শেক্সপিয়র লিখেছেন, সারা বছর যদি ছুটি আর খেলায় কাটত, আমোদ-আহ্লাদও হত কাজের মতোই ক্লান্তিকর। পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দারা কথাটা যাচাই করার যথেষ্ট সুযোগ পাচ্ছেন, শিক্ষার্থীরা আরও বেশি করে।
এ দেশের পাঁচ-ছয়টি রাজ্যে ছুটির সংখ্যা বাংলার চেয়ে বেশি, কিন্তু সেটা সন্তুষ্টির কারণ হতে পারে না। প্রশ্নটা প্রতিযোগিতার নয়, উপযোগিতার। বছরের গোড়ায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ঘোষিত তালিকায় রবিবার বাদে ৪৪টি সর্বজনীন ছুটি ছিল: ২২টি সর্বভারতীয়, ২২টি রাজ্যের নিজস্ব। রাজ্যের তালিকায় পরে রাম নবমী যোগ হয়েছে। চারটি ছুটি কেবলমাত্র কোনও উৎসবের আগের বা পরের দিন বলে, আর ছয়টি স্রেফ ‘অতিরিক্ত’। কিছু ছুটি হতে-হতে হয়নি: রবিবারে পড়েছে, বা উপরোক্ত ৪৪টির সঙ্গে এক তারিখে। অর্থাৎ ছুটির দরজা খোলা রইল, সুযোগ পেলে আগামী বছর মঞ্জুর হবে। আবার মহালয়া আর গান্ধী জয়ন্তী মিলে যাওয়ায় এ বছর আমরা একটা ছুটি থেকে ‘বঞ্চিত’ হয়েছি।
অধিকাংশ সরকারি দফতর খোলে সপ্তাহে পাঁচ দিন, সরকারপোষিত স্কুলগুলি ছয় দিন। বছরের গোড়ার ঘোষণা অনুসারে সব স্কুলে রবিবার বাদে ৬৫ দিন ছুটির বিধান ছিল, তার বিন্যাস প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে কিছু ভিন্ন। আরও কয়েক দিন স্কুলে কোনও অনুষ্ঠান হবে কিন্তু ক্লাস হবে না। ছুটির বরাদ্দ তার পর বাড়তে থাকে। রবিবার বাদে গ্রীষ্মের ছুটি গোড়ায় ছিল প্রাথমিকে ১৯ দিন, মাধ্যমিকে মাত্র ১০ দিন। সংসদীয় নির্বাচন এবং তাপপ্রবাহের দৌলতে তা শেষতক দাঁড়ায় ২২ এপ্রিল থেকে ১০ জুন, অর্থাৎ প্রাথমিকে ২২ দিন ও মাধ্যমিকে ৩০ দিন অতিরিক্ত, যদিও তাপপ্রবাহ শীঘ্রই কেটে যায়।
আমার হিসাবে এ বছর ৫২টি রবিবার সমেত স্কুলের সমস্ত ছুটির যোগফল প্রাথমিকে ১৪৫, মাধ্যমিকে ১৫০ (সামান্য গরমিল থাকতে পারে)। অন্য ভাবে দেখলে ৫২ সপ্তাহের মাত্র ১৮-১৯টিতে সোম থেকে শনিবার প্রত্যহ ক্লাস হচ্ছে। সরকারি দফতরগুলি সোম থেকে শুক্র পাঁচ দিনই খোলা থাকছে ৫২-র ভিতর ২৬ সপ্তাহ। তাদের পূর্বঘোষিত ছুটি ১৪৯ দিন (শনি ও রবিবার ধরে)। অর্থাৎ, সব ক্ষেত্রে ছুটির অনুপাত বছরের মোট দিনের ৪০% বা তার বেশি। ৫ থেকে ২০ অক্টোবর প্রায় সমস্ত সরকারি দফতর একটানা বন্ধ। এতটা আর কোনও রাজ্যে হয় কি?
এতেও সবটা বলা হল না। বাড়তি ছুটি লেগেই থাকে। যেমন নয়টি জেলায় ‘দানা’ ঘূর্ণিঝড়ের জন্য চার দিন স্কুল বন্ধ ছিল, সরকারি দফতর তিন দিন (অবশ্যই অনিবার্য কারণে)। স্কুলবাড়িতে ত্রাণশিবির খোলা হলে পঠনপাঠন অনির্দিষ্টকাল বন্ধ থাকে। যত স্কুলবাড়িতে নির্বাচন কেন্দ্র হয়, অন্য কোনও সরকারি ভবনে হয় না। নির্বাচন মিটলেও রক্ষী বাহিনীর শিবির থেকে যায়, যেমন থাকে অঞ্চলে কোনও অশান্তি ঘটলে। দুয়ারে সরকারের শুভাগমনে পঠনপাঠন দুয়ারের বাইরে নির্বাসিত হয়। বোর্ড পরীক্ষার আসন সঙ্কুলান করতে ক্লাস বন্ধ থাকে। স্কুল পরীক্ষার আগে-পরের ছুটি ছেড়ে দিলাম।
বিভিন্ন স্কুল এবং অঞ্চলের পরিস্থিতি ভিন্ন; তবে চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে, রাজ্যের (এবং দেশের) বহু স্কুলে বছরের অর্ধেক দিনও পঠনপাঠন হয় কি না। শিক্ষার অধিকার আইনের অনুষঙ্গ হিসাবে স্কুলে কর্মদিবস হবে ক্লাস ভেদে ২০০ থেকে ২২০ দিন, শিক্ষাদান বছরে ৮০০ থেকে ১০০০ ঘণ্টা। ‘ওয়ার্কিং ডেজ়’ আর ‘টিচিং ডেজ়’-এর সহজ বিভ্রান্তিতে তার অর্থ করা হয়, ২০০ দিন স্কুলের দরজা খোলা থাকলেই হল। সেটাও সর্বত্র থাকছে কি?
শিক্ষকের অভাবে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা এমনিতেই সঙ্গিন দশায়। দু’টি শ্রেণির ক্লাস পালা করে চলছে, এদের সপ্তাহে তিন দিন ওদের বাকি তিন দিন— এমনও নজির আছে। তার উপর যোগ হয় জোড়া উপদ্রবের অশেষ রকমফের: বাইরের নানা তাগিদে ক্লাস শিকেয় তুলে স্কুলবাড়ি দখল, এবং শিক্ষকদের ক্লাসের বাইরে রকমারি কাজে তলব, বিশেষত নির্বাচন ও সরকারি সমীক্ষার জন্য। জনগণনার বহুবিলম্বিত ঘোষণা সাধারণ ভাবে সুখবর হলেও শিক্ষার পক্ষে দুঃসংবাদ, কারণ শিক্ষকদের ব্যাপক হারে এই কাজে লাগানো হয়।
জাতীয় শিক্ষানীতিতে কিন্তু স্পষ্ট বলা আছে যে শিক্ষকরা শিক্ষাদান ছাড়া অন্য কোনও কাজে বহাল হবেন না, এমনকি স্কুলের নিজস্ব প্রশাসনিক কাজেও নয়। সে কাজটা কে করবে তা রহস্য, কারণ প্রচুর স্কুলে (প্রায় সব সরকারপুষ্ট প্রাথমিক স্কুল সমেত) কোনও অফিসকর্মী নেই। (শিক্ষার অধিকার আইনে অবশ্য জনগণনা, দুর্যোগ মোকাবিলা ও নির্বাচনের ক্ষেত্রে ছাড় আছে।) পাঠ্যবই সরবরাহে বিলম্বের জন্য স্কুল খুললেও লেখাপড়া মুলতুবি থাকে (পোশাকের কথা তুলছিই না।) এ ক্ষেত্রে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের গাফিলতি পাল্লা দিয়ে। কেন্দ্রীয় বোর্ডের তৃতীয় ও ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের জন্য এ বছর দেশভর স্কুল অপেক্ষায় থেকেছে, অন্যান্য শ্রেণির বইয়ের প্রকাশ এক বছর স্থগিত।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মদিবস কমার কিছু কারণ অভ্যন্তরীণ, নানা উপলক্ষে বিক্ষোভ ও ক্লাসত্যাগ। কিছু কারণ উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া। সরকার উচ্চশিক্ষা পরিচালনার ষোলো আনা দখল নিয়েছে। সেখান থেকে সবুজ সঙ্কেতের অভাবে নতুন বর্ষের ক্লাস দেরিতে শুরু হয়, যেমন এ বছর হয়েছে স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষে। তবু শিক্ষাদানের তাগিদে ছাত্রদের ক্লাসঘরে পুরে যা হোক কিছু আওড়াতে হবে, এই সংস্কার এখনও টিকে আছে। চরম দুর্গতি গবেষণার ক্ষেত্রে। সেটা রাজ্য সরকারের হিসাবেই পড়ে না, কেন্দ্রীয় স্তরেও অবহেলা এমনকি সন্দেহের শিকার। গবেষণার রক্ত-জল-করে-আনা অর্থ নির্দিষ্ট সময়ে খরচ করতে হয়, কাজের ধরনটাও সচরাচর এমন যে সময়সূচি ধরে এগোতে হয়, অনেকগুলি প্রক্রিয়া তাল রেখে মেলাতে হয়। সেই গতি বজায় রাখা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। টাকা জোগাড় হয়েছে, স্রেফ সরকারি অনুমোদন পেতে বছর ফুরোল, হয়তো প্রস্তাবটা তামাদি হয়ে গেল, এমনও ঘটে।
শিক্ষাক্ষেত্রের দুর্দশা বড় করে আলোচনা করলাম, কিন্তু ছুটির ফাঁদ পাতা পুরো প্রশাসনের জন্য। সরকারি দীর্ঘসূত্রতা সম্বন্ধে ভারতীয় নাগরিককুলকে নতুন কিছু বলার নেই। অত্যধিক ছুটি সমস্যায় নতুন মাত্রা যোগ করছে। কেবল ওই কয়েকটা দিন সরাসরি নষ্ট হচ্ছে তা-ই নয়, প্রশাসনের পুরো ছন্দটাই বাঁধা হচ্ছে বিলম্বিত লয়ে: ছুটির দিন আর কাজের দিনের ব্যবধান ঘুচে যাচ্ছে। দেদার ছুটির মাঝে বা আগে-পরে দু’-একটি কর্মদিবস থাকলে (যেমন, পুজোর মরসুমের শেষে ৫ ও ৬ নভেম্বর) তাতে প্রকৃত ‘কর্ম’ কতটা হতে পারে? ‘সরকারি কাজ এর চেয়ে তাড়াতাড়ি হয় না মশাই’— এই ইতিহাসসিদ্ধ আপ্তবাক্য নতুন ভাবে প্রশ্রয় পাচ্ছে। ইংরেজি প্রবাদের ভাষায়, ঘাস গজাতে-গজাতে ঘোড়া না খেয়ে মরছে। তার চূড়ান্ত প্রকাশ, বছরভর নির্বিকারে কাটিয়ে মেয়াদের শেষ মাসে হুড়মুড় করে পড়ে-থাকা অনুদান খরচ করা।
এ বছর জুলাই মাসে যেমন দেখা গেল, পঞ্চায়েতের হাতে কেন্দ্রীয় অনুদানের ৭৫% টাকা অব্যবহৃত আছে, আর পনেরো দিনে খরচ না হলে পরের কিস্তি জুটবে না। বলা বাহুল্য, এ ভাবে খরচ হলে টাকার সদ্ব্যবহার হয় না, যে-কোনও ভাবে হিসাব মেলাবার হুজুগে যথেচ্ছ অপব্যয় ও দুর্নীতি হয়। এখানেও দোষ একতরফা নয়। কেন্দ্রের টাকা আসতেই বহু বিলম্ব হয়, হয়তো মেলে অর্থবৎসরের শেষ লগ্নে, যখন সুষ্ঠু ভাবে খরচ করার অবকাশ থাকে না।
গত বছর বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, রাজ্য সরকার মহার্ঘ ভাতা কম দেয় বটে কিন্তু ছুটি দেয় প্রচুর, কর্মীদের তার ‘ভ্যালু অ্যাড’ করতে হবে। এ বড় বিচিত্র যুক্তি। লোকে তো চাকরি নেবে কাজ করার প্রত্যাশায়, কাজ না করার লোভে নয়। কাজের শ্লথতাকে রাংতায় মুড়ে আকর্ষণের মান্যতা দিলে কর্মসংস্কৃতি কোথায় নামবে?
স্কুলে দেদার ছুটি পেলে নিচু ক্লাসের শিশুরা মজা পায়, বড়রা সিলেবাস আর পরীক্ষা নিয়ে চিন্তায় পড়ে, শিক্ষকরা পড়েন শতগুণ। হাল্লার রাজা যে ‘ছুটি! ছুটি!’ বলে উদ্বাহু দৌড় দিয়েছিল, সে তো মন্ত্রীর হাতে পড়ে শিশুর দশা প্রাপ্ত হয়ে। রাজ্য পালনে কিন্তু গতির গাম্ভীর্য না এলেই নয়।