপত্তা বাহিনী ও জনতার মধ্যে উত্তপ্ত আদানপ্রদান, নন্দীগ্রাম, ১ এপ্রিল। পিটিআই।
নন্দীগ্রাম নিয়ে ভোটের ময়দানে যা হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে, তার কোনওটিই খুব অপ্রত্যাশিত নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দিন নন্দীগ্রাম থেকে ভোটে লড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, সে দিন থেকেই পূর্ব মেদিনীপুরের এই ভূখণ্ড রাজ্যে এ বারের ভোটে আকর্ষণ ও উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু। শুভেন্দু অধিকারী প্রতিপক্ষ হওয়ায় সেই আগুনে ঘি পড়েছে। ভোটের দিন সেখানে যা ঘটেছে, সে সবও অনিবার্য পরিণতি।
ফলের অঙ্ক কষা শুরু হয়েছিল প্রথম দিন থেকে। এখন তো গত কয়েক দিন ধরে ভোট-পণ্ডিতদের এত রকম হিসেব ঘুরছে যে, জয়-পরাজয়ের ব্যবধান কারও খাতায় চার হাজার, তো কারও চুয়াত্তর হাজার! পাল্লা এক বার এঁর পক্ষে, এক বার ওঁর। সর্বোপরি আছে জয়ের দাবি নিয়ে সকল পক্ষের বক্তৃতার ফুলঝুরি। সেটা থাকবেই। তবে ভোট আপাতত মেশিনবন্দি। ওই সব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে তাই এখনই বিশেষ লাভ নেই।
কিন্তু যেটা বলার তা হল, নন্দীগ্রামের বার্তা। হ্যাঁ, বার্তাই বলব। কারণ সেখানে ভোট শুধু ‘সোনার বাংলা গড়া’ কিংবা ‘ভাঙা পায়ের খেলা’-য় সীমিত ছিল না। পৌঁছে গিয়েছিল প্ররোচনার উপাদানে ভরপুর উন্মুক্ত ধর্মীয় মেরুকরণে। ভোটের দিনের ঘটনার প্রেক্ষিতেও যার ছোঁয়াচ ছিল স্পষ্ট। প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকের সেটা নজর এড়ায়নি।
এ বার নন্দীগ্রাম-পরবর্তী প্রচারকেও সেই খাতে বইয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা কায়েম হয়েছে। এই কৌশল যত ভয়ঙ্কর, তার চেয়েও বেশি আত্মঘাতী! তবে বলতে দ্বিধা নেই, এটাও হিসেবের বাইরে কিছু নয়। সাম্প্রদায়িক উস্কানির রাজনীতিকে জল-হাওয়া দিয়ে বাড়িয়ে তোলার কাজটি সুনিপুণ ভাবে করার চেষ্টা অনেক দিন ধরে নানা ভাবে চলেছে। এখন ক্ষমতা দখলের যুদ্ধে তাকে পরিকল্পিত ভাবে বড় ‘হাতিয়ার’ করে তোলা হল। ভোট-পর্ব যত এগোবে, এটা বাড়বে বই কমবে না।
গত লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে বিজেপির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির পিছনে মেরুকরণের ভোট কতটা কাজ করেছিল, তা নিয়ে বহু মত আছে। তবে মেরুকরণের একটা ভূমিকা যে অবশ্যই ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। বস্তুত কেউ চান, বা না-চান, ‘শত্রুর মুখে ছাই’ দিয়ে বিজেপি অতি দ্রুত ‘ধর্ম’-কে বাংলায় রাজনীতির ময়দানে টেনে নামাতে পেরেছে। তারই ফলে কয়েক বছর ধরে তৃণমূল নেতাদেরও জেলায়-জেলায় বিজেপির কায়দায় রামনবমীর মিছিলে হাঁটতে দেখা যায়। খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সভা-সমাবেশে চণ্ডী-বগলা-শিব-কালীর মন্ত্র শুনিয়ে ‘হিন্দুত্ব’ জাহির করতে হয়। আবার হাতেকলমে সংখ্যালঘুদের ‘পাশে’ থাকার নজিরও রাখতে হয়।
দৃষ্টিকটু সবই। কারণ বঙ্গ-রাজনীতিতে এ সব জিনিস আগে এত খোলাখুলি করতে দেখা যেত না। ধর্ম, জাতপাতের হিসেব কষে রাজ্যে ভোট যে হয়নি, তা নয়। স্মরণকালে বাম, কংগ্রেস, তৃণমূলও নিজেদের মতো করে এ কাজ করেছে। কিন্তু সে সব ছিল প্রধানত সূক্ষ্ম রাজনৈতিক কারিকুরি— ভোট কাটাকাটির হিসেবি ছক। এখনকার মতো উন্মত্ত সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি নয়।
প্রসঙ্গত জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রথম বার ভোট লড়ার কথা মনে পড়ছে। প্রথমে মমতা সেখানে প্রণবদার বিরুদ্ধে তৃণমূলের প্রার্থী করেছিলেন মদন মিত্রকে। কিন্তু দ্রুত তাঁকে সরিয়ে নিয়ে প্রার্থী করা হয় আরএসপি থেকে মমতার দলে যাওয়া প্রাক্তন বিধায়ক শীষ মহম্মদকে। সিপিএম প্রার্থীও ছিলেন সংখ্যালঘু। এবং ‘ঘটনাচক্রে’ সে বারই প্রথম সরাসরি ভোটে জিতে প্রণবদা লোকসভায় পৌঁছে যান। কিন্তু ইনি হিন্দু, তিনি মুসলিম বা হিন্দুরা অমুককে ভোট দেবেন না, মুসলিমরা তমুকের বিরোধিতা করুন—খোলাখুলি মঞ্চে দাঁড়িয়ে এই ধরনের উগ্র প্ররোচনা কিছুমাত্র ছিল না।
এখন তো দেখা যায়, ‘ছদ্ম হিন্দু’ বলে দাগিয়ে দেওয়াও চালু হয়েছে। যা শুধু অনৈতিক নয়, ঘোরতর অসম্মানজনকও বটে। যেমন, ভোটের বাজারে সদ্য বিজেপি হওয়া এক জাঁদরেল নেতা বক্তৃতায় মমতা সম্পর্কে বলে থাকেন, “উনি চণ্ডীপাঠ চটকে দিলেও কলমা ঠিক পড়তে পারেন।” কেউ যদি ভাবেন, এতে শুধু মমতাকে হেয় করা হচ্ছে, তা ভুল। এটা হিন্দু-মুসলিম উভয়ের ধর্মীয় সংস্কারের উপর কদর্য আঘাত।
জ্যোতি বসু বলতেন, তিনি বরাহনগরে ভোটে দাঁড়ানোর সময় সেখানে নাকি কানাঘুষো হাওয়া তোলা হয়েছিল যে, এই কমিউনিস্ট লোকটি ভোটে জিতে গেলে এলাকায় বাড়ির মহিলারা লক্ষ্মীপুজো করতে পারবেন না! জ্যোতিবাবুর সে দিন মনে হয়েছিল, এই রকম ‘হুইসপারিং’ বড় মারাত্মক।
তবে মমতা দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজোর বিরোধী— এই রকম প্রচারে আজ কোনও হুইসপারিং বা কানাঘুষোর রাখঢাক লাগে না। প্রয়োজনও পড়ে না। নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ থেকে শুরু করে পাড়ার বিজেপি নেতা সকলেই অবলীলায় ময়দানি ভাষণে এ সব বলেন এবং এক শ্রেণির মানুষের বিশ্বাস উৎপাদন করতে চান।
ঘটনা হল, বিজেপি রাজ্যে পা রাখার মতো জমি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে এই রকম প্রকাশ্য ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির প্রবেশ ও প্রসার ঘটেছে। ওই দলের উপর থেকে নিচুতলায় সর্বস্তরের নেতা এটা করেন। কারণ তাঁদের কাছে এটাই ‘বাঞ্ছনীয়’ পরিস্থিতি। শুধু ভোটে জেতা নয়, বৃহত্তর সমাজ অর্থাৎ জনসমষ্টিকে এই ভাবে ভাগ করে দেওয়া এবং নিরন্তর সেই বিভাজনের দিকে ঠেলে দেওয়া এই রাজনীতির অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ।
এই সূত্রে ফের এক বার নন্দীগ্রামের ছবিটি দেখা যেতে পারে। পরিসংখ্যান বলে, সেখানে দু’টি ব্লকের একটিতে সংখ্যালঘু ভোট কমবেশি ৩৩ শতাংশ। অন্যটিতে প্রায় ১১ শতাংশ। আজকের রাজনীতিতে ভোট বিভাজনের সাম্প্রদায়িক হিসাবনিকাশ কী ভাবে কষা হয়, সেই আলোচনা নতুন করে না করলেও চলে। কিন্তু প্রচারের বিষয়টি এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা জরুরি।
পুরো প্রচারপর্বে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে ‘মমতা বেগম’ বলে উল্লেখ করেছেন শুভেন্দু। বলেছেন, মমতা জিতলে এখানে ‘পাকিস্তান বানিয়ে দেবেন।’ ভোটের ঠিক আগে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া শুভেন্দু তাঁর প্রতিপক্ষকে হারাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। তবে সেটা করতে গিয়ে যা
করা হল, খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে একটি সম্প্রদায়কে নিশানা করে যে ধরনের বিদ্বেষ-বিষ ছড়িয়ে দেওয়া হল, তার জের কি শুধু ভোটেই থেমে থাকে? প্রশ্নটি ভেবে দেখার।
নন্দীগ্রামে ভোটের দুপুরে বয়ালের একটি স্কুল বাড়িতে বুথ ঘিরে উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, তখন বুথের বাইরের মাঠে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তার চোখে দেখা বর্ণনা শুনেছি আমার এক সহকর্মীর মুখে। তিনি বলছিলেন, মমতা যখন স্কুলের ভিতরে, বাইরের ফাঁকা জমিতে তখন মুখোমুখি আস্ফালন করছেন দুই সম্প্রদায়ের বহু মানুষ। মহিলাও প্রচুর। মাঝখানে পুলিশের দেওয়াল। সবচেয়ে আশঙ্কাজনক হল, উভয়পক্ষ সেখানে পরস্পরের ধর্মীয় পরিচয় তুলে হুমকি দিচ্ছেন, তাঁরা একে অন্যকে ‘জমি’ ছাড়বেন না। এ কালে বহু ব্যবহৃত ‘ধর্মীয় রাজনীতি’র স্লোগানও কানে এসেছে।
এই সবের ভয়াবহ পরিণাম এই রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকেরা বোঝেন না, তা নয়। কিন্তু ক্ষমতার অঙ্ক তাঁদের শুভবুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে রাখে। হয়তো তাতে কিছু মানুষকে কিছু সময়ের জন্য প্ররোচিতও করা যায়। দিনের শেষে চরম পরিণতির দায় এড়ানো যায় কি?
সবাই জানেন, ভোটের রাজনীতি সর্বদাই অনিশ্চয়তায় ভরা। গণতন্ত্রের মহিমায় শাসক পক্ষ কখনও বিরোধী হয়ে যায়, বিরোধীরা শাসকের চেয়ারে বসে পড়ে। তবে ধর্মের নামে সমাজটাকে ভেঙে দেওয়ার বিষ ছড়িয়ে যদি কেউ ক্ষমতায় আসে, তাকে ভাঙা আয়নায় খণ্ডিত অবয়বটুকুই দেখতে হয়। আর মনুষ্যত্বের সলিল সমাধি
ঘটলে ‘মানুষ’ ডোবে। সেখানে হিন্দু, মুসলিম ভেদ থাকে না।