এক পাকিস্তানি টিভি সিরিয়ালে আচমকা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার নিয়ে সমাজমাধ্যমে যে আলোড়ন দেখলাম, তা অন্য কোনও দেশের সিরিয়ালে থাকলে হত কি না, সন্দেহ। কেমন যেন অর্গলমুক্তির আনন্দ অনুভব করেছি। আত্ম-অপর, আমরা-ওরা’য় সাজানো সংসার হঠাৎ কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। সঙ্গীতের যে লাইনগুলি ব্যবহৃত হয়েছে, তা-ও তাৎপর্যপূর্ণ। ‘যদি আর-কারে ভালোবাস/ যদি আর ফিরে নাহি আস’— অর্থাৎ একটি ‘অপর’-এর রূপকল্প তৈরি করে তাতেই খুশি থাকা। সিরিয়ালটি পাকিস্তানি, গানটি রবীন্দ্রনাথের। এইখানেই আসল মজা লুকিয়ে আছে। এক কালে পাক শাসকেরা রবীন্দ্রসাহিত্যকে কার্যত জনমানস থেকে মুছে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ঠিক যেমন আরও অসংখ্য মৌলবাদী প্রচেষ্টা সফল হয় না— কারণ, সাধারণ মানুষের একটি স্বাভাবিক মনন আছে, যা দিয়ে তাঁরা রাষ্ট্রনেতাদের অভিসন্ধিগুলিতে অন্তর্ঘাত করেন।
রাষ্ট্রপরিচালনায় যে যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়, তার সঙ্গে সাধারণ নাগরিকের অন্তর্নিহিত ভাবাবেগের অমিল ঘটে প্রায়ই। কিন্তু মুখ ফুটে সেই কথাটা বলে ফেলার মধ্যে যে সাহস লাগে, তা অতি মূল্যবান। বস্তুত, সাহিত্য ও শিল্পকলার সঙ্গে রাষ্ট্রপরিচালনার একটি দার্শনিক বিরোধ আছে। সাহিত্য ও শিল্পকলার মূল্য বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে বিচার্য নয় মোটেই। একাধিক প্রজন্ম ধরে তার যদি একটি গ্রহণযোগ্যতা এবং চর্চা থাকে, তবেই তা প্রাসঙ্গিক। কিন্তু রাষ্ট্রপরিচালনার একটি খুব বড় দায় হল বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা অনুযায়ী চলা। বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা স্থির করা কিন্তু শাসকের দায় নয়। তার কতকগুলি নির্ধারক আছে, যা ঠিক ভাবে অনুধাবন না করলেই বিপদ।
নাগরিক জীবনের শুরুতে অধিকারের চর্চা অনেকটাই ছিল সঙ্কুচিত। সবাইকে নাগরিক অধিকার ভোগের যোগ্য বলেই মনে করা হত না। নারী ও ক্রীতদাসকে প্রায় সমপর্যায়ভুক্ত বলে মনে করেছিলেন অ্যারিস্টটল। অর্থাৎ, এই রাজনৈতিক অধিকারের ভাবনা সমবণ্টনমূলক নয়। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রতেও প্রথমে সবার ভোটাধিকার জুটল না। এর জন্য যে লড়াই, তা সামাজিক ও রাজনৈতিক।
অনাগরিক হয়ে থাকার যন্ত্রণা থেকে রেহাই দিল আধুনিক জাতিরাষ্ট্র। কিন্তু নানা রাষ্ট্রে নাগরিকতার নানা রূপ। এই সমস্যা আরও তীব্র হচ্ছে বিশ্বায়নের ফলে। অভিবাসী সমস্যা কম-বেশি সমস্ত আধুনিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই আছে। অভিবাসীদের যথার্থ অন্তর্ভুক্তির পথ কী, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু সেটাও হচ্ছে সামাজিক স্তরে, রাষ্ট্রীয় স্তরে নয়। এই জন্য রাষ্ট্রপরিচালকেরা যা বলছেন, তার সঙ্গে সামাজিক ভাবনার অমিল আছে। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার দুফলো তাঁদের বই গুড ইকনমিক্স ফর হার্ড টাইমস-এ এই আর্থ-সামাজিক অভিঘাতটি নিয়ে বিস্তারিত চর্চা করেছেন এবং এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, বহিষ্কার নয়, ‘ইনক্লুশন’ বা অন্তর্ভুক্তির দৃষ্টিকোণটিই সামাজিক এবং অবশ্যই অর্থনৈতিক ভাবে অনেক বেশি লাভজনক। কিন্তু দেশ জুড়ে যেন এই সহজ সত্যটিকে মেনে নিতে বড়ই আপত্তি। বহু সাংস্কৃতিক নাগরিকত্বের ধারণা আজকের চাহিদা, কিন্তু রাষ্ট্রপরিচালকদের রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের সঙ্গে বহুলাংশে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এখানে অপরকে নির্মাণ করতে হয়, তবেই একটি যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব তৈরি হতে পারে।
এ দিকে রাজনীতির বাইরে যে একটি বৃহৎ জীবন আছে, তাকে কখনও অবহেলা করা যায় না। সর্বস্তরে রাজনীতিকে অগ্রাধিকার দিতে দিতে আমরা সমাজের অন্য ক্ষেত্রগুলির অবদানের যে গুরুত্ব আছে, সেই প্রশ্নটিকে অস্বীকার করতে চাই। সমাজজীবনেই কিন্তু ভাবনার মূল সূত্রগুলি প্রথম রোপণ করা হয়। সেখানেই গড়ে ওঠে রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও ক্ষমতার প্রাথমিক সোপানগুলি।
অনেকে মনে করেন যে, দলীয় ভাবনা বাদ দিয়ে বাকি সব চিন্তা আসলে অরাজনৈতিক, এবং এই প্রবণতাকে গুরুত্ব দিলে অবধারিত ভাবে স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদ উৎসাহিত হবে। এই ধারণায় গলদ আছে। ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচারের ইতিহাস বলে যে, সমাজের সবটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে যদি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়, তা হলে কোনও মুক্ত চিন্তা বা কাজের পরিসর থাকবে না। সব সময়ই দলীয় ‘বস’-দের খুশি করে চলতে গেলে প্রথম যেটা হারিয়ে যায়, তা হল ব্যক্তিগত প্রতিভার পরিসরটি। কার্ল মার্ক্স বা জন স্টুয়ার্ট মিল উভয়েই ইউরোপীয় আলোকায়নের সন্তান। কিন্তু মার্ক্স আলোকায়নের সমালোচকও বটে। কোনও বিশেষ আর্থ-সামাজিক বা দার্শনিক প্রবণতা অনেকগুলি স্রোতের জন্ম দিতে পারে। তার মধ্যে একটি হল রাজনৈতিক, কিন্তু অপরাপর নানা ক্ষেত্রেই তার প্রকাশ হতে পারে। সব ক’টি ক্ষেত্রকে সমান গুরুত্ব ও স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সমস্যার দিক হল এখানে জনসমষ্টিকে ব্যাখ্যা করতে হয়। তাকে শুধুমাত্র দলীয় পতাকায় মুড়ে বিচার করতে বসলে সবটা বোঝা যাবে না। তা বিপজ্জনকও বটে। সে ক্ষেত্রে অবধারিত ভাবে অপরকে চিনিয়ে দেওয়ার কাজটি করতে হবে। যে ভাবে এক গোষ্ঠী তার বিরুদ্ধ গোষ্ঠীকে চিনিয়ে দেয় বিভিন্ন বয়ানে এবং তাতেই নিহিত থাকে একটি সর্বগ্রাসী রূপ। অর্থাৎ, সামাজিক জীবন তখন পুরোপুরি রাজনীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এরই একটি চরম প্রকাশ হল ফ্যাসিবাদ। সে ক্ষেত্রে সমাজের প্রতিটি উপাদানই রাজনৈতিক।
গণতন্ত্রের এটি যেমন সমস্যা, তেমনই গণতন্ত্রই আবার একটি বাঁধ হয়ে স্বৈরাচারের মহাপ্লাবনকে রোধ করে। সেটি এক দিকে প্রাতিষ্ঠানিক, অন্য দিকে সামাজিক। প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্র ক্ষমতার কাঠামোকে ভেঙে দেয়, এক হাতে সব ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে দেয় না। আবার সামাজিক নানা ক্ষেত্রকে সমান গুরুত্ব প্রদানের মাধ্যমে অতি-রাজনীতিকে প্রশমিত করে। এই দ্বিমুখী প্রক্রিয়াটি সচল থাকা প্রয়োজন। না হলে অনর্থক কলহকে রাজনীতি হিসেবে গণ্য করতে হয়।
সাহিত্য এবং শিল্পকলা বিজ্ঞানের মতোই সর্বজনীন। বিশ্বায়ন এই সুযোগ এনে দেয়নি। মানুষের বিশ্বময়তা চিরন্তন এবং স্বাভাবিক। ‘বসুধারে খণ্ড ক্ষুদ্র’ করে দেখার মধ্যে আছে সেই মানবিক সত্তাকে অস্বীকার করার প্রবণতা। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে হয়তো তার একটি যুক্তি আছে, কিন্তু ভুললে চলবে না যে, মুক্ত সমাজজীবনই গণতন্ত্রের একমাত্র রক্ষাকর্তা। সেখানে অনেক সময়ই সবাইকে দলীয় অবস্থান থেকে ব্যাখ্যা করা যায় না। সবাইকে দলীয় শৃঙ্খলে আবদ্ধ করাও যায় না। উচিতও না। যাঁরা সরাসরি দলীয় রাজনীতি করছেন, তাঁদের অবশ্যই শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়, হবেও। কিন্তু পাশাপাশি অপরকে বোঝার জন্য মনটাকেও প্রসারিত রাখা প্রয়োজন। সংসদীয় গণতন্ত্র তো তাঁদের এই সুযোগ করেই দিয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যেমন এটা সত্য, তেমনই বৃহত্তর জনসমাজেও সত্য। ‘আমরাই সব বুঝি’, এই মানসিকতাই সর্বনেশে।
রাজনীতির এমন আদর্শ রূপটিকে হয়তো ইউটোপীয় মনে হতে পারে। মনে হতে পারে, এত দূর পথ হেঁটে তা লাভ করতে হবে যে বাস্তবে তা সম্ভব নয়। কিন্তু গন্তব্য বহু দূরে মনে হলেও ঠিক দিকে পথ হাঁটাই আমাদের একমাত্র কর্তব্য। এই করোনাকালে স্বজন হারানোর সময় আমরা হয়তো বুঝছি পরস্পরের হাত ধরে থাকার গুরুত্ব, বুঝতে পারছি ‘অপর’কে চাই ‘আত্ম’কে ঠিকমতো বাঁচার পরিসরটি দিতেই।
দুঃসময়ে এটুকু প্রাপ্তিও কম নয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বঙ্গবাসী কলেজ