Nirmala Sitaraman

‘নির্মলা’ কর মঙ্গল করে, এই পরিকল্পনার সুফল মিলবে আগামী প্রজন্মে?

নির্মলা সীতারমনের বাজেট বক্তৃতা ও নানাবিধ প্রস্তাবকে এক কথায় প্রকাশ করে প্রায় সকলেই বলছেন ‘টোট্যাল—’।

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৩:০৭
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

প্রায় তিন দশক আগের কথা। বঙ্গের ময়দানে খেলা বলতে তখনও শুধু ফুটবল বোঝাত। সেই সময়, এক বার ১০ জন খেলোয়াড়কে কী ভাবে মাঠের দায়ভার নিতে হবে, সেই ছক কষা নিয়ে কোচ-বোদ্ধা-সমর্থকদের মধ্যে তুমুল বাগ্‌বিতণ্ডা শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেই যখন সাবেকি ৪-২-৪, তৎআধুনিক ৫-৩-২ কিংবা ইউরোপীয় ৪-৩-৩ না বেছে অমল দত্ত আমাদের একদম নতুন ‘ডায়মন্ড মডেল’ উপহার দিলেন, সেই তখনই সংবাদপত্রে শিরোনাম হল পিকে বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমোঘ উক্তি, ‘টোট্যাল ফুটবলের যুগে’ ছক নিয়ে কচকচিটাই অর্থহীন। তার পরেও আমাদের ময়দানে ফুটবলের মন্বন্তর হয়েছিল কেন, সেই বিতর্ক এখন থাক। তবে এটা মানতেই হবে, শতাব্দীসেরা মন্তব্য হিসেবে ‘টোট্যাল ফুটবল’ শব্দবন্ধটা আমাদের অভিধানে ঢুকে পড়ল। বাঙালির অভিমত বোঝাতে এর পরে ‘টোট্যাল’-এর মতো অনবদ্য বিশেষণ আর মেলে না।

Advertisement

নির্মলা সীতারমনের বাজেট বক্তৃতা ও নানাবিধ প্রস্তাবকে এক কথায় প্রকাশ করে প্রায় সকলেই বলছেন ‘টোট্যাল—’। সঙ্গত কারণেই হয়তো। বাজেট মানেই নানাবিধ বার্ষিক করকে কমানো-বাড়ানো নিয়ে এমন ছক কষা এ যুগে যে নিতান্তই অর্থহীন, তা নির্মলা, নির্মম ভাবেই, নির্মল যুক্তিতে ‘টোট্যালি’ বুঝিয়ে দিয়েছেন। যেন বাজেট হো তো অ্যায়সা হি— টোট্যালি টেকনিক্যাল। অর্থনীতি বোলে তো— টোট্যালি ডিজিটাল। উন্নয়ন হবে টোট্যালি থিয়োরেটিক্যাল আর ভবিষ্যতের দেশ টোট্যালি আত্মনির্ভর।

তবে এটা ব্যাজস্তুতি কি না তা বোঝা মুশকিল। এতে নির্মলার প্রশংসা না নিন্দা করা হচ্ছে, সেটা আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শ ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেবে।

Advertisement

‘টোট্যাল’-এর বাইরে বাংলার পছন্দের মতপ্রকাশের জন্য অন্যতম কোটেশন হল— ‘আজ যা খাই, কাল তার ফল পাই’। ‘কাল’ মানে যে ঠিক ২৪ ঘণ্টা পরের আগামী দিনের কথা বলা হচ্ছে না, সেটা শুরুতে আমরা ধরতেই পারিনি। নির্মলার এই বাজেটে ‘কাল’ হল ২৫ বছর পর ২০৪৭ সাল। যে দিন স্বাধীন দেশের শতবর্ষ হবে।

আর এখানেই আমাদের প্রত্যাশা মুখ থুবড়ে পড়ল। সাদা বাংলায় যাকে বলে, আমরা ‘ট্রাম্প’ খেয়ে গেলাম। ভাবছিলাম কয়েকটি রাজ্যে, বিশেষত উত্তরপ্রদেশে নির্বাচন সমাগত। অতএব বাজেট হবে ভোটমুখী; চটজলদি, তাৎক্ষণিক কিছু উপহারস্বরূপ করছাড় বা জিনিসের দাম কমানো। তা হল না। আশা ছিল অতিমারির পরে, পর্যুদস্ত খেটে খাওয়া মানুষগুলোর অন্তত মন চাঙ্গা করে তুলতে পারে এমন কিছু দাওয়াই। তা মিলল না। প্ল্যান করা হল আগামী দিনের কথা ভেবে।

২৫ বছর পরে মায়ের কী ‘মুরতি’ আমরা দেখতে চাই, সেটা কল্পনা করা এবং তার রূপদান করাটাও সরকারের কর্তব্য বইকি; সেই যুক্তিতে এই বাজেটও ‘জনমুখী’ নিশ্চয়। তবে বাজেট যেহেতু বার্ষিক, ২৫ বছর তো নয়ই, এমনকি, পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনাও নয়, তাই বিরোধীরা চটেছেন। আরও তো ২৪টা বছর আসবে। সেই সবগুলোই কি একই প্রকল্প শিরে ধার্য রেখেই এগোবে?

তাতে অবশ্য ভুল কিছু নেই। ভিন্ন অভিমত মাত্র। এখানেও বাঙালির উদ্ধৃতি মজুত আছে— ‘জীবনের নানা ওঠাপড়া’কে গায়ে মাখতে নেই। যেমন, ধরা যাক ‘ডিজিটালায়ন’। মানতেই হবে, সারা বিশ্ব জুড়েই আগামী দিনের অর্থনীতি ডিজিটাল হয়ে যাবে। ভারতীয় মুদ্রা হয়তো বা কোনও এক ডিজিটাল কারেন্সিতে পরিণত হবে; নিদেনপক্ষে সব লেনদেনই হবে স্মার্ট। পকেটে আর টাকা রাখতেই হবে না। সে দিনের জন্য আজ থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আর সে কাজটাই নির্মলা করলেন। তাতে এক্ষুনি পেটে ভাত না-ই বা জুটল; একশোর ভারত তো একশোয় একশো।

একই চিন্তার ফল, ‘পাবলিক স্পেন্ডিং’— জনগণের জন্য সরকারের ব্যয়। নানাবিধ পরিকাঠামো খাতে। এর সুফল আক্ষরিক অর্থেই একাধিক। ইকনমিক্সের পাঠ্যপুস্তক থেকে তুলে আনা একটা কথা বারংবার উচ্চারিত হল— ‘মাল্টিপ্লায়ার এফেক্ট’। গুগ্‌লের দুনিয়ায় এটা খায় না মাথায় দেয়, তা ব্যাখ্যা করা বাতুলতা। তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, অর্থনীতির এই থিয়োরিটার বিরোধিতা করা মূর্খামি। উন্নয়নের পরিমাণ ‘মাল্টিপ্লায়ার’ বা এক গুণের বেশি হতে বাধ্য। সরকার এক টাকা খরচ করলে বাজারে এক টাকার বেশি ঢুকবে, এটা যে শুধু অঙ্কে প্রমাণিত তা নয়, পরীক্ষিত সত্যও বটে।

বরঞ্চ, বিরোধীরা ‘নারা’ তুলবেন অন্যত্র। তুললেনও। যখনই বেসরকারি উদ্যোগের কথা উঠল। উৎপাদনশীলতা, কর্মসংস্থান বাড়ানোর একমাত্র উপায় কিংবা আবশ্যিক শর্ত কি বেসরকারিকরণ? প্রাইভেট-পাবলিক যৌথ ভাবে এগোতেই হবে আমাদের মতো দেশেও? এটার উত্তর তো অর্থনীতির বইয়ে এত সহজ ভাষায় লেখা থাকে না।

বাজারি মডেলের গোড়াতেই তো বৈষম্য। চাহিদা, জোগান মিলেই তো ধনতান্ত্রিক ইক্যুইলিব্রিয়াম। ‘অন’, ‘অ’, ‘বে’ উপসর্গগুলোকে ঘষে ঘষে মুছলেও যাকে উচিত নীতি বা আইনে পরিণত করা যাবে না কোনওদিনই। তা হলে এই বিশ্বব্যাপী প্রহসনে সরকার কী ভাবে আমাদের বাঁচাবেন? সে বিতর্ক হবেই, ২৫ বছর ধরে...।

ফিরে আসি ডিজিটাল ইকনমির কথায়। ‘টোট্যাল’ ডিজিটাল যুগ আসবেই। দাবায়ে রাখতে আমরা পারব না। তবে তার প্রস্তুতি হিসেবে মঙ্গলবার যা শুনলাম তা বেশ কষ্টকল্পিত। গ্রামে বিশুদ্ধ পানীয় জল নেই। দুয়ারে ইন্টারনেট এনে কী লাভ? এ ছাড়া আছে আরও দুইখান কথা। সুরক্ষা কোথায়? আর তথ্যভান্ডারের আইন? মা কী হইতে পারেন, তার মধ্যে কিন্তু কালী-করালি রূপও বিদ্যমান। ভবিষ্যৎ কে দেখেছেন?

(লেখক কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। মতামত নিজস্ব)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement