অবতীর্ণ: ভোটের প্রচারে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট, রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প, নেভাডা, ৩১ অক্টোবর। ছবি রয়টার্স।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন তা হলে এসে গেল। সব সমীক্ষাই বলছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প বনাম কমলা হ্যারিসের লড়াইটা হাড্ডাহাড্ডি— ট্রাম্প হয়তো এক কদম এগিয়েই আছেন। রাষ্ট্রনেতা হিসাবে তিনি উপযুক্ত কি না, সে বিচার করতে গেলে সুকুমার রায়ের ‘সৎপাত্র’ কবিতার শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গতি নেই। ২০২০ সালে তিনি পরাজয় স্বীকার করতে চাননি, সমর্থকরা আমেরিকান কংগ্রেসের উপরে আক্রমণ করে একটা গণ-অভ্যুত্থানই ঘটিয়ে ফেলেছিল প্রায়। আর্থিক দুর্নীতি থেকে যৌন হেনস্থা, বহু ব্যাপারেই ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রমাণ-সহ ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে। তিনি দৃশ্যতই আত্মসর্বস্ব এবং অন্তঃসারশূন্য এক জন মানুষ, গণতন্ত্রের তোয়াক্কা করেন না, কথাবার্তা অসংলগ্ন এবং নানা বিদ্বেষে ভরপুর। আমেরিকা তবু ‘পুনর্মূষিকো ভব’ আজ্ঞা পালন করতে চলেছে দেখে সারা বিশ্ব স্তম্ভিত।
ট্রাম্প একা নন। ভ্লাদিমির পুতিন, জাইর বোলসোনারো, রেসেপ এর্দোয়ান, ভিক্টর ওরবান— এমন নির্বাচিত স্বৈরাচারীদের আবির্ভাব চারিদিকেই ঘটছে। সারা পৃথিবীতে, বিশেষত উন্নত দেশগুলোয়, এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী, দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান লক্ষণীয়। আমেরিকার গত এক দশকের নির্বাচনী তথ্য বিশ্লেষণ করলে আরও অবাক হতে হয়। বাম-ঘেঁষা ডেমোক্র্যাটরা শ্রমজীবী, দরিদ্র, অশ্বেতাঙ্গ ইত্যাদি সম্প্রদায়ের বিপুল সমর্থন সচরাচর পেয়ে থাকেন, কিন্তু সেখানে পরিষ্কার ভাঙন ধরেছে। ও-দিকে কলেজে পড়া, উদারপন্থী সচ্ছল শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়, কর্পোরেট জগতের একাংশ, দক্ষিণ-ঘেঁষা রিপাবলিকান পার্টির মোহ কাটিয়ে ডেমোক্র্যাটদের দিকে ঝুঁকছেন। গত চার দশকের ক্রমবর্ধমান আর্থিক বৈষম্য ট্রাম্পের উত্থানের পিছনে একটা চালিকাশক্তি। কিন্তু পিছিয়ে পড়া বর্গের সমর্থন কী করে পথ ভুলে বাম থেকে দক্ষিণে পৌঁছে গেল, সে রহস্য ভেদ করা সহজ নয়।
অস্ট্রিয়ান অর্থনীতিবিদ জোসেফ শুম্পিটার বলেছিলেন, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ইঞ্জিন হল ‘ধ্বংসাত্মক সৃজন’। মোটরগাড়ির আবির্ভাবে সহিস এবং কোচওয়ানরা বিদায় হলেন, কম্পিউটার আসার পর টাইপিস্টদের বাজার আর রইল না। এই শতাব্দীতে আমেরিকায় মাথাপিছু জাতীয় আয় বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। দেশটার আর্থিক সমস্যা বদ্ধ ডোবার থেকে উৎপন্ন হয়নি, বরং খরস্রোতা নদীই তার উৎস। এই আর্থিক বৃদ্ধির কারণের দিকে তাকালে বোঝা যায়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অবাধ প্রসার এবং প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি অর্থনীতিকে আমূল বদলে দিয়েছে, সমৃদ্ধও করেছে। কিন্তু সর্ষের মধ্যেই ভূত— প্রগতি আর বৈষম্যের উৎস যে একই।
কলকারখানা হয় স্বল্প মজুরি আর আর্থিক উদারনীতির সুযোগ নিয়ে রওনা দিয়েছে চিন, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশে; নয়তো রোবট, মেশিন আর কম্পিউটারের সাহায্যে শ্রমিকের প্রয়োজনটাকেই দিয়েছে ঘুচিয়ে। তার উপরে আমেরিকার বয়স বাড়ছে, অবসরপ্রাপ্ত মানুষের অনুপাত ঊর্ধ্বমুখী— অতএব অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশি শ্রমিকের আমদানির প্রয়োজন। কিন্তু সেই প্রতিযোগিতায় নিম্নবিত্ত নাগরিকদের মাইনে ও আয় থমকে গিয়েছে। পরিবেশ বিজ্ঞান বলছে, ফসিল উদ্ভূত জ্বালানির প্রভাবে পৃথিবী যে তেতে উঠছে, তার ফল হবে মারাত্মক। অতএব সৌর বা বায়ুভিত্তিক শক্তির উপরই আমাদের দ্রুত নির্ভরশীল হতে হবে। কিন্তু এই সবুজ বিপ্লবের ফলে তেল আর কয়লার খনি বন্ধ হচ্ছে, এবং অনেক মেহনতি মানুষের রুটি রোজগারেই পড়েছে টান।
নয়া আমেরিকান অর্থনীতিতে আজ শ্রমজীবীর চেয়ে বুদ্ধিজীবীর মূল্য অনেক বেশি। অথচ জনগণের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ কলেজের চৌহদ্দি মাড়াননি। তাঁদের কাছে এ সব উন্নয়ন নয়, ঘোর আর্থিক সঙ্কট। দুই প্রধান রাজনৈতিক দল শ্রমজীবী মানুষের সুরক্ষা কবচ তৈরি করার কোনও উপায় বাতলে উঠতে পারেনি। মনে হয়, ট্রাম্প যাকে বলেছেন ‘আমেরিকান কার্নেজ’, সেই ঘোরতর সমস্যার আকার ও প্রকার বুঝে উঠতেই তাঁরা এখনও হিমশিম খাচ্ছেন। এখানেই ট্রাম্পের বাজিমাত। তিনি একটা সহজ সরল রাস্তা দেখিয়েছেন, আর রাজনৈতিক বিকল্প খুঁজে না পেয়ে তাঁর লক্ষ লক্ষ সমর্থক সে পথে হাঁটতে রাজি। মাথা না থাকলে যেমন মাথাব্যথা থাকে না, তেমনই উন্নয়নের উৎসগুলো বিসর্জন দিলে তদ্ভূত বৈষম্যের মোকাবিলা করার দায়টাও ঘুচে যায়। সংক্ষেপে বলতে গেলে এটাই ট্রাম্পের মূলমন্ত্র, তাঁর রাজনীতির তুরুপের তাস।
ট্রাম্প হুঙ্কার দিয়েছেন: কড়া শুল্ক চাপিয়ে আমদানি-রফতানির বারোটা বাজাবেন, বিদেশিদের দেশছাড়া করবেন, আমেরিকাকে করে তুলবেন অন্তর্মুখী। পরিবেশের ক্রমবর্ধমান উষ্ণতার তত্ত্ব একটা ভাঁওতা, এ কথা তাঁর ও তাঁর সমর্থকদের মুখে প্রায়ই শোনা যায়। প্রযুক্তির গ্রাস থেকে শ্রমিকদের উদ্ধার করার কোনও উপায় এখনও বাতলাননি, তবে আমরা অপেক্ষায় আছি। ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন’ বা ‘আমেরিকা আবার মহান হোক’ স্লোগানটির প্রকৃত অর্থ হল, আমেরিকা ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির ভেক ছেড়ে ফিরে যাক উৎপাদননির্ভর অর্থনীতির বেশে। সেখানে ডিগ্রিধারীদের সিলিকন ভ্যালি নয়, মধ্য পশ্চিমের ধসে-পড়া শিল্পাঞ্চল আবার রমরম করে উঠুক।
২০১৬ সালের নির্বাচনী প্রচারে হিলারি ক্লিন্টন ট্রাম্প সমর্থকদের ‘অপদার্থের দল’ আখ্যা দিয়েছিলেন। উদারমনস্ক মানুষেরা ভাবতে ভালবাসেন যে, ট্রাম্পের সমর্থনের পিছনে কাজ করছে শুধু অশিক্ষা, বর্ণবিদ্বেষ, জাত্যভিমান, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ইত্যাদি। সেটাই কিন্তু পুরো সত্য নয়। অর্থনৈতিক অস্থিরতা মানুষের মনে বিদ্বেষের বীজগুলোকে অঙ্কুরিত হতে সাহায্য করে, এটা ইতিহাসে বার বার দেখা গিয়েছে। বামমনস্ক ডেমোক্র্যাটদের রাজনৈতিক কর্তব্য প্রগতির সঙ্গে সাম্যের মেলবন্ধন কী ভাবে করা যায়, তার সুচিন্তিত নীতি নির্ধারণ। মুক্ত বাণিজ্য, প্রযুক্তির বিস্তার, পরিবেশ সুরক্ষা আর দেশের সীমা অতিক্রম করে মানুষের অবাধ যাতায়াত, এ সব জলাঞ্জলি না দিয়েও যে আমেরিকার শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা যায়, সে সম্ভাবনার কথা এবং তার পথনির্দেশ তাঁরা এখনও জোর গলায় জানাতে পারেননি। ডেমোক্র্যাট দলটার প্রকৃতিই হয়তো বদলে গেছে। রুজ়ভেল্টের শ্রমিক, কৃষক, সংখ্যালঘুর জোট আজ ডিগ্রিধারী ও কর্পোরেট সমাজের প্রতিনিধি, তাঁদের বোধ ও শ্রেণিস্বার্থ দ্বারা চালিত।
অর্থনীতির বিশদ আলোচনা এখানে সম্ভব নয়, তবু বলি, পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জাতীয় আয়ে পুঁজিপতিদের অংশটা ক্রমবর্ধমান, অর্থাৎ মাইনেকড়ির তুলনায় শেয়ারবাজার ইত্যাদি থেকে আয় আরও দ্রুত বেড়ে চলেছে। তার সুবিধা অবশ্যই কমসংখ্যক বিত্তবান মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ বিত্তজাত আয়ের উপরে করের হার শ্রমজাত আয়ের উপরে প্রযোজ্য হারের চেয়ে কম। বার্নি স্যান্ডার্স, এলিজ়াবেথ ওয়ারেন প্রমুখ ডেমোক্র্যাট নেতা সম্পত্তির উপরে কর চাপানোর কথা বলেছেন, সরকারের থেকে সব নাগরিকের জন্য ন্যূনতম আয়ের ব্যবস্থাও আলোচনায় উঠে এসেছে। এঁরা কিন্তু নিজের দলেই ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছতে পারেননি। কথাবার্তা এ দিকে মোড় নিলেই গেল-গেল রব ওঠে, সমাজতন্ত্র নামক জুজুর ভয় দেখিয়ে কথাটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। ট্রাম্প সমর্থকরাও আর্থিক পুনর্বণ্টন নীতির ভক্ত নন। কারণ আমেরিকা শুধুই পরিশ্রম ও মেধার মূল্য দেয়, বিদেশিদের শায়েস্তা করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে— এমন আকাশকুসুম ধারণা তাঁদের মনেও বদ্ধমূল।
এ ধারণার বিরুদ্ধে জলজ্যান্ত উদাহরণ ট্রাম্প নিজেই। ট্রাম্পকে ধুরন্ধর ব্যবসায়ী বলে অনেকেই ভাবেন। আদতে তাঁর প্রায় সমস্ত ব্যবসাই লাটে উঠেছে, ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া সত্ত্বেও। তাঁর ধনদৌলত প্রধানত পিতৃদত্ত, বাকিটা নিরন্তর আত্মপ্রচারের ফসল। যে সম্পত্তি ও প্রতিপত্তির উৎস সমাজের উন্নতিসাধন নয়, নিছক সৌভাগ্য বা দুরাচার, তার উপরে কর চাপাতে দ্বিধা কেন?
মাস দুয়েক আগে এক আততায়ীর গুলি ট্রাম্পের কান ঘেঁষে গিয়েছিল। আগামী ৫ নভেম্বর ট্রাম্প নামক গুলি আমেরিকান গণতন্ত্র ও ধনতন্ত্রের কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেলেও যেতে পারে। তবু ‘পশ্চাতে রেখেছ যারে, সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’, এই সত্য ভুলে গেলে আমেরিকার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আখেরে পস্তাবেন। ট্রাম্প শুধু এক ব্যক্তি নন, তিনি এক আর্থসামাজিক রোগের লক্ষণও বটে।