এক ইংরেজি দৈনিকে একটি প্রবন্ধ পড়ে আঁতকে উঠলাম। লেখক সুপ্রিম কোর্টের আদর্শবাক্য ‘যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ’-র সূত্র ধরে বলছেন, দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের স্বীকৃত কর্তব্য ঈশ্বরবিশ্বাস প্রত্যয়িত করা। লেখক মৌলবাদী নন, যুক্তিবাদী মুক্তচিন্তার মানুষ। ‘ধর্ম’ শব্দটা আজ এক বিশেষ অর্থের পরিসরে এতটাই বন্দি যে, তার বাইরে তিনি ভাবতে পারেননি।
সেই পরিসর স্পষ্টই যথেষ্ট নয়। বৌদ্ধধর্মে অশোকের ধর্মচক্রের প্রগাঢ় তাৎপর্য আছে, কিন্তু ভারতের জাতীয় পতাকায়, এবং অশোকের নিজের ব্যবহারেও, তা শাসন ও সমাজের এক ভিন্ন বার্তা বহন করে। অশোককে আমরা ধর্মাশোক বলি, যুধিষ্ঠিরকে বলি ধর্মপুত্র, তাঁরা কোনও ধর্মবিশ্বাসের ধারক বা বাহক বলে নয়, ন্যায়, কর্তব্য ও সদাচারের দর্শনপুরুষ বলে। কুরুক্ষেত্র ধর্মক্ষেত্র, কারণ সেই যুদ্ধে পরীক্ষিত হচ্ছে উচ্চ মানবিক আদর্শ, ভগবদ্গীতায় যার পরাকাষ্ঠা। অত দূর যেতে হবে না। আমরা আদালতের বিচারককে ধর্মাবতার বলি, তিনিও কোনও ঠাকুরদেবতার অবতার নন, ন্যায়বিচারের প্রতিভূ। এই ধর্ম মূলত নৈতিক। বিমলকৃষ্ণ মতিলালের ভাষায়: ‘যুক্তির দ্বারা গ্রাহ্য মহত্ত্বর নীতির অনুমোদিত কর্ম’, যাতে ‘নৈতিকতার কল্যাণময়তা ও পরার্থপরতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে’।
আরও খতিয়ে দেখা যাক। ধর্মের একটা মূল অর্থ যা ধারণ করা হয়— কোনও লক্ষণ, প্রকৃতি বা গুণ, যেমন আগুনের ধর্ম দহন করা। মানুষের ধর্ম কী? সব মানুষ এক দেবতার আরাধনা করে না, অনেকে কোনও দেবতারই নয়। কিন্তু সকলের মধ্যে অধিষ্ঠিত আর এক ধর্ম, মৌলিক স্তরে মানুষের ধর্ম। আর কী আশ্চর্য, মানুষের হাজারো হিংসা-অন্যায়-পাপাচারের দৈনন্দিন প্রকাশ সত্ত্বেও সেই নিহিত ধর্মের সংজ্ঞা মানবচরিত্রের শুভ ও মহৎ লক্ষণের নিরিখে: তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, বলি মানবিকতা।
আবার ইংরেজি ‘রিলিজন’-এর প্রতিশব্দ হিসাবেও ‘ধর্ম’ শব্দটা বহাল। ‘রিলিজন’-এর মূল প্রয়োগ পশ্চিম এশিয়ায় উদ্ভূত তথাকথিত ‘আব্রাহামীয়’ আধ্যাত্মিক প্রণালীগুলি নির্দেশ করতে। সেটা প্রসারিত হয়েছে ভারতে প্রচলিত নানাবিধ আধ্যাত্মিক বিশ্বাস, আচারবিচার ও জীবনদর্শনের সমষ্টি বোঝাতে, যাকে বলা হয় হিন্দুধর্ম। এই বিশাল বহুমুখী ধারাকে ‘রিলিজন’ বললে অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে।
অর্থের এই দোটানার ফলে কাকে ‘ধর্ম’ বলব, তা নিয়ে আমাদের সমাজ এক সর্বনাশা বিভ্রান্তিতে আচ্ছন্ন: যেন এক রাক্ষুসে যমক অলঙ্কার, এক শব্দের দুই অর্থ নিয়ে খেলা। দর্শনশাস্ত্রে নানা যুক্তিদোষের একটা হল অব্যাপ্ত মধ্যপদ, ‘ফ্যালাসি অব দি আনডিস্ট্রিবিউটেড মিডল’। এটা ঘটে যখন যুক্তির শৃঙ্খলে একটা আলগা জোড় ঢুকে পড়ে: কোনও মোক্ষম শব্দের অর্থ মাঝপথে বদলে যায়, ফলে আগের সঙ্গে পরের যুক্তির সঙ্গতি থাকে না। ধর্ম সম্বন্ধে এই দোলাচলের ফলে দেখা দিচ্ছে ধর্মরক্ষার নামে ধর্মনাশের নিত্য আশঙ্কা।
বিপদের এক প্রকাশ অপরাপর রিলিজনের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধায়। যেন সবই এক জমিতে দাঁড়িয়ে, অতএব সেই জমি হতে পারে যুদ্ধক্ষেত্র। এতে আমাদের মনুষ্যত্ব ক্ষুণ্ণ হচ্ছে কি না তা অবান্তর, কারণ মানবধর্ম আর ধর্ম বলে গ্রাহ্য নয়। যে অপরাধীরা চোদ্দোটা খুন করেছে, একাধিক নারীকে ধর্ষণ করেছে, শিশুর মাথা পাথরে আছড়েছে, বলা হচ্ছে ধর্মের কোষ্ঠীবিচারে তারা পুণ্য সংস্কারধন্য। শাসকও নির্বিকার, কারণ শাসনধর্ম ঢাকা পড়েছে ধর্মবিশ্বাসের আড়ালে। সে দিন হয়তো আসন্ন, যখন ‘রাজধর্ম’ বলতে বোঝাবে শাসকের নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস বা রিলিজন, যেমন পুরোহিততন্ত্র বা থিয়োক্র্যাসিতে। শাসক যদি হিন্দু হন, হিন্দু চেতনার উদার ব্যাপ্তি আবদ্ধ হবে আপ্তবিশ্বাসের ধাঁচায়।
রিলিজনে অনেক মহৎ উপাদান থাকতে পারে, কিন্তু তা সর্বজনীন নয়, একটা বিশেষ গোষ্ঠী বা সমষ্টির অভিজ্ঞান। রিলিজনের নিরিখে কেউ খ্রিস্টান কেউ ইহুদি কেউ মুসলিম, অতএব সমতার (না কি প্রতিযোগিতার?) খাতিরে ব্যবহারিক বিচারে কেউ হিন্দু। মানবধর্মের উৎস কিন্তু অভিন্ন মৌলিক মনুষ্যত্বে। রবীন্দ্রনাথ ‘মানুষের ধর্ম’ বক্তৃতামালায় বলছেন, “বাইরে আছে নানা দেশের নানা সমাজের নানা জাত, অন্তরে আছে এক মানব।” হিন্দু সভ্যতার বহুত্ব ও বৈচিত্রের ফলে এই মানবিক একাত্মবোধ আমাদের নাগালের যত কাছে, সব সভ্যতার ততটা নাও হতে পারে। হিন্দু চেতনা বিভিন্ন রিলিজনের উপাদান আত্মস্থ করে সেগুলিকে এবং নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারে। বিবেকানন্দ বলছেন, বেদান্তের দ্বৈতবাদের রূপান্তর আব্রাহামীয় ধর্মগুলিতে, অদ্বৈতবাদের ‘বৌদ্ধধর্ম প্রভৃতি’তে। তাই রামচন্দ্রকে আমরা বলতে পারি, ‘ঈশ্বর আল্লা তেরা নাম’: তাতে রামচন্দ্রের মহত্ত্ব আরও পরিস্ফুট হয়, সব খণ্ডতত্ত্ব মিলে যায় তাঁর পরিপূর্ণ সত্তায়।
এই ঔদার্য, এই সামগ্রিকতা হিন্দু কৃষ্টির অনন্য মহান শক্তি। সেই কৃষ্টিকে একটা বিশেষ সঙ্কীর্ণ প্রকাশে বেঁধে ফেললে, মনুষ্যত্বের ধর্মাসন থেকে নামিয়ে আপ্তবিশ্বাসের আখড়ায় মারপিট করতে পাঠালে, তার ঐতিহ্যকে অপমান করা হয়। আবার বিবেকানন্দের কথা: “হিন্দুধর্ম তো শিখাইতেছেন— জগতে যত প্রাণী আছে, সকলেই তোমার আত্মারই বহু রূপ মাত্র। সমাজের এই হীনাবস্থার কারণ, কেবল এই তত্ত্বকে কার্যে পরিণত না করা, সহানুভূতির অভাব, হৃদয়ের অভাব।” সহানুভূতি বলতে বিবেকানন্দ নিছক মায়া বা অনুকম্পা বোঝাচ্ছেন না, বোঝাচ্ছেন আক্ষরিক অর্থে সহ-অনুভূতি, সহমর্মিতা, হৃৎস্পন্দনে অপরকে এক বলে মানা।
কথাগুলো বিশেষ করে ঘা দেয়, কারণ আজ চতুর্দিকে চিৎকৃত ধর্মের সবচেয়ে প্রকট উপাদান বিরোধ, বর্জন ও সহিংস দমন। পৃথক আছে বলে কাউকে ঘৃণা করছি, কিন্তু সে কাছে আসতে চাইলে তাড়িয়ে দিচ্ছি। মুসলিম ছাত্র সংস্কৃত শিখলে তার শিক্ষক হওয়ায় বাদ সাধছি, পড়শিতে-পড়শিতে পরস্পরের উৎসবপালন বন্ধ করছি, বড়দিনের সময় খ্রিস্টানরা পাড়ার বাচ্চাদের কেক খাওয়াতে ভয় পাচ্ছেন। মুসলিম দোকানদার ও ফেরিওয়ালাদের উপর কেবল মন্দিরপ্রাঙ্গণ নয়, হিন্দুপ্রধান মহল্লায় নিষেধাজ্ঞা বসছে। যে ‘লাভ জেহাদ’ অস্তিত্বহীন বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সংসদে জানিয়েছে, আজ তা ভিন্ন ধর্মের নরনারীর সম্পর্ক বোঝাতে নির্বিকল্প ‘স্বাভাবিক’ শব্দবন্ধ। সম্প্রতি তাতে যোগ হয়েছে ‘জমি জেহাদ’-এর কল্পনির্মাণ। ধর্মান্তরের জন্য জেলাশাসকের ছাড়পত্র লাগে, এমন অভিনব আইন ক’টা দেশে আছে? সম্প্রদায়বিশেষের সংখ্যাবৃদ্ধির যে জুজু দেখানো হয় তা কেবল পরিসংখ্যানের বিচারে ভ্রান্ত নয়, অঙ্কের সাধারণ নিয়মে নিতান্ত অসম্ভব। যথাসময়ে জনগণনা হলে তা আরও স্পষ্ট হত।
‘বিধর্ম বলি মারে পরধর্মেরে, / নিজ ধর্মের অপমান করি ফেরে।’ রবীন্দ্রনাথের এই পঙ্ক্তিতে ‘ধর্ম’ অবশ্যই রিলিজন, কিন্তু শুধু কি তা-ই? ‘নিজ ধর্ম’ কি ব্যাপকতর, গভীরতর মানুষের ধর্মও নয়? কবিতাশেষে আবাহন অবশ্যই সেই বৃহত্তর ধর্মের: ‘হে ধর্মরাজ, ধর্মবিকার নাশি / ধর্মমূঢ়জনেরে বাঁচাও আসি।’ ধর্মরাজের প্রতিনিধি যে শাসক, তাঁর রাজধর্ম নিয়ে রামায়ণে অনেক কথা আছে: ‘সজ্জনের শ্রদ্ধা, সরল ব্যবহার, দয়া এবং দান এই সকলই ইহলোক ও পরলোকে রক্ষার হেতু, এই কারণবশত সেটাই পরম ধর্ম। ...ধর্মকার্য করে রাজাই লোকের রক্ষক হন।’
উত্তরকাণ্ডে আদর্শ নৃপতি রামকে এই ‘ধর্মকথা’ শোনাচ্ছে একটি কুকুর! আসলে সে কালঞ্জরের রাজা, এখন কুকুরের দশাপ্রাপ্ত। তবু সারমেয়রূপেই তার অভিযোগ শুনেন রামচন্দ্র, আদর্শ নৃপতি বলেই, এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে শাস্তিদান করেন কুকুরটিকে অযথা প্রহার করার জন্য। এ দেশে রামচন্দ্র সম্প্রতি মহাসমারোহে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ওই মাসেই কর্নাটকে একাধিক ভিন্নধর্মী দম্পতি প্রবল ভাবে আক্রান্ত। রাজস্থানে এক সাংসদ স্কুলে ঢুকে ধর্মনির্বিশেষে পড়ুয়াদের সরস্বতী বন্দনার হুকুম দিয়েছেন, এক মন্ত্রী নতুন করে হিজাব নিষিদ্ধ করেছেন। মহারাষ্ট্রে চলছে প্রজাদমনে বুলডোজ়ারের ব্যবহার, যার লক্ষ্য সাধারণত এক বিশেষ সম্প্রদায়।
এই অপরাধের অনেকগুলিই ঘটেছে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার পূর্বে, গত কয়েক বছরে অসংখ্য স্থানে ঘটেছে অসংখ্য বার। আমরা বরং প্রার্থনা করি, শ্রীরামচন্দ্রের নবলব্ধ আশীর্বাদে এই অনাচারগুলি দূর হোক, ভারতের ইতিহাসে সত্যিই একটা নতুন সূচনা হোক। ‘ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো, / এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।’