Development

গ্রামের সমস্যা নিয়ে ভাবে কে

প্রত্যাশিত ভাবেই পরিবেশের কথা বলা নির্দল প্রার্থীরা ‘বিপুল ভোটে পরাজিত’ হয়েছেন। কিন্তু তাতে বিষয়গুলি গুরুত্ব হারায়নি।

Advertisement

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২৩ ০৬:৫২
Share:

সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রামের পরিবেশ-সমস্যার কথা অল্প হলেও আলোচনায় উঠে এসেছিল। অভিযোগ উঠেছিল, কোনও রাজনৈতিক দলই পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলিকে নির্বাচনী প্রচারে গুরুত্ব দেয়নি। অন্য দিকে, আবার কেউ কেউ জলঙ্গী বা ডেউচা-পাঁচামির মতো পরিবেশের বিভিন্ন বিষয়ের নাম করে নির্বাচনে প্রার্থীও হয়েছিলেন।

Advertisement

প্রত্যাশিত ভাবেই পরিবেশের কথা বলা নির্দল প্রার্থীরা ‘বিপুল ভোটে পরাজিত’ হয়েছেন। কিন্তু তাতে বিষয়গুলি গুরুত্ব হারায়নি। বরং উঠে এসেছে একটি জরুরি তথ্য— নির্বাচনে পরিবেশের মতো সামাজিক বিষয়কে গুরুত্ব না দেওয়াটা কোনও ব্যতিক্রম নয়; বরং নিয়ম। কেননা মেঠো ভাষণে গ্রামের উন্নয়নের কথা বলে গলা চিরে ফেললেও, ক্ষমতায় থাকা কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কাছে গ্রাম নিছকই দুয়োরানি। গ্রামাঞ্চলের পরিবেশ-সম্পর্কিত জরুরি সামাজিক সমস্যার সমাধান তাদের প্রকৃত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মসূচিতে নেই। গ্রামের উন্নয়ন মানে তাদের কাছে বড় জোর ইট-কাঠ-পাথরের খানিকটা পরিকাঠামো উন্নয়ন, আর পাইয়ে দেওয়ার উন্নয়ন। যাকে দেখিয়ে ভোটবাক্স ভরানো সহজ হয়।

বায়ুদূষণ শহর ও গ্রামকে প্রায় সমান ভাবে সমস্যায় ফেললেও কেন্দ্রীয় সরকার বায়ুদূষণ কমাতে ‘ন্যাশনাল ক্লিন এয়ার প্রোগ্রাম’-এ গত কয়েক বছরে দেশের শহরাঞ্চলের জন্য প্রায় ন’হাজার কোটি টাকা খরচ করার সিদ্ধান্ত নিলেও, গ্রামাঞ্চলের বায়ুদূষণ কমানোর জন্য কিছুই করেনি। অথচ, গবেষণা বলছে যে, গত বছর দেশের শহরাঞ্চলে যেখানে মারাত্মকতম বায়ুদূষক পিএম ২.৫-এর গড় মাত্রা ছিল ৪৬.৮; সেখানে গ্রামাঞ্চলে এই দূষকের মাত্রা ছিল ৪৬.৪, অর্থাৎ কার্যত সমান। তথ্য বলছে, সারা দিন-রাত দূষিত বায়ু ফুসফুসে ঢোকার কারণে গড়পড়তা শহরবাসীর জীবনকাল যতটা কমে, তার তুলনায় ৭ মাস বেশি কমে গড়পড়তা গ্রামবাসীর। এবং এটা শুধু ২০২৩-এর কথা নয়, ২০১৭ সাল থেকেই শহর ও গ্রামের বায়ুদূষণ মাত্রা তুল্যমূল্য। কিন্তু ২০১৯-এ প্রচুর ঢক্কানিনাদ করে দেশের বায়ুদূষণ কমাতে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প এল শুধুমাত্র শহরের জন্য!

Advertisement

রাজ্যস্তরেও একই ছবি। গবেষণা অনুযায়ী, এ রাজ্যে গত কয়েক বছর ধরেই শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামে দূষণের পরিমাণ বেশি হলেও, কলকাতা-সহ হাতেগোনা শহরেই মূলত দূষণ কমাতে খানিকটা মাঠে নেমেছে পরিবেশ দফতর ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। গ্রাম তাদের ভাবনাতেও নেই। অথচ, রাজ্য দূষণ পর্ষদের নিজের রিপোর্টই বলছে যে, কালিম্পং বাদ দিয়ে রাজ্যের সব জেলায় বায়ুদূষণ অনুমোদিত সীমার উপরে। এমনকি বাঁকুড়ার মতো গ্রামভিত্তিক জেলা দূষণ দৌড়ে কলকাতার সামনে।

এই ছবি পরিবেশের অন্যান্য ক্ষেত্রেও। ২০১৬ সালে আবর্জনা ব্যবস্থাপনার নতুন আইন হয়েছে। অথচ, রাজ্যের এক শতাংশ গ্রামেও ২০২২ অবধি সে আইন প্রয়োগ হয়নি। এ রাজ্য পৃথিবীর ২৬০০টি অঞ্চলের মধ্যে জলবায়ু বিপন্নতার নিরিখে ৬০ নম্বরে, দেশের মধ্যে চার নম্বরে থাকলেও এবং সুন্দরবন, দার্জিলিং-সহ বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার বহু গ্রামাঞ্চল সে বিপুল বিপন্নতার শরিক হলেও সরকারি কোনও হেলদোল নেই। তথ্য এ-ও বলছে যে, রাজ্যে বনাঞ্চল কমছে এবং তা মূলত পঞ্চায়েত অঞ্চলে, রাজ্যের আর্সেনিক আক্রান্ত অঞ্চলে মাটির তলার দূষিত জল দিয়ে অবাধ চাষাবাদ চলছে। কীটনাশক ব্যবহারে রাজ্য দেশের মধ্যে প্রথম সারিতে। গ্রামাঞ্চলে প্রায় বারো হাজার বেআইনি ইটভাটা চলছে প্রশাসনের নাকের ডগায়।

অবশ্য গ্রামের এই পরিবেশ বিপন্নতা শুধু রাজ্যের বা দেশের নয়, গোটা বিশ্বের। গ্লোবাল ফুড পলিসি রিপোর্ট ২০১৯ জানাচ্ছে যে, বিশ্বে প্রায় ৪৫ শতাংশ লোক এখন গ্রামে থাকেন। আর অতি গরিব মানুষের ৭০ শতাংশ থাকেন গ্রামে। রিপোর্ট আরও বলছে যে, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ বা বনাঞ্চল ধ্বংসের ঘটনা গ্রামেই ঘটে বেশি।

তবে সব দোষ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী বা প্রশাসনকে দিলে হবে না। নির্বাচনের সময় খানিকটা সরব হলেও সাধারণ ভাবে রাজনীতি বাদ দিয়ে গ্রাম নিয়ে রাজ্যের গড়পড়তা বুদ্ধিজীবীরা বিশেষ মাথা ঘামান না। পরিবেশের প্রশ্নে তো নয়ই। এমনিতেই আর্থসামাজিক ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে একটা বড় অংশের কর্মক্ষম মানুষ গ্রাম থেকে আজ শহরমুখী। এর সঙ্গে যদি গ্রামের মানুষ আরও বেশি করে পরিবেশ, জনস্বাস্থ্যের সমস্যায় পড়েন, তা হলে শহরে আসার প্রবণতা আরও ত্বরান্বিত হবে। গ্রাম-শহরের জীবন-জীবিকার ভারসাম্য টলে যাবে।

বহু দশক আগে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার কথা উঠেছিল। এখন শহরই বরং আষ্টেপৃষ্ঠে ঘিরে ফেলছে গ্রামকে। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলি সামাজিক উন্নয়নের দিকে নজর না দিলে গ্রামের সঙ্কট ক্রমেই বাড়বে। শেষ পর্যন্ত গ্রামে পড়ে থাকবেন হতদরিদ্র কিছু মানুষ, যাঁদের ইচ্ছা থাকলেও শহরে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। আর থাকবেন কিছু আধা বা পুরো নেতা, সঙ্গে তাঁদের আজ্ঞাবহ এক শ্রেণি, যারা অবাধে দুর্নীতি করে যাবে, সরকারি সাহায্যের নয়ছয় করবে। এই অঙ্কে পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য কোথাও নেই।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement