অমর্ত্য সেন (ছবি) যখন নোবেল পুরস্কার পেলেন, অর্থনীতির মাস্টারমশায়রা বেশ আতান্তরে পড়েছিলেন। এখানে ওখানে বলার ডাক পাচ্ছেন তাঁরা, কিন্তু অধ্যাপক সেনের বৌদ্ধিক কাজকর্মের বিশাল পরিধিকে বাগে আনতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সে বাবদে যে পূর্ব প্রস্তুতির দরকার ছিল, তার ফুরসত পাননি তাঁরা। উন্নয়নের অর্থনীতি পড়তে গিয়ে ছাত্র বয়সে অমর্ত্যর প্রথম বই চয়েস অব টেকনিকস থেকে একটু পড়তে হয়েছিল। আর আর্থনীতিক প্রবৃদ্ধির তত্ত্ব পড়াতে গিয়ে তাঁদের মাস্টারমশায়রা কেউ কেউ গ্রোথ ইকনমিকস নামক সঙ্কলনে অমর্ত্য সেনের চমৎকার সম্পাদকীয় ভূমিকাটি পড়তে বলতেন। তার পর থেকে পাঠ্যক্রমের আর কোথাও সেনমহাশয়কে বিশেষ পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি অবশ্য কোথাও কোথাও দেখছি তাঁর ডেভলপমেন্ট অ্যাজ় ফ্রিডম বইটি পাঠ্যতালিকায় থাকছে, কিন্তু পাঠ্যক্রমের কোন অংশের জন্যে বইটির কতটুকু পড়তে হবে, তা বোঝার উপায় নেই। পরীক্ষার প্রশ্নপত্রেও এমন কিছু দেখিনি, যার জন্যে বইটি পড়া জরুরি মনে হতে পারে। অথচ, ছাত্রছাত্রীরা বাণিজ্যচক্রের এমন সব মডেল গলাধঃকরণ করছে নির্দ্বিধায়, যার প্রয়োজনীয়তা প্রশ্নাতীত নয়, বিশেষত ভারতের মতো একটি অর্থব্যবস্থাকে বুঝতে।
১৯৬২-৬৩ থেকে ১৯৯৮-এ নোবেল প্রাপ্তি পর্যন্ত ৩৫ বছরে অমর্ত্য সেন কল্যাণমূলক অর্থনীতি এবং সামাজিক চয়ন-তত্ত্বে যে বিপুল অবদান রেখেছেন, তার কণামাত্র এ দেশের কোনও সিলেবাস ঢুঁড়ে পাওয়া যাবে না আজও। ষাট এবং সত্তরের দশক জুড়ে একের পর এক অতি গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক গবেষণাপত্র অতি উচ্চাঙ্গের আন্তর্জাতিক জার্নালগুলিতে প্রকাশ করে গিয়েছেন। নোবেল কমিটি পরে বলেছে যে, মূলত এই তাত্ত্বিক অবদানের জন্যেই তাঁকে নোবেল দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতি এবং দর্শনশাস্ত্রের মধ্যে সেতুস্থাপনেও প্রধান ভূমিকায় তখন দেখা যাচ্ছে তাঁকে। পরে আশির দশকে উন্নয়নের মূল্যায়নের ধারণা ও পদ্ধতিতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনলেন, তাও কল্যাণমূলক অর্থনীতি এবং সামাজিক চয়ন-তত্ত্বে তাঁর কাজের সূত্র ধরেই। দর্শনের শক্তপোক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানো তাঁর স্ব-ক্ষমতার ধারণা নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জ মানবোন্নয়নের ধারণাকে উন্নয়নের মর্মবস্তু হিসেবে গত বত্রিশ বছর ধরে প্রচার করে চলেছে। এত কিছুর পরও আমাদের মাস্টারমশায়রা অমর্ত্য সেনকে সিলেবাসে জায়গা দিতে অনাগ্রহী, এর ব্যাখ্যা কী?
১৯৭০-এ প্রকাশিত হল তাঁর কালেক্টিভ চয়েস অ্যান্ড সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার, যাকে সামাজিক চয়ন-তত্ত্বের প্রথম টেক্সট বই বলা যায়। তার পর ১৯৭৩ সালে অন ইকনমিক ইনইকোয়ালিটি। অসাম্য বিষয়ে এমন কাজের বই ইতিপূর্বে আর কেউ লেখেননি— প্রায় অর্ধ শতক পরেও অসাম্যের যে কোনও আলোচনা শুরু করতে হলে এই বইটিকে বাদ দিয়ে হবে না। ১৯৮৫-তে এল কমোডিটিজ় অ্যান্ড কেপেবিলিটিজ়। তাঁর স্ব-ক্ষমতার ধারণার তাত্ত্বিক কাঠামোটি বুঝতে এই বইটি পড়তেই হবে। শুধু এই তিনটি বইয়ের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের পরিচিত করিয়ে দিতে পারলেই অর্থনীতি চর্চার একটি অল্প-জানা কিন্তু দারুণ আকর্ষণীয় যুক্তিকাঠামোর জগতে তাদের ঢুকিয়ে নেওয়া যায়।
তাঁর বইগুলি গোটা বিশ্বে কয়েক ডজন ভাষায় তর্জমা হয়েছে। পড়ানো হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর তত্ত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ ডি হয়েছে কয়েক ডজন। অথচ দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই সজীব এবং সতত-পল্লবিত জ্ঞানভান্ডার আমাদের ছাত্রছাত্রীদের কাছে অনাস্বাদিত থেকে যাচ্ছে। কারণটা কী? তত্ত্বে অনাগ্রহ? তা তো বলা যায় না। অন্তত কলকাতার বাজারে তত্ত্বের সঙ্গে সামাজিক সম্মানের একটি একমুখী সম্পর্ক আছে বলেই জানি। সমস্যা হল, কলকাতায় যাঁরা ‘তত্ত্ব করেন’, তাঁরাও নিজের প্রবন্ধ লেখার জন্য যে ক’টি পেপার না পড়লেই নয়, তার বাইরে খুব কিছু পড়েন না। ফলে, ছাত্রছাত্রীদেরও অনেক রকম বিষয়ে ভাবতে অনুপ্রাণিত করার কথা তাঁদের মনে ঠাঁই পায় না। তবে, সবাই এ রকম নন— কেউ কেউ আছেন, যাঁরা এই ধারার বাইরে গিয়ে সাধ্যমতো চেষ্টা করেন পাঁচটি বিষয় নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ভাবাতে।
জন মেনার্ড কেন্স-এর যুগান্তকারী বই দ্য জেনারেল থিয়োরি অব এমপ্লয়মেন্ট, ইন্টারেস্ট অ্যান্ড মানি ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয়। শোনা যায়, কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপকদের হাতে বইটি কয়েক মাসের মধ্যে পৌঁছে যায়। বইটি যে যুগান্তকারী, তা বুঝতে ভুল করেননি তাঁরা; কালবিলম্ব না করে ছাত্রছাত্রীদের পরিচয় করিয়ে দেন বইটির সঙ্গে। যে হেতু বিষয়টি সিলেবাসে নেই, অতএব অগ্রাহ্য করতে হবে, এমন কথা ছাত্রছাত্রীরা ভাবেননি। অধ্যাপকরাও ‘পড়ে নিয়ে পড়াতে হবে, সময় কই’ এই অজুহাতের কথা স্বপ্নেও ভাবতেন না।
উচ্চশিক্ষার সেই বৌদ্ধিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার কাল পেরিয়ে এসেছি অনেক দিন। প্রথম শ্রেণির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে আজকাল উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রীরা কর্পোরেট সংস্থায় অ্যানালিস্ট-এর চাকরি পাচ্ছে। এই দুর্দিনে এর থেকে পরিতৃপ্তির কথা আর কী হতে পারে! কর্পোরেট কর্তারা অবশ্য হবু অ্যানালিস্টরা প-এ ‘পাইথন’ (একটি সফটওয়্যার প্রোগ্রাম) জানলেই খুশি।
কেন অমর্ত্য সেনকে পাঠ্য তালিকায় আনা উচিত, তার অনেক কারণ। ধরা যাক তাঁর সূক্ষ্ম যুক্তিকাঠামোর এই দিকটি। ওঁর সাক্ষাৎকারগুলি যাঁরা পড়েছেন বা শুনেছেন, খেয়াল করে দেখবেন, তিনি প্রায় প্রতিটি বাক্যের শুরুতে জুড়ে দেন, “এটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে...।” যেখানে আমি বা আপনি হয়তো বলব, “আমি মনে করি...।” এই দুইয়ের মধ্যে ফারাক কোথায়? ফারাকটি দর্শনের গভীরে প্রোথিত। অর্থনীতি বলে, আমি কী খাব পরব মাখব, তা ঠিক করি আমার পছন্দ অনুসারে। সেটি যদি হয় একটি বেমানান পোশাক পরে আমি আমার ঘরে বসে দুব্বোঘাস চিবুচ্ছি, তা হলেও সত্যিই অন্যের কিছু বলার নেই। কিন্তু নানা বিষয়ে আমার যেমন পছন্দ থাকে, তেমনই আমার মূল্যায়নও থাকে। আমি সিগারেট খেতে পছন্দ করি কিন্তু আমি সিগারেট খাওয়াকে মূল্যবান বলে মনে করব না, যতটা মনে করব সবুজ আনাজ খাওয়াকে, যদিও আনাজ আমার পছন্দের তালিকায় অনেক নীচে। আশ্চর্যের কথা, পছন্দ আর মূল্যায়নের এই তফাতটি মূলধারার অর্থনীতিতে করা হয় না। পছন্দই সেখানে সব। পছন্দের ক্রমাঙ্কে যেটি উপরে আছে, তাকে বেছে নিয়ে উপভোগ করলেই সর্বোচ্চ কল্যাণ।
দার্শনিকরা কিন্তু অর্থনীতির এই বালখিল্যতায় হাসবেন। তাঁরা মোটা বই লিখবেন এটি বোঝাতে যে, অমুক বা তমুক বিষয় বা অবস্থানটিকে মূল্যবান মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। কেউ যদি বলেন ‘এটি আমার ব্যক্তিগত মত বা পছন্দ’, তা হলে সেখানেই যুক্তির শুরু এবং শেষ, অতএব সেটি দর্শন নয়। কিন্তু যদি বলেন, এক জন যুক্তিবাদী মানুষের এই যুক্তির সঙ্গে সহমত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে— যুক্তিবিদ্যার শুরু সেখান থেকে, কারণ দার্শনিককে যুক্তির ডালপালা বিস্তার করে তা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই পার্থক্যটি অনুধাবন না করেই মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কিংবা অর্থনীতির মাস্টারের চাকরি পেলে কী হতে পারে, অনুমান করা চলে। ‘আমি জানি’র দাপাদাপিতে অমর্ত্য কোণঠাসা হয়ে যান নর্থ ব্লকে বা ক্লাসঘরে।
সমাজবিজ্ঞানের অন্য শাখার পাঠ্যক্রমেও অমর্ত্য সেনের লেখালিখির অন্তর্ভুক্তির পক্ষে জোরালো কারণ আছে। জননীতি চিন্তায় একটি প্রধান দ্বন্দ্ব হল এক দিকে বিশুদ্ধ ব্যক্তিস্বাধীনতার দর্শন, আর অন্য দিকে প্যাটার্নালিজ়ম বা অভিভাবকীয়তার অস্বস্তিকর বাড়াবাড়ি। সে দ্বন্দ্বের নিরসনে অমর্ত্য বার বার গণপরিসরে আলোচনা, যুক্তিতর্ক, সমষ্টির বিচারশীলতায় জোর দিয়েছেন। আর জোর দিয়েছেন আমাদের অবস্থান-সঞ্জাত দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের প্রয়োজনীয়তার দিকে। গণতন্ত্রকে পাকাপোক্ত ভিত্তিতে খাড়া করতে গেলে এগুলি অপরিহার্য।
এই কথাগুলি পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হলে তা ক্রমে জনচেতনায় পৌঁছবে, এমন একটা আশা করা যেতে পারে। তাতে অমর্ত্য সেনের নয়, লাভ আমাদেরই।
নির্দেশক, ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা