প্রতিহিংসার অস্ত্র ইতিহাস
Communal Violence

এ কালের অসহিষ্ণু দৃষ্টিতে সে কালের সংঘর্ষকে ধর্মীয় রং দেওয়া

হিন্দু জাতীয়তাবাদের যে সঙ্কীর্ণ চেহারা সাম্প্রতিক কালে মারমুখী হয়ে বহুত্ববর্জনকারী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জন্ম দিয়েছে

Advertisement

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০২১ ০৮:৫৮
Share:

গ্রহণ: চালুক্যরাজের দরবারে উপস্থিত পারস্যের দূত। ছবি সৌজন্য: উইকিমিডিয়া কমনস

লোককথার সেই ভেড়ার গল্পের যুক্তি মনে আছে? ভেড়াকে এসে এক সিংহ বললে, ‘তুই জল ঘোলা করেছিস, এ জল আমি খাই।’ ভেড়া বলল, ‘আমি তো জলঘোলা করিনি।’ সিংহের উত্তর, ‘তুই জল ঘোলা না করলে তোর বাবা করেছে।’ পূর্বপুরুষের কৃতকর্মের ফলে নির্দোষ ভেড়াটিকে সিংহ মেরে ফেলল। পূর্বপুরুষ, এই ভেড়ারই কোনও পূর্বপুরুষ, এ কাজ করেছিল কি না তা প্রমাণের দরকার হল না। আর যদি করেও থাকে জল ঘোলা তার দায় নির্দোষ ‘বর্তমান’ ভেড়াটির উপর পড়ার তো কথা নয়।

Advertisement

হিন্দু জাতীয়তাবাদের যে সঙ্কীর্ণ চেহারা সাম্প্রতিক কালে মারমুখী হয়ে বহুত্ববর্জনকারী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জন্ম দিয়েছে, তাকে দেখে এই লোককাহিনি মনে পড়ে। সেই রাজনীতির সমর্থনে অতীত ভারতের যে ইতিহাসের ছবি সমানেই তুলে ধরা হচ্ছে, তাতে মুসলমানদের হাতে হিন্দুদের কচুকাটা হওয়ার ঘটনাকেই বড় করে দেখানো দস্তুর। উদ্দেশ্যটা আলোর মতো স্পষ্ট। যে মুসলমানরা এ ভাবে হিন্দুদের নিকেশ করেছিল, তাদের উত্তরসূরি ভারতীয় মুসলমানদের এ বার দেখে নেওয়া চাই। প্রতিহিংসার রাজনীতিতে প্রতিহিংসার ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠার জন্য অতীত ঘটনার পুনর্কথন চলছেই, ক্রমাগত।

হিন্দুত্ববাদীদের বিরোধিতা করার জন্য এ কালের সেকুলারপন্থীরা প্রাগাধুনিক ভারতে মুসলমান আমলের নানা সম্প্রীতির ছবি তুলে ধরেন। তাতে অবশ্য হিন্দুত্ববাদীরা মোটেই দমে যান না, বরং বলতে থাকেন যে, সম্প্রীতির ছবি তুলে ধরে হানাহানির সত্যকে ঢেকে দেওয়া সেকুলারদের কৌশলমাত্র। হাল আমলের সংখ্যালঘু ভারতীয়দের তোষণের পথই তৈরি করছেন তাঁরা। হিন্দু-মুসলমানে হানাহানি যে হয়েছিল, সে কথাটা স্বীকারমাত্র করছেন না।

Advertisement

এই বাদানুবাদের মোকাবিলা করার একটা উপায় হতে পারে প্রাগাধুনিক ভারতে মুসলমান অতীত সম্বন্ধে সে কালের সংস্কৃত ভাষাবাহিত বিবরণগুলি পড়া। সংস্কৃত ভাষায় মুসলমানদের নানা বিষয় নিয়ে যাঁরা লিখেছেন, তাঁদের তো আর মুসলিমপন্থী বলা যাবে না। তা ছাড়া সে সব লেখায় হানাহানির কথা আছেও। তবে সেই বিবরণকে ঠিকমতো পড়তে জানা চাই। তাঁরা কী লিখেছেন, কী ভাবে লিখেছেন ও কেন লিখেছেন মুসলিম অতীতের কথা, তা আম-পাঠকের বোঝা চাই। তাঁদের লেখা কি এ কালের মতো হিন্দু-মুসলমান নামক দু’টি পৃথক যুযুধান চেতনার সূত্রেই লড়াইয়ের কথাকে ধর্মযুদ্ধ হিসেবে বিচার করছিল? সেই জরুরি কাজটিই তাঁর নতুন বই দ্য ল্যাঙ্গোয়েজ অব হিস্ট্রি: স্যান্সক্রিট ন্যারেটিভস অব মুসলিম পাস্ট-এ করেছেন অড্রে ট্রুস্‌ক। তাঁকে এ দেশের হিন্দুত্ববাদীরা এক্কেবারে পছন্দ করেন না। কী করেই বা করবেন! তাঁর আগের বইতে তিনি ঔরঙ্গজেব সম্বন্ধে ‘চলতি’ ভাবনার বিরোধিতা করেছেন। ভ্রাতৃঘাতী এই শাসককে তিনি একমাত্রিক ভাবে ‘হিন্দু-বিরোধী’ সম্রাট বলতে নারাজ। যুক্তির সপক্ষে প্রমাণ হাজির করতেও কসুর করেননি। অড্রের বক্তৃতা বানচাল করার জন্য হিন্দুত্ববাদীরা তাই মুখিয়ে থাকেন। ২০১৮ সালে হায়দরাবাদে তাঁর বক্তৃতা বন্ধ করে দিয়েছিলেন হিন্দুত্ববাদের মুখিয়ারা।

মুখ বন্ধ করলেও কি লেখা বন্ধ করা যায়? যায় না। ২০২১-এ অড্রে তাঁর বইতে প্রথমেই জানান দেন যে, প্রাগাধুনিক পর্বে হিন্দু-মুসলমানের হানাহানি হয়েছিল, আজকাল এ কথা আমরা যখন বলি, তখন সামগ্রিক ভাবে দু’টি ভিন্ন ধর্মাবলম্বী পক্ষকে পরস্পরের বিপরীতে দাঁড় করাই— এক দিকে হিন্দু, অপর দিকে মুসলমান। এই আত্মপরিচয়ের তলায় যাবতীয় হিন্দু-ধর্মাবলম্বী ও ইসলাম অনুসারী মানুষকে দুই পক্ষে বর্গীকৃত করে ফেলি, তার পর মনে মনে মহাযুদ্ধের সূত্রপাত। অথচ, পুরনো ভারতের সংস্কৃত ভাষায় লেখা যে রচনাগুলি অড্রের বিবেচ্য, সেখানে দুই আলাদা বিপরীত পক্ষের অস্তিত্ব রয়েছে বটে, কিন্তু বর্ণবিভক্ত ‘হিন্দু’ সমাজের কোনও রাজা যখন ‘তুরুক্ষ’ ‘যবন’ ‘চণ্ডাল’ ‘মুসলমান’ ইত্যাদি নামে অভিহিত শত্রুদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হতেন, তখন সেই শাসকের বংশগত ও বর্ণগত মহিমাই বড় হয়ে উঠত। লড়াইকে একমাত্রিক ভাবে হিন্দু আত্মপরিচয়ধারী সমষ্টির সঙ্গে মুসলমান আত্মপরিচয়ধারী সমষ্টির লড়াই হিসেবে দেখা হত না। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ ধর্মীয় শর্তের থেকে বড় হয়ে উঠত। তাই পুরনো হানাহানি মানেই হিন্দু-মুসলমান দুই বিপরীত ধর্মাবলম্বী গোষ্ঠীর চেতনাসঞ্জাত লড়াই— এ কথা বলার উপায় নেই।

সে কালে সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতেরা নানা ভাবে সমকালীন ঘটনার বিবরণ দিতেন— কাব্যের যে রূপটিতে তাঁদের কথা প্রকাশের বাসনা হত, সে রূপটিই গ্রহণ করতেন তাঁরা। পাশ্চাত্যের মতো ইতিহাস রচনার কোনও একটি প্রকরণ অনুসরণে মতি ছিল না তাঁদের। ৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে ভারুচ ফলকে গুর্জর রাজ জয়ভট্ট কী ভাবে মুসলমানদের পরাভূত করলেন, তার কাব্যময় বিবরণ রয়েছে। বর্ষণমুখর মেঘের মতো তিনি বসুধাদগ্ধকারী আগুনে তজিক (মুসলমান) সৈন্যদের নির্বাপিত করলেন। ৭৩৮ খ্রিস্টাব্দে চালুক্যরাজ পুলকেশী কী করলেন? “তজিক সেনাদের মুণ্ডহীন ধড়গুলি উচ্চনাদী তালবাদ্যের শব্দে বৃত্তাকারে নৃত্য করতে শুরু করল।” পুলকেশীর বীরত্বের যে বিবরণ এই ফলকে দেওয়া হয়েছে তা এক দিক থেকে ভয়ঙ্কর, কিন্তু রাজন্যবর্গের বীরত্ব-কথা লেখার এই ছিল সে কালের কাব্যরীতি। এখানে গুর্জর রাজ কিংবা চালুক্যরাজকে ক্ষাত্রবীর্যের আধার হিসেবেই দেখতে হবে— তাঁরা হিন্দুধর্ম রক্ষার জন্য লড়ছেন না, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সসৈন্য বীরত্ব প্রদর্শন করছেন।

রাজনৈতিক ক্ষমতার পালাবদল হয়। অনেক সময় বিশেষ ধর্মাবলম্বীদের উপর করের ভার চাপে। সেই করের ভার সব জায়গাতে যে নেমে আসে তা নয়, স্থানবিশেষে শাসক বিশেষে কর ধার্য হয়। যেমন ১০৫৯ খ্রিস্টাব্দে গোয়ায় কদম্ব শাসকেরা মুসলমান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তুরুক্ষদণ্ড আদায় করতেন, এ যেন পরবর্তী মুসলমান শাসকদের আদায় করা জিজিয়া করেরই আদিরূপ। ক্রমে ঘুরিরা প্রবল শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন, চৌহানদের সঙ্গে তাঁদের মরণপণ সংগ্রাম। জয়ঙ্কের কাব্যে এই ঘুরিরা মাতঙ্গ, চণ্ডাল, অসুর, পিশাচ, ম্লেচ্ছ, পুলিন্দ এই সব শব্দে চিহ্নিত। কী ভাবে পুষ্কর তীর্থ অপবিত্র করছেন তাঁরা বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে পৃথ্বীরাজবিজয় কাব্যে। “এই অন্ধকার সময়ে, যখন ব্রাহ্মণেরা যজ্ঞাহূতি প্রদানের অধিকার বঞ্চিত, তখন ইন্দ্র তাঁর সামর্থহারা।” এখানে ঘুরিদেরকে চতুর্বর্ণের বাইরে অপবিত্র অধম এক বর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছেন তিনি, ব্রাহ্মণদের বিনষ্ট করেছে তারা। এই ম্লেচ্ছদের ধর্মীয় আত্মপরিচয় নিয়ে জয়ঙ্কের স্পষ্ট ধারণা নেই। যে পরাভূত রাজা ও বর্ণের দুর্দশার বিবরণ দেন তিনি, তাঁরা অড্রের ভাষায় ‘অ্যান আপার ক্লাস গ্রুপ উইদিন চৌহান টেরিটরি’, মোটেই হিন্দুধর্মের সামগ্রিক চেতনার ঠিকাদার ছিলেন না তাঁরা।

অড্রে লক্ষ করেছেন মাঝে মাঝেই শব্দগুলি ঠাঁই বদল করে। বিজয়নগরের অমুসলমান শাসকেরা সুলতান উপাধি নিয়ে সচরাচর হিন্দু রাজাদের থেকে তাঁরা যে শ্রেষ্ঠ, তা জানান দিতে কসুর করেননি। মরাঠা-যবন কিংবা রাজপুত-যবন শব্দবন্ধগুলি ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করে। যবন শব্দে মুসলমানদের বোঝাত। যে মরাঠা কিংবা রাজপুতরা মুসলমান শাসকদের সঙ্গে রাজনৈতিক স্বার্থে যুক্ত, তাঁরা মরাঠা রাজপুত আত্মপরিচয় বজায় রেখেই ‘যবন’ হয়ে উঠেছেন। এ যেন উনিশ শতকের ‘হিন্দুব্রাহ্ম’। ঠাকুর বাড়ির অনেকেই নিজেদের ‘হিন্দুব্রাহ্ম’ বলতেন। একটি পরিচয় অন্য পরিচয়ের বিরোধী নয়। মরাঠা শাসকদের পৃষ্ঠপোষণা পেয়েছিলেন যে সংস্কৃত লেখকেরা, তাঁদের ব্যবহৃত গুণবাচক পদগুলি খুব মন দিয়ে লক্ষ করেছেন অড্রে। সেখানে মুসলমান শাসকদের সম্বন্ধে নেতিবাচক পদ সর্বদা ব্যবহৃত হয়নি। জয়রাম মোগলদের বিপুল, তাম্র, উগ্র ইত্যাদি শব্দে অভিহিত করেছিলেন। মরাঠা নায়কদের মুসলমান শাসকদের সম্বন্ধে মনোভাব কখনও মৈত্রীর, কখনও বিরোধিতার। প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে আঘাত লাগছে কি না, তার উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। মনে পড়ে যাবে যদুনাথ সরকার তাঁর বাংলায় লেখা শিবাজী বইতে সুললিত ফারসি ভাষায় রচিত ঔরঙ্গজেবকে পাঠানো একটি পত্র উদ্ধার করেছিলেন। সেখানে আকবর, জাহাঙ্গীরদের প্রশস্তির অভাব ছিল না। “বাদশাহ জহাঙ্গীর ২২ বৎসর ধরিয়া তাঁহার দয়ার ছায়া জগৎ ও জগৎবাসীর মস্তকের উপর বিস্তার করিলেন।”

ইংরেজ শাসনের আগে ভারতে হানাহানি ছিল, মৈত্রীও ছিল। রাজনৈতিক স্বার্থ-সংঘাত, ধর্মীয় স্তরে সুসমন্বয়, হানাহানি সবই চোখে পড়বে। সেগুলি পড়া চাই, স্বীকার করা চাই। সেই হানাহানি ও মৈত্রীকে এ কালে যে ভাবে সামগ্রিক অর্থে হিন্দু-মুসলমান দুই ধর্মগোষ্ঠীর সামগ্রিক হানাহানি বা মৈত্রী হিসেবে দেখার চেষ্টা করা হয়, তার মধ্যে এ কালের চাহিদাই অনিবার্য ভাবে আত্মপ্রকাশ করছে। আর মৈত্রীর চাইতে হানাহানি যে হেতু প্রাণহন্তারক, তাই হানাহানির পুরনো ছবিকে তুলে ধরে হিন্দু-মুসলমান হানাহানির একেলে পথ যাঁরা প্রস্তুত করতে চান, তাঁদের প্রতিহত করাই আশু প্রয়োজন।

বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement