বছর দুয়েক আগে শাসক দলের এক প্রবীণ নেতা আমাকে দুঃখ করে বললেন, “আর রাজনীতি করা যাবে না।” জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? উনি বললেন, “এখন রাজনীতি করলেই লোকে চোর ভাবে।” এই কথায় দুঃখ পেয়েছিলাম, কিন্তু যাঁরা আমাদের সবাইকে চোর বলেন, তাঁদের উপর দোষারোপ করতে পারিনি। সব বাঘ মানুষ খায় না, কিন্তু বাঘ দেখলে আমরা সবাই ভয় পাই।
এই কথোপকথনের পর গত দু’বছরে অনেক দুর্নীতির অভিযোগ এবং সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ্যে এসেছে। সেগুলি এখনও আদালতে প্রমাণসাপেক্ষ। কিন্তু প্রথমলব্ধ ধারণার ভিত্তিতে সব অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া দুষ্কর। বিরোধীরা তারস্বরে চিৎকার করে স্লোগান দিয়ে বলেছেন, “তৃণমূলের সবাই চোর।” তা সত্ত্বেও ২০২৪-এর নির্বাচনে লোকসভায় তৃণমূলের আসনসংখ্যা ২২ থেকে বেড়ে ২৯ হয়েছে। তৃণমূলের ভোটের অনুপাত ২০১৯-এর ৪৩.৩% থেকে বেড়ে ২০২৪-এ ৪৫.৮% হয়েছে। রানার আপ ভারতীয় জনতা পার্টির অনুপাত ৪০.৭% থেকে কমে ৩৮.৭% হয়েছে। কংগ্রেস এবং সিপিএম ৫-৬% ভোট নিয়ে যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই বাঁচার লড়াইয়ে রয়ে গেছে।
প্রবাদ আছে, যা রটে তা কিছু তো বটে। কাজেই, মানুষ বিরোধীদের এই দুর্নীতির অভিযোগ একদম বিশ্বাস করেননি ভাবা অনুচিত হবে। তা হলে কি মানুষ বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে, চোরেদের প্রত্যাখ্যান করে, সৎ নেতাদের নির্বাচনে জয়ী করছেন না? আমার এক সন্দিগ্ধমনা মিত্র বললেন, “সেটা কী করে হবে? যদি সব প্রার্থীই চোর হয়?” তবে আমার মনে হয়, নির্বাচনের প্রার্থীরা— এমনকি তৃণমূলের প্রার্থীরাও— সবাই চোর, এ কথা বিশ্বাস করা শুধু কষ্টকর নয়, দুঃসাধ্য।
এ কথা নিশ্চিত যে, মানুষ আগের তুলনায় অনেক বেশি দুর্নীতি অনুভব করতে পারছেন। কিন্তু এই বর্ধিত দুর্নীতির অনুভবের প্রতিফলন লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে বিশেষ দেখা যায়নি। এ কথাও সত্য যে, সাম্প্রতিক নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গের মসনদের জন্য ছিল না। ছিল দিল্লির সিংহাসনের জন্য। গোয়া ও ত্রিপুরার বিধানসভা নির্বাচনের শোচনীয় পরিণামের পর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল মনে হয় দিল্লির মসনদের আশা আপাতত কিছু দিনের জন্য স্থগিত রেখেছেন। কিন্তু, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনকে ওঁরা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। যেন ধড়াচুড়ো পরে ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের রিহার্সাল। ২০২৪-এর নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী আবার পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক স্নায়ুর উপর তাঁর আধিপত্যের এবং সুদক্ষ নির্বাচনী কৌশলের পরিচয় দিয়েছেন।
বিগত নির্বাচনে বর্ধিত দুর্নীতির অনুভবের প্রতিফলনের অভাব যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের দুর্নীতি সম্বন্ধে একটা উদারপন্থী বা ক্ষমাশীল নৈতিকতার পরিচয়, সেটা অস্বীকার করা দুষ্কর। দুর্নীতির সংজ্ঞা হচ্ছে: শাসনক্ষমতার অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত ভাবে লাভবান হওয়া। খুব সম্ভবত দুর্নীতি-সহনশীলতা বাঙালির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়, রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার প্রচেষ্টা। অনেকটা মাঝদরিয়ায় পালতোলা নৌকার মাঝির স্বীকারোক্তি— হাওয়ার গতিপথ পাল্টাতে পারব না, আমি খালি আমার পালটিকেই এ দিক-ও দিক করতে পারি। উদারপন্থী মনোভাব দিয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রাখার প্রয়াস।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অনেক দিন ধরে দুর্নীতির কথা শুনে আসছেন, টেলিভিশনের পর্দায় দেখে আসছেন এবং সংবাদমাধ্যমে পড়ে আসছেন। ২০১২ সালে ছিল রোজ় ভ্যালি কেলেঙ্কারি, ২০১৩ সালে সারদা গোষ্ঠীর তিরোধান, এবং ২০১৪ সালে নারদ কেলেঙ্কারি। ২০১৬-তে এল পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগ। তার পর সেপ্টেম্বর ২০২০ সালে কয়লা কেলেঙ্কারি। তা ছাড়াও গরু, বালি, পাথর পাচারের অভিযোগ।
দুর্নীতির অভিযোগের সূত্রপাত তৃণমূল শাসনের অনেক আগে থেকে। বাম আমলে, ১৯৮৮ সালে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের (আরএসপি) নেতা পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পুত্র চন্দন বসুকে উপকৃত করার জন্য একটি সরকারি কাজ বেঙ্গল ল্যাম্পকে পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ আনেন। মুখ্যমন্ত্রী-পুত্র বেঙ্গল ল্যাম্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। পরিণামে, যতীনবাবুকে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়। বিনয় চৌধুরী ছিলেন মন্ত্রিসভায় জ্যোতিবাবুর পরেই— গুরুত্বের বিচারে দ্বিতীয় স্থানে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি উনি বলেন, “সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত। আঠারো বছর ক্ষমতাসীন থাকার পর, আমরা দুর্নীতির শিকার হয়েছি। এ কথা বলার জন্য আমাকে অনেকে পাগল বলতে পারেন, কিন্তু এটাই অপ্রিয় সত্য।” আর ২০১১ সালের ডিসেম্বরে, তৃণমূলের দ্বারা পরাজিত হওয়ার পর, সদ্যপ্রয়াত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেন, “আমাদের দলের সঙ্গে জড়িত কিছু লোক দলকে পয়সা উপার্জনের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করেছেন। মানুষ আমাদের পরাজিত করে তার জন্য শাস্তি দিয়েছেন।”
পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতির প্রচলন তৃণমূলের কৃতিত্ব নয়। অনেকের মতে, ওঁরা দুর্নীতিকে খালি পরিশীলিত এবং ব্যাপক করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ দুর্নীতির পরিপ্রেক্ষিতে, ২০২২ সালের জুলাই মাসে, বান্ধবীর ফ্ল্যাট থেকে প্রভূত পরিমাণ টাকাপয়সা, সোনাদানা এবং সম্পত্তির আবিষ্কার এবং বান্ধবী-সহ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতার হওয়া বাঙালিকে সাময়িক ভাবে বিচলিত করেছিল। বিরোধীরা এই আবিষ্কারকে দুর্নীতির অকাট্য প্রমাণ হিসাবে নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন, মিছিল বার করেছেন। ২০২৪-এর নির্বাচনে তার কোনও প্রভাব দেখা যায়নি কেন? এর উত্তর নিহিত আছে তিনটি নির্ণয়ে।
প্রথমত, মানুষ যদি সব রাজনৈতিক নেতাকেই চোর ঠাওরান, তবে এক জনের আর এক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনও তাৎপর্য থাকে না। মানুষের বিশ্বাস যে, বিরোধী পক্ষের শুধু ক্ষমতায় আসার অপেক্ষা— তার পর, যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ। নির্বাচন মানেই বিশাল জনসভা, প্রচুর গাড়িতে, বাসে, ট্রেনে, হেলিকপ্টার ও উড়োজাহাজে দৌড়াদৌড়ি, পথসভা, ফেস্টুন, পোস্টার, দেওয়াল লিখন ও কর্মী সম্মেলন। অত্যন্ত খরচসাপেক্ষ। তা ছাড়া দলের পূর্ণ সময়ের কর্মীদের, বিশেষত যাঁরা ধনী নন তাঁদের জীবিকানির্বাহের জন্য এবং দল চালানোর জন্য অর্থের প্রয়োজন। এই সব কারণে, রাজনৈতিক নেতাদের অর্থসংগ্রহের একটা বাধ্যবাধকতা সাধারণ মানুষ মেনে নিয়েছেন। উৎকোচ, তোলাবাজি, কাটমানি এবং কমিশনকে রাজনীতির অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করেছেন। এটা গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকারক, কিন্তু সরেজমিনে রাজনীতিতে জনগণের এই স্বীকৃতির প্রভাব উপেক্ষা করার উপায় নেই। এই স্বীকৃতিকে মনে রেখে, তৃণমূল এটাকেই ঘুরিয়ে দিয়ে, নির্বাচনে বিশেষ সাফল্য লাভ করেছে। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এত দীর্ঘ দিন ধরে দুর্নীতি দেখে দেখে এমনই ক্লান্ত যে দুর্নীতির অভিযোগ আর তাঁদের মনে দাগ কাটে না, সয়ে গিয়েছে।
তৃতীয়ত, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এখন দুর্নীতি নয়, দুর্নীতির প্রকারের উপর মন দিচ্ছেন। বাম আমলেও জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের লাভ এবং সরকারি চাকরি ছিল দলের অনুমোদনসাপেক্ষ। তৃণমূলের শাসনেও তা-ই রয়েছে। কিন্তু, বাম আমলে অনুমোদন আসত সিপিএমের জটিল পার্টি গ্রিডের বিভিন্ন স্তরের— বুথ কমিটি, ব্রাঞ্চ কমিটি, লোকাল কমিটি, এবং সর্বশেষ জেলা কমিটির— অনুমোদনের পরে। পদ্ধতিটি ছিল সময়সাপেক্ষ।
তৃণমূল পদ্ধতিটিকে প্রত্যেক এলাকায় কয়েকটি মানুষের মধ্যে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সরল এবং কম সময়সাপেক্ষ করেছে। আপনার শুধু জানতে হবে কিসের জন্য কার কাছে যেতে হবে, এবং কী নির্ধারিত মূল্য দিতে হবে। সত্বর আপনার কাজ হয়ে যাবে। মানুষ এটাকে গ্রহণ করেছেন, উৎকোচকে স্পিড মানি হিসাবে গণ্য করে এটা পশ্চিমবঙ্গের আটপৌরে জীবনের অবিচ্ছিন্ন অঙ্গ হিসাবে মেনে নিয়েছেন। প্রশ্ন দুর্নীতির ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছে— এখন বিচার দুর্নীতির কার্যকারিতা নিয়ে। এটা ইংরেজিতে যাকে বলে দুর্নীতির একটি ‘ইনস্ট্রুমেন্টাল ভিউ’। দুর্নীতির দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কথা ভুলে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ জিজ্ঞাসা করছেন, “চোর হ্যায় তো কেয়া হ্যায়?”