সূচনা: বাজেট পেশ করার আগে অর্থ মন্ত্রকে নির্মলা সীতারামন ও তাঁর সহযোগীরা। ২৩ জুলাই, নয়াদিল্লি। ছবি: পিটিআই।
২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের কেন্দ্রীয় বাজেটে ধারাবাহিকতা এবং পরিবর্তন দুই-ই আছে। আলাদা আলাদা করে ধারাবাহিকতা এবং পরিবর্তনের কথা বলছি। এর আগে বিজেপি সরকার যে জোগানভিত্তিক মুক্ত অর্থনীতিতে আস্থা রেখেছিল, এ বারেও তারা তার থেকে সরে আসেনি। এটাই ধারাবাহিকতা। জোগানভিত্তিক মুক্ত অর্থনীতিতে আস্থা রাখা মানে এটা বিশ্বাস করা যে, সরকারের মূল কাজ বেসরকারি উদ্যোগপতিদের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযুক্ত একটা আবহাওয়া তৈরি করে দেওয়া। আবহাওয়া তৈরি করে দিলে উন্নয়নের বাকি কাজটা উদ্যোগপতিরাই করে নিতে পারবেন। নিজেদের স্বার্থেই তাঁরা বিনিয়োগ করবেন, শ্রমিক-নিয়োগ করবেন, উৎপাদন বাড়াবেন, জিনিসপত্র বিক্রি করবেন। এর ফলে তাঁদের নিজেদের মুনাফা যেমন বাড়বে, তেমনই কর্মসংস্থান বাড়বে, সাধারণ মানুষেরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে। এটাকে জোগানভিত্তিক অর্থনীতি বলা হচ্ছে কারণ ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযোগী আবহাওয়া তৈরি করে দিয়ে সরকার শুধুমাত্র জোগানের রাস্তাটাই মসৃণ করছে— যে পণ্য তৈরি হল, তার জন্য পর্যাপ্ত চাহিদা আছে কি না, তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। সরাসরি পুনর্বণ্টনেরও চেষ্টা করছে না।
সরকারের কাছে ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযুক্ত আবহাওয়া তৈরি করা মানে দুটো কাজ করা— এক, আয়কর, সম্পত্তি কর, মূলধনি মুনাফা কর সমেত ব্যবসা-বাণিজ্যের সমস্ত নিয়ম-কানুন যথাসম্ভব সরল করে দেওয়া; এবং দুই, পরিকাঠামোর উন্নতি ঘটানো। এই বাজেটে দুটোই করা হয়েছে। বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য পরিকাঠামো খাতে এগারো লক্ষ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব। বিশাল অঙ্কের এই বিনিয়োগ মোট খরচের ২৩%। নিকট অতীতেও এই রকম অনুপাতে বিনিয়োগ করা হয়েছিল। অনুমান করা হচ্ছে, গত বছরের আট শতাংশ জাতীয় আয়ের বৃদ্ধিহার তারই ফল।
সমস্যাটা হল, জাতীয় আয় বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু তার সুফল আয়-বিন্যাসের উপরতলার মানুষদের মধ্যেই আটকে থাকছে। ফলে নিচুতলার সঙ্গে উপরতলার তফাতটা বেড়ে চলেছে। এর একটা বড় কারণ হল, বিনিয়োগ বা উৎপাদন যতটা বাড়ছে, কর্মসংস্থান সেই হারে বাড়ছে না। উৎপাদনের সঙ্গে সমানুপাতিক হারে কর্মসংস্থান না বাড়ার দুটো কারণ আছে। প্রথমত, প্রযুক্তির যত উন্নতি ঘটছে ততই শ্রমের জায়গা নিয়ে নিচ্ছে যন্ত্র। একটা কম্পিউটার দশ জন করণিকের কাজ করে দিচ্ছে, আধুনিক কারখানার অ্যাসেম্বলি লাইনে সীমিত ক্ষমতার মানব-শ্রমিকের বদলে দেখা দিচ্ছে অভ্রান্ত, অক্লান্ত রোবট। দ্বিতীয়ত, ভাল ভাল সংস্থায় বেশ কিছু শূন্য পদ পড়ে থাকলেও উপযুক্ত লোকের অভাবে সেগুলো পূরণ করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ যাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে কাজের বাজারে প্রবেশ করছেন, তাঁদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে সংস্থাগুলি নিয়োগের উপযুক্ত বলে মনে করছে না। দোষটা কর্মপ্রার্থীদেরও নয়, সংস্থাগুলিরও নয়— দোষ সেই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, যেখান থেকে এই নিয়োগ-অযোগ্য ছেলেমেয়েরা পাশ করে বেরোচ্ছেন। প্রথম সমস্যাটা নিয়ে বাজেট কিছু বলেনি, দ্বিতীয়টা নিয়ে বলেছে।
কর্মসংস্থানের অভাব যে একটা সমস্যা, সেটা এই বাজেটেই প্রথম স্বীকার করে নেওয়া হল। এবং এই সমস্যার মোকাবিলা করার জন্যে কিছু কিছু নতুন পদক্ষেপও প্রস্তাব করা হল। এটাই পরিবর্তন। কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য বাজেটে পাঁচটি প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রথমত, বিধিবদ্ধ ক্ষেত্রে যাঁরা নতুন কাজ করতে শুরু করলেন, তাঁদের তিনটি কিস্তিতে পনেরো হাজার টাকা সরাসরি অনুদান দেওয়া হবে। দ্বিতীয়ত, উৎপাদন শিল্পে যাঁরা নতুন কাজ শুরু করলেন, প্রথম চার বছর ইপিএফ-এ তাঁদের ও তাঁদের নিয়োগকর্তাদের দেয় অর্থের একটা অংশ সরকার পুষিয়ে দেবে। তৃতীয়ত, এক লাখ টাকা পর্যন্ত মাসিক বেতনের প্রতিটি বাড়তি নিয়োগের জন্য নিয়োগকারী সংস্থা প্রথম দু’বছর ইপিএফ-এ যে টাকাটা জমা দিচ্ছে তার মধ্যে তিন হাজার টাকা সরকারের কাছ থেকে ফেরত পেতে পারবে। চতুর্থত, এক হাজারটি আইটিআই-কে উন্নীত করা হবে, যেখানে আগামী পাঁচ বছরে কুড়ি লক্ষ যুবক-যুবতী উন্নতমানের প্রশিক্ষণ পাবেন। পঞ্চম প্রস্তাব, দেশের পাঁচশোটি সর্ববৃহৎ বেসরকারি সংস্থা আগামী পাঁচ বছরে এক কোটি যুবক-যুবতীকে প্রশিক্ষণ দেবে। প্রতিটি প্রশিক্ষণের মেয়াদ এক বছর, প্রশিক্ষণের সময় পাঁচ হাজার টাকা মাসিক ভাতা ছাড়াও এই শিক্ষানবিশরা পাবেন এককালীন ছ’হাজার টাকা।
এ সবের ফলে কর্মসংস্থান কি আদৌ বাড়বে?
প্রথম পদক্ষেপের ফলে যিনি চাকরি পেয়ে গেছেন তিনি সামান্য লাভবান হচ্ছেন, কিন্তু যিনি তাঁকে চাকরি দিচ্ছেন, তাঁর লোক-নিয়োগের খরচ অপরিবর্তিত থাকছে। তা হলে তিনি বাড়তি লোক নেবেন কেন? দ্বিতীয় এবং তৃতীয় প্রস্তাব নিয়োগকর্তার খরচ কিছুটা বাঁচাচ্ছে বটে, কিন্তু সেটা এতই সামান্য যে, এর জন্যে সংস্থাগুলি হুড়মুড় করে প্রচুর নতুন লোককে চাকরি দেবে, এমন মনে করার কারণ নেই। প্রথম তিনটি প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আর একটা কথা— কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য নিয়োগপিছু নিয়োগকর্তাকে কিছু সুবিধা দেওয়া যেতেই পারে, কিন্তু যিনি চাকরি পেয়ে গেছেন, তাঁকে বাড়তি সুবিধা দিলে কর্মসংস্থান কিছু বাড়বে না। এটা অর্থের অপচয়। চতুর্থ ও পঞ্চম প্রস্তাবে পরে আসছি।
শুরুতে বলেছিলাম, অতীতে বিজেপি সরকার ভারতীয় অর্থনীতিকে যে ভাবে চালিয়েছে, ভবিষ্যতেও সে ভাবে চালাতে চায়। ফলে আশঙ্কা, অতীতে যে ভুলগুলো করা হয়েছে, ভবিষ্যতেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। বিজেপির অতীত বাজেটগুলোতে মোট খরচের আড়াই-তিন শতাংশের বেশি বরাদ্দ শিক্ষাখাতে করা হয়নি। এ বছরের বাজেটেও স্কুলশিক্ষা এবং উচ্চশিক্ষা মিলিয়ে শিক্ষার কপালে জুটেছে মোট খরচের ২.৬%। এ ভাবে চললে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাটাই আস্তে আস্তে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। শাসক দলও চায় যে, আর পাঁচটা পণ্যের মতো শিক্ষাটাও বেসরকারি কারখানায় তৈরি হোক।
শিক্ষাকে পণ্য ভাবতে অসুবিধে নেই, কিন্তু তার বেসরকারিকরণে সমস্যা আছে। মেধা এবং ভাল শিক্ষা, এই দুইয়ের সংযোগ ঘটলে তবেই শিক্ষার্থী উৎকর্ষ লাভ করে। ভাল শিক্ষার খরচ খুবই বেশি। যদি বেসরকারি হাতে শিক্ষা ছেড়ে দেওয়া হয়, তা হলে এই খরচ পুরোটাই শিক্ষার্থীর ঘাড়ে চলে আসবে। সেটা বহন করার ক্ষমতা একমাত্র অবস্থাপন্নদেরই আছে। কিন্তু মেধা যে শুধু অবস্থাপন্নদের আছে তা তো নয়, মধ্যবিত্ত, স্বল্পবিত্ত সব শ্রেণির মধ্যেই মেধা আছে। শিক্ষার বেসরকারিকরণ হলে মধ্যবিত্ত এবং স্বল্পবিত্ত শ্রেণির মেধাবীরা ভাল শিক্ষার সুযোগ কখনও পাবে না, উৎকর্ষেও পিছিয়ে থাকবে। অপর পক্ষে, অবস্থাপন্ন অ-মেধাবীরা ভাল শিক্ষার সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও মেধার অভাবে উৎকর্ষে পৌঁছতে পারবে না। ফলে সারা দেশে উৎকর্ষের অভাব দেখা দেবে। ভাল ভাল সংস্থায় পদ শূন্য পড়ে থাকবে।
সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে যে বেসরকারি শিক্ষা, তার মান ভাল নয়। মেধাবী-অমেধাবী কেউই সেখান থেকে খুব বেশি শিখতে পারে না। মেধাবীরা তবু মেধার জোরে একটা কিছু পেয়ে যায়। যারা সাধারণ মেধার তারা নিয়োগ-অযোগ্য হয়ে বেকার বসে থাকে। এই সমস্যার সমাধান করতে গেলে সরকারকে শিক্ষার খরচ বহন করতে হবে। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির বিস্তার ঘটিয়ে সর্বস্তরে শিক্ষার মান বাড়াতে হবে।
চতুর্থ ও পঞ্চম প্রস্তাবে ফিরে আসি। সারা দেশে প্রায় ১৫ হাজার আইটিআই-এর মধ্যে মোটামুটি ৮০% বেসরকারি। মান ভাল নয় বলে এগুলোতে অর্ধেকের বেশি আসন ফাঁকা পড়ে থাকে। সরকার কি এগুলোর উন্নতির কথা ভাবছে? না কি, বাকি ২০% সরকারি আইটিআইগুলোর কথা? যেটাই ভাবুক, শুধু উপর উপর সিলেবাস পাল্টে উন্নতি ঘটানো যাবে না। পয়সা খরচ করে ভাল শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। কিন্তু তার জন্য বরাদ্দ কোথায়? পরিশেষে, ইন্টার্নশিপ প্রকল্প। যাঁরা এমনিতে নিয়োগের যোগ্য বলে বিবেচিত হচ্ছেন না, এক বছর প্রশিক্ষণ দিলেই কি তাঁরা নিয়োগের যোগ্য হয়ে যাবেন? তা ছাড়া, এক কোটি যুবক-যুবতী নিশ্চয় সেই সব বড় সংস্থায় চাকরি পাবেন না যারা তাঁদের প্রশিক্ষণ দেবে। তাঁদের বেশির ভাগকেই ছোট সংস্থায় চাকরি খুঁজতে হবে। কিন্তু ছোট সংস্থাগুলোর কাজের ধরন, প্রযুক্তির মান সবই বড় সংস্থার চেয়ে আলাদা। তা হলে এই প্রশিক্ষণ কোন কাজে লাগবে?
আসল কথা, কর্মসংস্থান বাড়াতে গেলে শিক্ষার মান বাড়ানো দরকার আর শিক্ষার মান বাড়াতে গেলে শিক্ষাখাতে সরকারকে খরচ বাড়াতে হবে।