নতুন গণক্ষমতার উত্থান
TMC

বামপন্থীরা এই বার জনবাদীদের দিকে হাত বাড়াবেন কি

যে ৩৮ শতাংশ দক্ষিণপন্থীদের ভোট দিয়েছেন, তাঁদেরও অনেককে আলাপচারিতার পথে নয়া উদারনীতিবাদ ও ধর্মান্ধ জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে টেনে আনা যাবে।

Advertisement

রণবীর সমাদ্দার

শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০২১ ০৫:৪৪
Share:

এক নতুন ক্ষমতার উত্থান হল বাংলায়। এর ভিত্তি রূপে কাজ করেছে অতীতের কিছু উপাদান। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য। এই নতুন গণক্ষমতার আঙ্গিক চেনা-চেনা লাগলেও অনেকাংশে তা অচেনা, অপ্রত্যাশিত। তা অনেককে হতবাক করেছে। বিশেষত তাঁদের, যাঁরা অধোবর্গের রাজনীতির গতিপ্রকৃতির খবর রাখেন না।

Advertisement

নির্বাচনের ফল নিয়ে অনেক কাটাছেঁড়া হবে। সংখ্যাতত্ত্ববিদরা নানা ভাবে পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করবেন। কোন সম্প্রদায় কত অংশে কাকে ভোট দিয়েছেন, কোন অঞ্চলে কার পক্ষে কত ভোট পড়েছে, কোন পর্যায়ে ভোট কার পক্ষে কী পরিমাণে পড়েছে, এই সব আলোচনায় কিছু সত্য উঠে আসবে। তবু অধরা থেকে যাবে সেই রহস্য, বাংলার সামগ্রিক অঞ্চল বিন্যাস জুড়ে, সমস্ত অধোবর্গীয় জনসাধারণের মাঝে এই ব্যাপক সমর্থনের জোয়ার সৃষ্টি হল কী ভাবে? এই দুর্জ্ঞেয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্রথমেই এই স্বীকৃতি দিয়ে ভাবনা শুরু করতে হবে যে, গণক্ষমতার চরিত্র সাধারণ। এবং তা লোকপ্রিয়।

এই ক্ষমতা গণচরিত্র এবং সাধারণ চরিত্র অর্জন করেছে প্রশাসন পদ্ধতি ও রাজনীতির এক বিশেষ ভঙ্গির ভিত্তিতে। সম্ভবত একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে রাজ্যে নির্বাচনী ফলাফলে একটি রাজনৈতিক দলের একক প্রাধান্য এই মাত্রায় আগে দেখা যায়নি। এবং সেও বহু দশক আগের কথা। ভোট ও আসন, দু’দিক থেকেই জনবাদীদের প্রাধান্য সংশয়াতীত। তা এসেছে তৃণমূল স্তরে সাংগঠনিক ও বাহুবলের ভিত্তিতে, আবার আলাপচারিতার রাজনীতি অনুসরণ করেও। সৃষ্টিশীল প্রশাসন পদ্ধতিতে সমস্ত অধোবর্গীয় মানুষের উদ্দেশে ক্রমাগত বলতে হয়েছে যে, এই প্রশাসন সবার, তার জনকল্যাণমূলক নীতি ও কর্মসূচি ধর্ম, অঞ্চল, ভাষা ইত্যাদির প্রভেদ করে না। এই সরকার সবার নিরাপত্তায় ব্রতী। প্রশাসনব্যবস্থার সংস্কার ও গণমুখিতার মধ্যে দিয়ে গণক্ষমতা সাধারণ ক্ষমতা হয়ে উঠেছে।

Advertisement

এই ক্ষমতা লোকপ্রিয়ও। এমনটা হওয়া সম্ভব, যখন অধোবর্গীয় সমাজ ও সম্প্রদায়সমূহ নিজস্ব নিরাপত্তা এবং আকাঙ্ক্ষার আশ্বাস প্রশাসনের কাছ থেকে পায়, আবার এই আশ্বাসও পায় যে, সাধারণ নিরাপত্তা ও জনকল্যাণের অংশ রূপেই গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গত নিরাপত্তা পাওয়া যাবে। তাই উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি, হাওড়া, পূর্ব বর্ধমান, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, কলকাতা, উত্তর দিনাজপুর, মালদহ— দ্বিশতাধিক আসনের বিশাল অঞ্চল জুড়ে, জনজাতি এলাকার দলিত, সংখ্যালঘু, সামগ্রিক নারীসমাজ, ও কলকাতা-সহ নানা শহরের অধোবর্গীয় মানুষ লোকায়তিক প্রশাসনকে সমর্থন করেছে।

দলের সাংগঠনিক শক্তির পাশাপাশি প্রশাসনিক অভিমুখ বাংলার জনবাদী আন্দোলনকে অভূতপূর্ব আধিপত্যশালী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছে। প্রশাসনিক কর্মরীতির বিশেষ চরিত্রের কারণে তফসিলি জাতিদের জন্য সংরক্ষিত ৬৮টি আসনের মধ্যে জনবাদীরা পেয়েছে ৩৬টি, তফসিলি জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত ১৪টি আসনের মধ্যে ১১টি। অন্যান্য পশ্চাৎপদ জাতির কল্যাণের জন্য নানা প্রশাসনিক পদক্ষেপের ফলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিপুল অংশের সমর্থন এসেছে।

তৃতীয়ত, জনবাদী আন্দোলন গণতন্ত্রকে লোকায়তিক করেছে বাঙালির আত্মপরিচিতির দীর্ঘ যাত্রায় এক নতুন মোড় এনে। সংক্ষেপে, বাঙালির আত্মপরিচিতি, লোকায়তিক প্রশাসনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ, ক্রমাগত সংঘর্ষমুখী জনসমাবেশ, এই তিন উপাদানের ভিত্তিতে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন ধরনের ক্ষমতার উদয় ঘটেছে।

একটা প্রশ্ন থেকে যায়। বিশেষত বাংলার পটভূমিতে সংঘর্ষাত্মক রাজনীতির প্রসঙ্গে বামপন্থার কথা ভাবতেই হবে। যেমন ভাবতে হবে জনবাদী আন্দোলনের ঐতিহ্যের কথা। গত শতকের কুড়ির দশকে কৃষক প্রজা আন্দোলনের সূচনা। তার পর ফজলুল হক, মৌলানা ভাসানী, এমনকি সুভাষচন্দ্র বসু, সবাই জনবাদী পদ্ধতি অবলম্বন করে বাংলার স্বাতন্ত্র্য এনেছেন গণরাজনীতিতে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনীতির যে ধারা প্রসারিত করেছেন, তার মধ্যে বাংলার শতাব্দী ব্যাপী জনবাদী রাজনীতির ঐতিহ্যের ছাপ আছে। সংঘর্ষমূলক রাজনীতির নানা ঐতিহাসিক উপাদানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কিছু নতুন উপাদান: নারীসমাজের উপর গুরুত্ব, নির্দিষ্ট প্রশাসনিক পদ্ধতির উদ্ভাবন, সাধারণ কল্যাণ ও নিরাপত্তার সঙ্গে বিশেষ সম্প্রদায়সমূহের জন্য বিশেষ জনকল্যাণ নীতি।

এই তিনটি ক্ষেত্রেই বাংলার সাবেক বামপন্থীরা উদাসীন ছিলেন। আশির দশকের কিছু সীমিত সংস্কারে তাঁরা আটকে থাকেন, শেষ হয়ে যায় জনসমাবেশের বৈচিত্র, স্থবিরতা আসে। জনবাদী রাজনীতির তাৎপর্য উপলব্ধিতে অক্ষম হওয়ায় তাঁরা আর ঘুরেও দাঁড়াতে পারলেন না। সমাজের বদ্ধদশা কাটাতে যে পথ নিলেন, তা আত্মঘাতী হয়ে দাঁড়াল।

কিন্তু বামপন্থা কি শেষ হয়ে গেল? না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রক্ষা, অধোবর্গের সামাজিক সুরক্ষা, জনকল্যাণ নীতি, জনমুখী প্রশাসন পদ্ধতি, সর্বোপরি নারী ও কন্যাদের উপর বিশেষ গুরুত্ব ও গ্রামাঞ্চলে সরকারি ব্যয়বৃদ্ধি, এ সবের পিছনে দীর্ঘকালীন বামপন্থী চিন্তার প্রভাব আছে। বাংলার বামপন্থী ঐতিহ্য থেকে জনবাদ অনেক কিছু শিখেছে। বামপন্থা টিকে থাকবে নানা নতুন পন্থায়। সংঘর্ষের জন্য যে আত্মশক্তি ও আত্মভরসা চাই, তারও অন্যতম উৎস গণসংঘর্ষের রাজনীতির ইতিহাস। বামপন্থী ভাবনার ইতিহাস। কিন্তু দক্ষিণপন্থী উদারনীতিবাদী কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে বামপন্থী আন্দোলনের অস্তিত্ব আজ বাংলায় কোথায়? পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থা যে সাংগঠনিক রূপে রয়েছে, সংঘর্ষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? কোথায়ই বা আজকের প্রয়োজন অনুযায়ী উদ্ভাবনা, নতুন কর্মপদ্ধতি, নতুন চিন্তা?

তবু, ভুল বোঝার অবকাশ নেই, বামপন্থী সংঘর্ষের ইতিহাস বাংলার সামগ্রিক ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। ঠিক যেমন আজ আর কেউ তর্ক করেন না যে, ক্ষুদিরামের পথ বা বাঘা যতীনের পথ ঠিক ছিল কি না, অথবা গাঁধীজির পথের বিপরীতে সুভাষচন্দ্রের কর্মচিন্তা ঠিক ছিল কি না, তেমনই কেউ আর এ নিয়ে তর্ক করেন না যে, ষাট ও সত্তরের দশকের কৃষক ছাত্র বিদ্রোহ ঠিক ছিল কি না। এই সব ইতিহাস ঠিক ভুলের ঊর্ধ্বে। তা আমাদের সাধারণ সম্পদ, সাধারণ ঐতিহ্যের অন্তর্গত হয়ে গিয়েছে। আজ বামপন্থী সংঘর্ষ ও রাজনীতির ইতিহাসও তা-ই। এই সম্পদের উপর কারও বিশেষ স্বত্বাধিকার নেই। এই ঐতিহ্য সমস্ত মানুষের অবদানে তৈরি। জাতীয় আন্দোলনের ঐতিহ্যের দাবিদার যেমন কংগ্রেস একা নয়, তেমনই বামপন্থী ভাবনা ও কর্মের ঐতিহ্যের দাবিদার কোনও সংগঠন বা দল একা নয়। দাবিদার বহু মানুষ, বহু ভাবনা, বহু মন। সংঘর্ষমূলক চৈতন্য ও রাজনীতিতে বামপন্থার অবদানকে নতুন দৃষ্টিতে ভাবতে হবে, বিশেষ সংগঠনের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়। মূল কথা, গণমুখী কর্মনীতির মধ্য দিয়ে সংঘর্ষমূলক রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। নয়া উদারনীতিবাদী উগ্র জাতীয়তাবাদী আগ্রাসী ক্ষমতাকে প্রতিরোধের জন্য চাই ব্যাপকতম জনবাদী রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতি। এই নির্বাচন চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়েছে। সঙ্কীর্ণতার স্থান এখানে নেই।

তাই বিধানসভায় বামপন্থীদের অনুপস্থিতি নিয়ে জনবাদী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খেদোক্তিতে বাস্তবের ছাপ আছে। বামপন্থী চিন্তাভাবনার সঙ্গে জনবাদী ভাবনার আলাপ শুরু হলে বাংলার সব মানুষের লাভ। নারীসমাজ, দলিতসমাজ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, শহরের অধোবর্গীয় জনগোষ্ঠী— এই বিশাল জনসাধারণ একাধারে জনবাদী, অন্য দিকে বামপন্থী। এরাই জনবাদীদের মানসিক শক্তি জুগিয়েছে। এই কারণেই বামপন্থী জনগণের বিপুলাংশ জনবাদীদের ভোট দিয়েছেন, নইলে তৃণমূলের সমর্থন পাঁচ শতাংশ বাড়ল কী ভাবে?

করোনার আগ্রাসে বাংলা বিধ্বস্ত। হাজারে হাজারে মানুষ মারা গিয়েছেন, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা ধ্বংস হয়েছে। তীব্র সামাজিক যুদ্ধ, যা প্রায় গৃহযুদ্ধের রূপ নিয়েছিল, বেশ কিছু মানুষের প্রাণ কেড়েছে। ক্রমাগত সংঘর্ষে বাংলা ক্লান্ত। জনরাজনীতির স্বার্থেই এই হিংসা বন্ধ হওয়া দরকার অবিলম্বে। সেই কাজে বামপন্থীরা জনপ্রতিনিধিদের দিকে সহায়তার হাত বাড়ালে, রাজনৈতিক কথোপকথন শুরু হলে, বাংলার মানুষের লাভ হবে। জনবাদী ও বামপন্থীদের রাজনৈতিক আলাপ গণরাজনীতির এগোনোর পথ প্রশস্ত করবে।

সর্বাগ্রে প্রয়োজন, জনসমর্থনের যে ব্যাপক জোয়ার দেখা গেল তার ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে সম্মান দেওয়া। নির্বাচকমণ্ডলীর প্রায় অর্ধাংশ যে দৃঢ়তা দেখালেন, তা থেকে শিক্ষা নেওয়া। যে ৩৮ শতাংশ দক্ষিণপন্থীদের ভোট দিয়েছেন, তাঁদেরও অনেককে আলাপচারিতার পথে নয়া উদারনীতিবাদ ও ধর্মান্ধ জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে টেনে আনা যাবে।

তবে সংঘর্ষ থাকবেই। সামাজিক শান্তি অস্থায়ী, সামাজিক দ্বন্দ্ব স্থায়ী। অন্তত এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের জনবাদীদের মতো আর কোনও শক্তি এই সত্য এত উপলব্ধি করেনি। তার কারণ, ভাল হোক মন্দ হোক, জনতাকে অবলম্বন করে তাদের জীবন। তাদের ব্যর্থতা ও সাফল্য এই বাস্তবতায় নিহিত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement