গত ২৮ জুন ২০২২ কেন্দ্রীয় বন ও পরিবেশ মন্ত্রক বন সুরক্ষা আইন ১৯৮০-র নতুন বিধি বা নিয়মাবলি প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে যে, জঙ্গলের জমিতে বিভিন্ন ‘উন্নয়নমূলক’ কাজ বা খনন কাজে বেসরকারি সংস্থাকে কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি অনুমতি দেবে। এর জন্য আদিবাসীদের অনুমতি নেওয়ার আর প্রয়োজন নেই। সরকার অনুমতি দেবে বন উপদেষ্টা কমিটির মাধ্যমে, যেখানে সরকারি আমলাদেরই প্রাধান্য। বনভূমিকে অন্য কাজে ব্যবহারের বিষয়ে আদিবাসীদের স্বাধীন ভাবে অবহিত প্রাক্-সম্মতি দেওয়া বা না-দেওয়ার; সেই ‘অন্য কাজে’ তাঁদের অধিকার খর্ব হচ্ছে কি না, তা পর্যালোচনা করার নিয়মটাই তুলে দেওয়া হল।
বন অধিকার আইন ২০০৬ আর বন ও পরিবেশ মন্ত্রকের ২০০৯ সালের নির্দেশিকা অনুযায়ী, কোনও পরিবারকে জঙ্গল থেকে উৎখাত করতে গেলে বা জঙ্গলের জমির চরিত্র বদল করতে হলে— তা সে রাষ্ট্রই হোক বা বেসরকারি সংস্থাই হোক— গ্রাম সভার সম্মতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। জমি থেকে উৎখাত করতে গেলে আগে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের বন সুরক্ষা আইনের নয়া বিধি এই রক্ষাকবচটাই তুলে দিল বনভূমির চরিত্র বদলের ক্ষেত্রে।
জঙ্গলের উপর আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষিত রাখার দায় রাজ্যগুলোর উপর চাপিয়ে দিতে চাইছে কেন্দ্র। উচ্ছেদের অনুমতি দেবে কেন্দ্র, আর রাজ্যগুলোকে দেখতে হবে জঙ্গল কাটার আগে আদিবাসীদের সম্মতি নেওয়া হচ্ছে কি না। আরও বলা হয়েছে, রাজ্য সরকার বনজমি ব্যবহারকারী সংস্থার হাতে জমি তুলে দেওয়ার আগে বন অধিকার আইন মানা হয়েছে কি না, তা দেখে নেবে। নিয়ম ছিল, যে পরিমাণ বনজমি হস্তান্তরের ছাড়পত্র দেওয়া হবে, বনের বাইরে সমপরিমাণ জমির ব্যবস্থা করতে হবে, সে জমিতে ক্ষতিপূরণস্বরূপ বনসৃজন করতে হবে। বন ধ্বংস ও বাস্তুতন্ত্র নষ্ট করার পরিবেশ মূল্য বা নেট প্রেজ়েন্ট ভ্যালু (এনপিভি) হিসাবে টাকা কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের কাছে জমা করতে হবে। প্রশ্ন হল, কেন্দ্র এক বার টাকাটা নিয়ে নিলে রাজ্য সরকারের কি আর কোনও ভাবেই প্রকল্পটি বাতিল করা সম্ভব?
খনিজ ও লৌহ আকরিকসমৃদ্ধ বিভিন্ন রাজ্যে— যেমন হিমাচলপ্রদেশে, ছত্তীসগঢ়ে, ওড়িশায়— বহু প্রকল্প আটকে রয়েছে বা বাতিল হয়েছে গ্রামসভার অনুমতি না পাওয়ায় বা প্রতিরোধের ফলে। এই নতুন বিধি সেই প্রকল্পগুলির রাস্তা খুলে দেবে। এই নয়া বিধির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য, নানা জটিল আইনি মারপ্যাঁচ, ধাপে ধাপে ছাড়পত্র, বিভিন্ন দফতরের মধ্যে সময়সাধ্য ফাইল ঘোরাঘুরি, এ সব থেকে মুক্তি পেতেই এই নতুন বিধি। আসল কারণ সম্ভবত গ্রামসভার অনুমতি পাওয়ার শর্ত থেকে মুক্তি পাওয়া। বিভিন্ন তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় সরকার এই সময়ে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য বনভূমির চরিত্র বদলের ছাড়পত্র দিয়ে চলেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্রামসভার অনুমতি নেওয়া হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম প্রলোভন দেখিয়ে, বা বলপূর্বক অনুমতি নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় গ্রামবাসীদের প্রতিরোধের ফলে প্রকল্পগুলি কিছুটা হলেও ধাক্কা খাচ্ছিল। নতুন নিয়মে বনভূমির হস্তান্তর প্রক্রিয়া গতি পাবে। এর ফলে আদিবাসীরা, যাঁদের জীবন, জীবিকা এবং সংস্কৃতি জঙ্গলের জমি ও তার সম্পদের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত, তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। অন্য দিকে, জঙ্গল ধ্বংসের ফলে জীববৈচিত্র কমবে, জলবায়ু পরিবর্তন রোধের ক্ষমতাও হ্রাস পাবে।
‘উন্নয়ন’ প্রকল্পের জন্য বনভূমি হস্তান্তর প্রক্রিয়া গতি পেলে কম্পেনসেটরি অ্যাফরেস্টেশন অ্যাক্ট ২০১৬ অনুযায়ী, এক দিকে যেমন বনভূমির বাইরে বনসৃজনের জন্য বিপুল পরিমাণ জমির প্রয়োজন হবে, অন্য দিকে বনভূমি ধ্বংসের ফলে পরিবেশগত ক্ষতি পূরণ করার জন্য বিপুল পরিমাণ টাকাও আদায় হবে। এই টাকার ভাগ পাওয়ার অধিকার বাস্তু ও সংস্কৃতিগত ভাবে উৎখাত হওয়া আদিবাসীদের নেই। অন্য দিকে, বনসৃজনের জন্য এই বিপুল পরিমাণ জমি কোথায় পাওয়া যাবে? ভারতে জঙ্গলের বাইরের জমি বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। জমির প্রকৃতি, অধিকার ভিন্ন-ভিন্ন। পরিচালন ব্যবস্থাও ভিন্ন। ফলে বনসৃজনের জন্য অব্যবহৃত জমি পাওয়া কঠিন। সিএজি-র রিপোর্ট বলছে, ২০০৬ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ১,১৪,৮৭৭.২৬ হেক্টর বনভূমির হস্তান্তর হয়েছে। তার বদলে মাত্র ২৮,০৮৫.২৬ হেক্টর (২৭%) অন্য জমি বনসৃজনের জন্য পাওয়া গিয়েছে। তার মধ্যেও মোটে ৭,২৮০ হেক্টর (৭%) বনভূমিতে কম্পেনসেটরি অ্যাফরেস্টেশন হয়েছে। বন ও পরিবেশ মন্ত্রক ২০১৭ সালে বনের ছাড়পত্র দেওয়ার বিষয়ে দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে রাজ্য সরকারগুলিকে ‘ল্যান্ড ব্যাঙ্ক’ গঠন করতে বলেছে। বলা হয়েছে, অব্যবহৃত জমি, নষ্ট বনভূমি বা ডিগ্রেডেড ফরেস্ট ল্যান্ড, বা ব্যক্তিগত মালিকানার বাইরে থাকা জমি ল্যান্ড ব্যাঙ্কের অধীনে আসতে পারে। অথচ, জঙ্গলের উপর নির্ভরশীল প্রান্তিক মানুষেরা এই জমির আইনি স্বীকৃতি পেলে বনজমির সম্পদ ব্যবহার করে জীবনযাত্রার উন্নতি করতে পারতেন। সন্দেহ নেই, তাঁরাই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আদিবাসীরা উৎখাত হলে তাঁদের জমিবাবদ কোনও ক্ষতিপূরণ পাবেন না। অন্য দিকে, বন ধ্বংসের ফলে জঙ্গল ও জমি থেকে উৎখাত এবং জীববৈচিত্রের ক্ষতি শুধুমাত্র বনসৃজন করে পূরণ করা সম্ভব নয়।
এই নতুন বিধিতে প্রাকৃতিক জঙ্গল ও জীববৈচিত্রের ধ্বংসের ক্ষতিপূরণের মূল্য বাড়িয়ে হেক্টর প্রতি প্রায় ১১ লাখ থেকে ১৬ লাখ করা হয়েছে। বনভূমি, জীববৈচিত্র এবং অধিবাসীদের নিয়ে যে বাস্তুতন্ত্র, তার মূল্য টাকার অঙ্কে ধার্য করা কতটা সমীচীন, সে প্রশ্ন থাকবেই। ওই অর্থ বাণিজ্যিক কারণে এক বা দুই প্রজাতির গাছ লাগানোর জন্য খরচ হচ্ছে। এ ছাড়া আছে দুর্নীতি। এই প্রকল্পে স্থানীয়দের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়নি। ফলে কোন গাছ কোথায় লাগানো হবে, সেই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বা দেখাশোনার ব্যাপারে স্থানীয় মানুষের কোনও ভূমিকাই নেই। এ দিকে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাফরেস্টেশন-এর শর্ত মানতে গিয়ে বন দফতর আদিবাসীদের সমষ্টিগত জঙ্গলের মধ্যেই বলপূর্বক প্লান্টেশন করছে বলে অভিযোগ। কম্পেনসেটরি অ্যাফরেস্টেশন নীতির গোড়ায় গলদ।
রাষ্ট্র জঙ্গলের উপর নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করছে নতুন নতুন নিয়মের মাধ্যমে। এক দিকে সরকার ‘উন্নয়ন’ বা ‘ইজ় অব ডুয়িং বিজ়নেস’-এর নামে প্রাকৃতিক জঙ্গল ধ্বংস করার অধিকার বেসরকারি সংস্থাকে দিচ্ছে, অন্য দিকে বনসৃজনের নামে বনভূমি নয় এমন নতুন নতুন এলাকা অধিগ্রহণ করছে। বনের পরিধি বাড়ানো হচ্ছে, যাকে বলা যেতে পারে ‘ল্যান্ড গ্র্যাব’। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ও প্রান্তিক আদিবাসীদের উন্নতির প্রেক্ষাপটে ‘গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট’ বা জিডিপি বৃদ্ধির লক্ষ্যে যে যথেচ্ছ ‘গ্রস ন্যাচারাল প্রোডাক্ট’ ধ্বংস করা করা চলে না, সেটা সরকারের ভাবা প্রয়োজন।
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা