আমরা কি চোখ ফেরাব সেই দিকে, যে মানচিত্রে রয়েছে সাধারণের ভারত? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কথাটা শুনতে খারাপ লেগেছিল। “একটা বড় কিছু ঘটাতে গেলে লাগে হাতেগোনা কয়েকটা মানুষ। এত কোটি মানুষের ভারতবর্ষে তার কোনও অভাব হবে না কোনও দিন!” কিন্তু যিনি বলেছিলেন, তাঁর বয়স সত্তর পেরিয়েছে। বিদেশের এক প্রথম শ্রেণির বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি, বিজ্ঞানের অনেক নোবেল বিজয়ী তাঁর সহপাঠী এবং নিজে এক জন বিশ্বমানের সফল ব্যবসায়ী।
শুরুতেই বললাম, কথাটা ভাল লাগেনি। কিন্তু তা ছিল আমার অভিমান। তবে যুক্তির আলোয় কোথাও গিয়ে সমর্থন না করে তো উপায় নেই! যিনি বললেন, তিনি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছেন সেই ষাটের দশকে। সেই সময় এ দেশে পুরুষদের সাক্ষরতার হার ছিল ৪০ শতাংশের মতো। অথচ তিনি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে আইআইটি আর সেখান থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ গিয়েছেন অন্য অনেক ভারতীয়ের মতোই। তিনিও পরবর্তী কালে সেই ভারতীয়দের এক জন হয়ে উঠেছিলেন, যাঁদের উক্তি বা মন্তব্য সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে ওঠে।
অথবা ধরা যাক, গুগল বা মাইক্রোসফ্টের মতো বহুজাতিক সংস্থাগুলির শীর্ষকর্তাদের কথা। তাঁরাও যখন ভারতে পড়াশোনা করেছেন, তখনও ভারতে পুরুষ সাক্ষরের অনুপাত ৬০ থেকে ৭০ শতাংশের মধ্যেই ছিল। অথবা ধরা যেতে পারে জগদীশচন্দ্র বসু বা সত্যেন বসুর কথা। তাঁদের সময়ে তো সাক্ষরতার হার আরও কম ছিল। কিন্তু তাঁরাই কি ‘ভারতবর্ষ’ ছিলেন, না কি তাঁরাও ভারতবাসী ছিলেন? আর এই প্রশ্নটিই কিন্তু বিকাশের আসল প্রশ্ন। আমরা কি ইন্দ্রা নুই বা সুন্দর পিচাইয়ের অবস্থান দিয়েই আমাদের উন্নয়নকে ব্যাখ্যা করব? না কি চোখ ফেরাব সেই দিকে, যে মানচিত্রে রয়েছে সাধারণের ভারত।
এই সব প্রশ্নে ঢোকার আগে এটাও স্বীকার করা প্রয়োজন যে, প্রথম চারটি আইআইটি, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স বা আইএসআইয়ের মতো উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলি না থাকলে আজকের প্রযুক্তির নানান কাজ, যা তুলনামূলক ভাবে অনায়াসে হচ্ছে, তা কিন্তু আরও আয়াসসাধ্য হয়ে উঠত। আজকের সব সাফল্য কিন্তু দাঁড়িয়ে রয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর নেতৃত্বের উত্তরপুরুষ গড়ে তোলার স্বপ্নের জমিতেই। সেই প্রাতিষ্ঠানিক ভিতের উপরেই।
তবে তা ছিল আর এক ভারতের গল্প, যা আজকে আমাদের নিজেদের ঢাক পেটানোর উপাদান হয়ে উঠেছে। কিন্তু উল্টো দিকের অন্য ভারত? সেই ভারতের দিকে চোখ না ফেরালে আজকের সুসময় আগামীর কঠোর চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে যে!
তত্ত্ব বলে, যে দেশের জনসংখ্যায় কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা বেশি, সেই দেশ উন্নয়নের দৌড়ে এগিয়ে থাকার সুযোগ পায়। কিন্তু এখানে আরও একটা শর্ত রয়েছে, যার আলোচনা আমরা এড়িয়ে যাই। তা হল— শিক্ষা। আজকের দুনিয়ায় শুধু শারীরিক দক্ষতাই জাতীয় দক্ষতার শেষকথা নয়। শিক্ষা তার অন্যতম শর্ত। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যে শিক্ষা লাগে, সেই শিক্ষার নিরিখে এগিয়ে থাকলে এই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের লাভ ঘরে তোলা যায় না।
পরিসংখ্যান বলছে, কর্মক্ষম জনসংখ্যার সুযোগ ভারত পাবে ২০৫৫-৫৬ সাল পর্যন্ত। ২০৪১ সালে যা শীর্ষে পৌঁছবে। আর এই সময়কালে ২০ থেকে ৫৯ বছরের মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৫৯ শতাংশে পৌঁছবে। অর্থা,ৎ আর্থিক বৃদ্ধির কর্মযজ্ঞে আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশই তখন শামিল হতে পারবে।
কিন্তু তাঁদের সেই যোগ্যতা থাকবে কি? আজ কিন্তু সেটাই একটা বড় প্রশ্ন। সমীক্ষা (এএসইআর ২০২২) বলছে, আমাদের দেশে যারা ক্লাস এইটে পড়েও ক্লাস টু-র বই পড়তে পারে, তাদের সংখ্যা ৬৯.৬ শতাংশ। কিন্তু ওই স্তরের অঙ্ক করে উঠতে পারে মাত্র ৪৪.৭ শতাংশ। তার মানে ক্লাস টু-র অঙ্ক করতে ক্লাস এইটের ছাত্র গলদঘর্ম। আর এরাই কিন্তু আমাদের আগামীর সম্পদ!
এরা তো স্কুলে টিঁকে থাকা ছাত্রদের অংশ। রাজ্যসভায় সম্প্রতি পেশ করা সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, সেকেন্ডারি স্কুল পর্যন্ত যে সব ছাত্র পৌঁছতে পারছে, তাদের ১০ শতাংশ স্কুলছুটের দলে নাম লেখায়। আর এই সংখ্যা উত্তর এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে অনেক বেশি। ওড়িশায় ২৭.৩ শতাংশ আর পশ্চিমবঙ্গে ১৮ শতাংশ।
বিভিন্ন সমীক্ষায় যে কারণ উঠে আসছে, তা কিন্তু বর্তমান উন্নয়নের দাবিকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। স্কুলছুট মেয়েদের মধ্যে ৩০ শতাংশ জীবন থেকে লেখাপড়া বাদ দিয়েছে বাড়ির কাজের চাপে। আর ছেলেদের ৩৬.৯ শতাংশ স্কুল ছেড়েছে পরিবারের আর্থিক দায় কাঁধে তুলে নিতে।
তার মানে তো একটাই। দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার যাই হোক না কেন, তার সুফল এখনও আর্থিক পিরামিডের ভূমি ছুঁতে পারেনি। এই সব সমীক্ষায় যে সব প্রশ্ন করা হয়েছে তার মধ্যে একটির উত্তর উন্নয়ন বা বিকাশের দাবির মূলে কুঠারাঘাত করেছে। আর সেই উত্তরটি হল, “পড়াশোনা করে যদি বাপ-দাদাদের পেশাকেই আপন করে নিতে হয়, তা হলে পড়াশোনার পিছনে সময় নষ্ট করে লাভ কী?”
অর্থাৎ, শিক্ষাকে এঁরা জীবনের অগ্রগতির রথ হিসাবে দেখছেন না। আর যদি না দেখেন, তা হলে তার দায় কার? এই ভাবনাটা কিন্তু জরুরি। রাজনীতি-নিরপেক্ষ ভাবেই এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। আজ থেকে তিরিশ বছর বাদে কৃষিতেও যে প্রযুক্তির প্রয়োজন হবে, তারও দাবি কিন্তু হবে প্রশিক্ষিত কর্মীর। এখনই সাধারণ জীবনযাপনের একটা বড় অংশ সাক্ষরতার দাবি করে। আমরা যদি একটু খোঁজ নিই, দেখব আমাদের সহায়কর্মীদের একটা বড় অংশের আধার কার্ডে জন্মদিন ১ জানুয়ারি! কারণ এঁরা সাক্ষর হলেও এঁদের সেই শিক্ষা নেই, যার ভিত্তিতে আধারে তথ্য ভরার সময়েই তা যাচাই করে নিতে পারেন। এক দশক পরেও কিন্তু এঁদের সাহায্য নিয়ে বৃদ্ধি ও উন্নয়নের রথ সমান্তরাল ভাবে চালাতে পারব না। যদি না মানবসম্পদ তৈরির কাজে মন দিই। একই সঙ্গে যদি না মাথায় রাখি, আর্থিক বৃদ্ধি এবং বিকাশ সব সময় এক পঙ্ক্তিতে বসে না। তখনই বসবে যখন আমরা সবাই মানব যে, শিক্ষা আমাদের ব্যক্তি-উন্নয়নের অন্যতম পাথেয়। আর সেই আস্থা তৈরি করাটাই কিন্তু নীতি নির্ধারকদের অন্যতম দায়।