—প্রতীকী চিত্র।
বিষয়টি জটিল, তাই কিছু সরলীকরণ করতেই হবে। আগাম মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি। যে কোনও প্রতিষ্ঠানেই সব সময় দু’ধরনের মানুষ থাকেন। এক দল যাঁরা মোটের উপর সৎ পথে যথেষ্ট পরিশ্রম করে সঠিক মানে কাজ করার চেষ্টা করেন। এই গোষ্ঠীর বেশির ভাগের নিজেদের কর্মক্ষেত্রে কিছু দক্ষতা থাকে। তাঁরা তাঁদের অফিসে আসেন, এ দিক-ও দিক না তাকিয়ে নিজের মতো কাজ করেন, এবং প্রধানত তাঁদের জন্যই একটি প্রতিষ্ঠান সুনাম অর্জন করে। কোনও দিকে না তাকানো মানে কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ না করার কথা বলছি না। এঁরা সাধারণত অন্যায়ের প্রতিবাদ করে থাকেন। কিন্তু এঁরা আবার প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতি থেকেও কিছুটা দূরে থাকেন। এঁরা প্রধানত সোজা পথের মানুষ; বাঁকা পথে চলার অভ্যাস নেই বা প্রয়োজন পড়ে না। উল্টো দিকে আবার আর একটি গোষ্ঠী থাকে, যার সদস্যরা একটু সস্তায় বাজিমাত করার চেষ্টা করেন। এই দ্বিতীয় গোষ্ঠীর বেশির ভাগ প্রধানত অদক্ষ; তাঁদের কাজের স্তর অনেক ক্ষেত্রেই কাঙ্ক্ষিত মানে পৌঁছয় না। তাঁদের মধ্যে সব সময় একটা নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে। তাই নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে তাঁদের অনেক সময় ক্ষমতার কেন্দ্রের আশেপাশে ঘুরতে দেখা যায়। ফলত তাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির সঙ্গে একটু বেশি জড়িয়ে থাকেন। আর আমাদের দেশে যে রাজনীতিই ক্ষমতার উৎস, সে কথা কে না জানে! আবার বলি, আমি হয়তো যুক্তির স্বার্থে কিছুটা সরলীকরণ করলাম, কিন্তু মোটের উপর ব্যাপারটি অনেকটা এই রকম।
এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে কোনটি মাপে ছোট আর কোনটি বড়, তা নির্ভর করে আমরা কী জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কথা ভাবছি, তার উপর। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক রকম, আবার কর্পোরেট অফিসে অন্য রকম হতেই পারে। রাজনৈতিক দলে আবার অন্য রকম। এই সূক্ষ্ম পার্থক্যের মধ্যে না গিয়ে ধরা যাক দুই গোষ্ঠী সমান সমান। সমস্যা হল এই দ্বিতীয় গোষ্ঠী অনেক বেশি সঙ্ঘবদ্ধ। এটা হয়তো কিছুটা তাদের কর্মসংক্রান্ত নিরাপত্তাহীনতা থেকে আসে বা নিজেদের সুরক্ষার খাতিরে করতে হয়। এই গোষ্ঠীটি তৃতীয় আর একটি গোষ্ঠীকে (সে গোষ্ঠী তাদের অধস্তন হতে পারে, নাও পারে) নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে কুণ্ঠা করে না। ‘ব্যবহার’ কথাটিকে আমি সদর্থক ভাবে বলছি না— সদর্থক ভাবে ব্যবহার করা তো ভাল— নেতিবাচক অর্থেই বলছি। এর সমস্যা হল, যখনই এক দল মানুষ নেতিবাচক ভাবে ব্যবহৃত হবেন, তাঁরা বিনিময়ে সুবিধা প্রত্যাশা করবেন। এমন কিছু সুবিধা, যা স্বাভাবিক ভাবে বা আইনত পাওয়া উচিত নয়, অথবা তা প্রত্যক্ষ ভাবে বেআইনি না হলেও অনৈতিক। কিন্তু আর তো তাঁদের বাধা দেওয়ার উপায় নেই। তাঁরা অনৈতিক ভাবে ব্যবহৃত হয়েছেন, এ বার অনৈতিক আবদার করবেনই— তাঁদের আবদার না মানলে ঊর্ধ্বতন গোষ্ঠীকে ‘এক্সপোজ়ড’ হতে হবে। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানব তো এ ভাবেই তৈরি হয়। এ বার তাঁরা মাথায় উঠে নাচবেন, যা খুশি তা-ই করবেন, কাউকে মানবেন না, কিন্তু কারও কিছু করার নেই।
এ ভাবেই এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে একটি দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক তৈরি হয়, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মহীরুহে পরিণত হয়। এই সম্পর্কের শিকড় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এত গভীরে যেতে পারে যে, তাকে উৎপাটন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এ ভাবেই ধীরে ধীরে একটি অচলায়তন তৈরি হয়। যার কিছু অলিখিত নিয়ম থাকে, বা কিছু নিয়ম তৈরি করা হয়। নিয়মগুলি শেষ দুই গোষ্ঠীর প্রধানত পছন্দের, যাতে তাদের কার্যসিদ্ধি সুচারু ভাবে হয়।
যাঁরা তৈলমর্দন বা অবৈধ সুযোগসুবিধা আদায়ের চেষ্টা না করে নিজেদের কাজটি মন দিয়ে করেন, তাঁরা এ বার কী করবেন? তাঁরা হয়তো আগেও কিছু চেষ্টা করেছিলেন পরিস্থিতি সামলানোর, বার বার সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, এই পথে চললে তার কী পরিণতি হতে পারে— কিন্তু তাঁদের কথা শুনছে কে? তাঁরা তো আর ক্ষমতার অলিন্দের আশেপাশে ঘুরছেন না! তাই তাঁরা বেশ কয়েক বার গলা ফাটিয়ে হতোদ্যম হয়ে ক্ষান্ত দেবেন, আর নিজেদের কর্মক্ষেত্রে মনোনিবেশ করবেন। সেটাই তাঁদের শক্তির জায়গা। তাঁরা সেখানেই ফিরে যাবেন এবং নিজেদের ক্ষমতা অনুসারে প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করে চলবেন।
একটি অচলায়তন তৈরি করা সোজা, তাকে ভাঙা অনেক কঠিন। অচলায়তনে ক্ষুদ্র কায়েমি স্বার্থ থাকে, রাজনৈতিক স্বার্থ থাকে, ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকে। অচলায়তনকে জিইয়ে রাখার পক্ষে অনেকে— এবং আবার বলছি, তাঁরা অনেক বেশি সঙ্ঘবদ্ধ। গেম থিয়োরি বা দ্বন্দ্বতত্ত্বের একটি আঙ্গিক ‘গ্রুপ ফর্মেশন’ বা একটি ‘জোট’ কী ভাবে গঠিত হয়, তা নিয়ে আলোচনা করে। শুধু তা-ই নয়, কখন একটি জোট সুস্থায়ী হবে, অর্থাৎ সেটি ‘ভাঙবে না’, তাই নিয়ে প্রচুর জটিল গাণিতিক চর্চা হয়েছে দ্বন্দ্বতত্ত্বের এই শাখায়। সেই জটিলতার মধ্যে না গিয়েও বোঝা সম্ভব যে, অনৈতিকতায় লিপ্ত এই দু’টি গোষ্ঠী খুবই জোটবদ্ধ, এবং সেই জোট সুস্থায়ী। এই জোটবদ্ধতার একটা বড় আকর্ষণ তাদেরই তৈরি করা অচলায়তনকে লালন করা। অচলায়তন থেকে বেরোনো মানে পরিবর্তন, যা আবার অনেকের কাছে সমস্যার কারণ। নিজেদের ধ্যানধারণা, জীবনযাপন পরিবর্তন করতে হবে— খুবই পরিশ্রমের কাজ। মনস্তত্ত্বে ‘স্টেটাস-ক্যো বায়াস’ বা ‘বর্তমান স্থবিরতা’ বলে একটি ধারণা আছে— বিহেভিয়রাল ইকনমিক্স বা আচরণবাদী অর্থনীতির তত্ত্বেও যা খুব প্রচলিত— সেই ধারণা বলে যে, এই স্থবিরতা থেকে মানুষকে বার করে আনা কঠিন, যদিও সম্ভব। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অগ্রসর হওয়া উচিত। আমরা সারা জীবন যা করে এসেছি, বা চলে এসেছে, তাকে আঁকড়ে ধরে বসে থাকলে চলবে না। সময়ের সঙ্গে বদলান বন্ধু, সদর্থক ভাবে।
কোনও প্রাতিষ্ঠানিক অচলায়তনকে কি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসাবে দেখা যায়? বা, একটি প্রতিষ্ঠানের সাময়িক অধঃপতন সম্বন্ধে কি এ কথা বলা চলে যে, তা অন্য কোনও কিছুর সঙ্গে জড়িত নয়? খুব অপ্রিয় হলে এই কথাটি সত্য যে, একটি প্রতিষ্ঠান কোনও একটি সমাজ বা একটি অঞ্চলেরই অন্তর্ভুক্ত। সামাজিক ও আঞ্চলিক অবক্ষয় কোনও না কোনও সময় সেই প্রতিষ্ঠানকে গ্রাস করবেই। যে কোনও প্রতিষ্ঠানই সামাজিক ও আঞ্চলিক অবক্ষয় দ্বারা প্রভাবিত হতে বাধ্য, কিছু আগে বা পরে। কোনও প্রতিষ্ঠান যদি অর্থনৈতিক সমস্যাতেও ভুগতে থাকে, তা হলে ক্ষয় রোগ আসতে বাধ্য। তাই প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন আনতে গেলে সামাজিক, আঞ্চলিক, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতেই হবে, এর কোনও বিকল্প নেই। আর নঞর্থক রাজনীতি যত কমে, ততই মঙ্গল।
অর্থনীতিতে আর একটি বিখ্যাত তত্ত্বের নাম ‘এনিথিং গোজ়’। বাংলায় তর্জমা করলে যার ভাবার্থ দাঁড়ায়, ‘সবই সম্ভব’। এটিও অতি জটিল গাণিতিক একটি তত্ত্ব, যার প্রতিপাদ্য বিষয় একদম অন্য। আমি শুধু এর নামটি ধার করছি, আর আশঙ্কা করছি যে, আমাদের জীবনে ‘চলতা হ্যায়’ বা ‘যা কিছু হতে পারে, আমাদের কিছু করার নেই’, ‘অচলায়তন থাকছে থাকবে’ বা ‘যেমন চলছে চলবে’, এই অসুখ সারা জীবন চলবে না তো? আশঙ্কা হয়, আর কী কী ক্ষতি অপেক্ষা করে আছে, কে জানে!
আগেকার দিনে আমাদের বাসে ওঠার একটি অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ল। বাসে ওঠার সময় ভিড় হলেই কন্ডাক্টর বলতেন, “দাদা, পেছন দিকে এগিয়ে যান।” আমাদের বর্তমান দশা হয়েছে একদম সে রকম। চারিদিকের অচলায়তনের চোটে আমরা প্রবল বেগে পিছন দিকেই এগিয়ে চলেছি। এর শেষ কোথায়?