‘পাখির চোখ’ নির্বাচন
BJP

রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ বলেও উত্তরপ্রদেশে ভোটের এত গুরুত্ব

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপিকে নিজের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে হলে উত্তরপ্রদেশের ভোটে শুধু জিতলে চলবে না, ২০১৭-র মতোই বড় ব্যবধানে জিততে হবে।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৪:৩৬
Share:

জনজোয়ার: অমিত শাহের প্রচারসফর ঘিরে সমর্থকদের উদ্দীপনা। মুজফ্ফরনগর, ২৯ জানুয়ারি, ২০২২

ইন্দিরা গান্ধী তখন প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু দলে তখনও তাঁর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব কায়েম হয়নি। ছড়ি ঘোরাচ্ছেন কংগ্রেসের সিন্ডিকেটের প্রবীণ নেতারাই। সুযোগের অপেক্ষা করছেন ইন্দিরা। আচমকাই রাষ্ট্রপতি জাকির হুসেনের মৃত্যুর ফলে অসময়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দরকার হয়ে পড়ল। ইন্দিরাও সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করলেন।

Advertisement

১৯৬৯-এর সেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য ইন্দিরা কংগ্রেসের প্রার্থী হিসাবে জগজীবন রামের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। যুক্তি ছিল, মহাত্মা গান্ধীর জন্মশতবর্ষে এক দলিত নেতা রাষ্ট্রপতি হলে গান্ধীকেও শ্রদ্ধা জানানো হবে। কংগ্রেসের ‘ওল্ড গার্ড’ মানেননি। তাঁরা নীলম সঞ্জীব রেড্ডিকে প্রার্থী করেন। ইন্দিরা তা মেনে নিতে বাধ্য হন।

খেলা অবশ্য সেখানেই শেষ হয়নি। তত দিনে ভি ভি গিরি নির্দল প্রার্থী হিসাবে নিজের নাম ঘোষণা করে দিয়েছেন। ইন্দিরা কংগ্রেসের সংসদীয় দলের নেত্রী হিসাবে সঞ্জীব রেড্ডিকে ভোট দেওয়ার হুইপ জারি করতে অস্বীকার করলেন। তাঁর অনুগামীরা বিবেকের কথা মতো ভোট দেওয়ার ডাক দিলেন। দেখা গেল, কংগ্রেসের সরকারি প্রার্থী রেড্ডিকে হারিয়ে গিরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিতলেন।

Advertisement

এর পরে আর ইন্দিরা ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের এক দলে থাকা সম্ভব ছিল না। কংগ্রেস ভেঙে দু’টুকরো হয়ে গেল। ইন্দিরার কংগ্রেসই আসল কংগ্রেস হয়ে উঠল। কংগ্রেসে তাঁর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠান হল।

আগামী জুলাই মাসে ফের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। রাষ্ট্রপতি পদে রামনাথ কোবিন্দের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে এই নির্বাচন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের কাছে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই বিরোধী শিবিরের কাছে। গোটা দেশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা এখনও অটুট থাকতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লোকসভা, রাজ্যসভার সাংসদ ও রাজ্যের বিধানসভার বিধায়করা ভোট দেন। তাঁদের ভোটের মূল্য নির্ধারিত হয় রাজ্যের জনসংখ্যার ভিত্তিতে। সেই সমীকরণ বলছে, মোদী-শাহের পক্ষে রাষ্ট্রপতি পদে নিজেদের প্রার্থী জিতিয়ে আনা একেবারে সহজ হবে না। তার জন্য অনেক মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপিকে নিজের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে হলে উত্তরপ্রদেশের ভোটে শুধু জিতলে চলবে না, ২০১৭-র মতোই বড় ব্যবধানে জিততে হবে। অমিত শাহ কিছু ভুল বলেননি। শুধু ২০২৪-এ নরেন্দ্র মোদীর ফের বিজয় নয়, ২০২২-এ মোদীর মনোনীত রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর জয়ও উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের জয়ের উপরে নির্ভর করছে।

মোদী-শাহেরা কোনও ভাবেই চাইবেন না, লোকসভা ভোটের আগে বিরোধী শিবিরের কোনও নেতা রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে বসুন। উল্টো দিকে বিরোধী শিবির এককাট্টা হয়ে নিজেদের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে পারলে লোকসভা ভোটের আগে বার্তা যাবে, বিজেপির বিজয়রথ থামিয়ে দেওয়া সম্ভব। সমীকরণ বলছে, বিরোধীদের সঙ্গে কংগ্রেস, বিজেপির থেকে সমান দূরত্ব নিয়ে চলা দলগুলি মিললে তা সম্ভব। বিজেপিকে জিততে হলে বিরোধীদের এই শিবিরে ভাঙন ধরাতে হবে। কিছু আঞ্চলিক দলকে নিজের দিকে টানতে হবে। যার অর্থ একটাই। রাষ্ট্রপতি পদের এই নির্বাচন আক্ষরিক অর্থেই টানটান উত্তেজনার রাজনৈতিক থ্রিলার হয়ে উঠতে পারে।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লোকসভা ও রাজ্যসভা মিলিয়ে ৭৭৬ জন সাংসদ, রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির ৪১২০ জন বিধায়ক ভোট দেন। তাঁদের মাথা পিছু ভোটের মূল্য নির্ভর করে রাজ্যের সাংসদ বা বিধায়ক সংখ্যা, এবং ১৯৭১ সালের জনসংখ্যার ভিত্তিতে। এই হিসাবে মোট ভোটের পরিমাণ ১০ লক্ষ ৯৮ হাজার ৯০৩টি। ৫ লক্ষ ৪৯ হাজার ৪৫২টি ভোট পেলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা মেলে। স্বাভাবিক ভাবেই জনসংখ্যা, সাংসদ ও বিধায়ক সংখ্যার ভিত্তিতে সবচেয়ে বেশি ভোট উত্তরপ্রদেশের। তার পরে মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গ। চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে বিহার ও তামিলনাড়ু।

লোকসভায় বিজেপির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও রাজ্যসভায় বিজেপি শিবির ও বিরোধী শিবিরের শক্তি প্রায় সমান সমান। উত্তরপ্রদেশ ছাড়া বড় রাজ্যগুলির মধ্যে বিজেপি এখন মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, কর্নাটকের মতো রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে। বিহারে বিজেপি জোটের শরিক। মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ুতে আঞ্চলিক দল ক্ষমতায়, কংগ্রেস জোটের শরিক। পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লি, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানার মতো রাজ্যে অ-কংগ্রেসি, অ-বিজেপি দল ক্ষমতায়। অঙ্ক বলছে, এনসিপি সুপ্রিমো শরদ পওয়ারের মতো কোনও নেতা যদি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী জোটের প্রার্থী হন এবং তিনি তৃণমূল, বিজু জনতা দল, টিআরএস, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, আম আদমি পার্টির সমর্থন আদায় করে ফেলতে পারেন, তা হলে বিজেপির পক্ষে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেতা কঠিন। মোদী সরকার চাইবে না, রাষ্ট্রপতি পদে এমন কেউ থাকুন, যিনি আগামী দু’বছরে ৩৭০ রদ করা বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করার মতো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন।

গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কোবিন্দ ৬৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিলেন। কারণ লোকসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার পাশাপাশি বিজেপি তখন সিংহভাগ রাজ্যে শাসন করছিল। গত কয়েক বছরে তেলুগু দেশম, শিবসেনা ও অকালি দলের মতো শরিকরা বিজেপির সঙ্গ ত্যাগ করেছে। এই পরিস্থিতিতে তৃণমূল, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, বিজু জনতা দল, টিআরএস-এর মতো দলগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কারণ নিজেদের রাজ্যে ক্ষমতাসীন দলগুলির হাতে একই সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদ ও বিধায়কদের ভোট রয়েছে। এই দলগুলি যদি বিজেপির প্রার্থীকে সমর্থন করে, তা হলে তিনি সহজে জিতে যাবেন। আর এরা যদি কংগ্রেস তথা ইউপিএ-র প্রার্থীকে সমর্থন করে, তা হলে তাঁর জয়ের সম্ভাবনা যথেষ্ট। সর্বোপরি পওয়ারের মতো কেউ প্রার্থী হলে তিনি এনডিএ-র শিবির থেকেও ভোট টেনে আনতে পারেন।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, অন্ধ্র, তেলঙ্গানা, দিল্লিতে কোনও ভোট নেই। ফলে এই রাজ্যগুলির সাংসদ, বিধায়ক সংখ্যায় বদল হচ্ছে না। সামনে যে পাঁচটি রাজ্যে নির্বাচন, তার মধ্যে উত্তরপ্রদেশই একমাত্র বড় রাজ্য। বিজেপি সেখানে বিপুল ব্যবধানে হেরে গেলে এবং উত্তরাখণ্ড, পঞ্জাব, গোয়ার বিধানসভাতেও আসন খোয়ালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের লড়াইয়ে আগেই হেরে বসবে। বিজেপিকে শুধু উত্তরপ্রদেশে জিতলেই চলবে না, ৪০৩ আসনের বিধানসভায় যথেষ্ট বড় ব্যবধানে জিততে হবে।

আর একটি সম্ভাবনা অবশ্য রয়েছে। অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলে এনডিএ এ পি জে আবদুল কালামকে প্রার্থী করেছিল। কালাম এনডিএ বিরোধী শিবিরেরও ভোট পেয়েছিলেন। একই ভাবে প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে ইউপিএ-র বাইরের দলগুলিরও ভোট পেয়েছিলেন। বাম শিবিরেই ভাঙন ধরিয়েছিলেন। তৃণমূল, আম আদমি পার্টি, বিজু জনতা দল, ওয়াইএসআর কংগ্রস, টিআরএস— এই দলগুলি মুখে কংগ্রেস, বিজেপি থেকে সমদূরত্ব রেখে চলার কথা বললেও সংসদীয় রাজনীতিতে এদের মধ্যেও ফারাক রয়েছে। তৃণমূল ও আম আদমি পার্টি মোটের উপর সংসদে বিজেপি বিরোধিতাই করে থাকে। উল্টো দিকে বিজু জনতা দল, ওয়াইএসআর কংগ্রেস, টিআরএস কাজের বেলায় মোদী সরকারেরই পক্ষ নেয়।

এখন উত্তরপ্রদেশে বিজেপি যদি হেরে যায় বা জিতলেও আসন সংখ্যা কমে যায়, তা হলে এই আঞ্চলিক দলগুলি রাষ্ট্রপতির নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থীকে বিনা শর্তে সমর্থন না-ও করতে পারে। তখন তারাই হয়তো নিজেদের পছন্দমতো কাউকে প্রার্থী করে দর কষাকষি করতে পারে। আবার উল্টো দিকে বিজেপিও এমন কাউকে প্রার্থী করতে পারে যাতে বিরোধী শিবিরের মধ্যে থেকে তৃণমূল বা তামিলনাড়ুতে ডিএমকে-র সমর্থন পাওয়া যায়।

জুলাই মাসে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের বয়স ৭৬ বছর পেরিয়ে যাবে। সরকার বা দলীয় পদে বিজেপির ৭৫ বছরের ঊর্ধ্বসীমা মানলে তাঁকে ফের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করার সম্ভাবনা খুবই কম। সে দিক থেকে উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন মিটলেই রাজনৈতিক অঙ্ক কষে নতুন রাষ্ট্রপতি প্রার্থী খোঁজার কাজে নামতে হবে— বোঝাই যাচ্ছে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement