গ্রাফিক—শৌভিক দেবনাথ।
২০২১ সম্পর্কে এক জন চমৎকার একটি মন্তব্য করলেন, ‘‘এই বছরের সব থেকে ভাল বিষয়টি হল এই যে, বছরটি শেষ হল।’’ কোন বঙ্কিম মন থেকে এই রসিকতা উঠে এসেছে, তা বোঝা দুরূহ নয়। বিশেষ করে যখন আমরা সেই বছরের ভাইরাস-ভীতিকে নতুন বছরেও বহন করতে চলেছি।
এর বাইরে অবশ্য নতুন বছর সম্পর্কে বেশ কিছু ইতিবাচক বিষয় নজরে আসছে, বিশেষ করে যে সনটি শুরু হতে চলেছে খেলাধুলো দিয়ে। শুধুমাত্র ক্রিকেট নয়, যাতে ভারত বিগত গোটা বছর ধরেই চূড়ান্ত ভাল (তর্কসাপেক্ষ) খেলেছে, দলগত সাফল্যের উদাহরণ রেখেছে। পাশাপাশি, গত বছরে অলিম্পিক্সে এখনও পর্যন্ত সব থেকে প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন উদাহরণটিও রাখতে সমর্থ হয়েছে। পদকের ভাঁড়ারটি যদিও তেমন ভরন্ত বলে বোধ হয়নি। তবু হকির ক্ষেত্রে এক পুনরুজ্জীবন লক্ষ করা গিয়েছে। ট্র্যাক এবং ফিল্ড ক্রীড়াগুলিতে নতুন গতি দেখা দিয়েছে। ব্যাডমিন্টনে দেশ তার সামর্থ্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষত, মহিলাদের বিভাগে রীতিমতো আশার সঞ্চার করেছে।
কুস্তি, ভারোত্তোলন, তিরন্দাজি, মাঝারি-দূরত্বের দৌড়, রাইফেল ছোড়া, এমনকি, গল্ফের ক্ষেত্রেও ছবিগুলি উৎসাহব্যঞ্জক। তবু বলতে হবে যে, এখনও অনেকখানি পথ চলা বাকি। বিশেষ করে ফুটবলের মতো খেলার ক্ষেত্রে, যেখানে গতি এবং ক্ষমতার এক সুচারু সমন্বয় প্রয়োজন, সেই সঙ্গে প্রয়োজন মনোবল এবং কৌশলগত দক্ষতার, সেখানে কিছু কাজ বাকি রয়ে গিয়েছে।
অলিম্পিকে পদক জয়ী নীরজ চোপড়া। ফাইল ছবি।
এর পরেই আসি শেয়ার বাজারের কথায়। ‘ফিনানশিয়াল টাইমস’ আমেরিকান লগ্নি-বিষয়ক সংস্থা এমএসসিআই-এর উদ্ধৃতি দিয়ে জানাচ্ছে যে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলির শেয়ার বাজারের পরিস্থিতি খুব সুবিধের বলে বোধ হয়নি। কিন্তু এ কথা ভারতের ক্ষেত্রে সত্য নয়। ২০০৮-এর আর্থিক সংকটের পর থেকে প্রকৃত অর্থেই ভারত সেনসেক্সে দুই অঙ্কের বৃদ্ধি এই প্রথম উপর্যুপরি তিন বছর ধরে প্রত্যক্ষ করে চলেছে।
তৃতীয় যে ইতিবাচক বিষয়টি লক্ষণীয়, সেটি দেশের উদ্যোগপতিদের জগতে প্রতিভাবানদের উত্থান। এটি অবশ্য নতুন কিছু নয়। গত তিন দশকে ভারত বেশ কিছু প্রথম প্রজন্মের উদ্যোগপতির উত্থান প্রত্যক্ষ করেছে, যাঁদের মধ্যে সুনীল মিত্তল এবং উদয় কোটক উল্লেখযোগ্য। এ ব্যতিরেকে সফটঅয়্যার এবং ওষুধ প্রস্তুতির ক্ষেত্রে নতুন আলো দেখা দিয়েছে, দেশীয় অটোমোবাইল শিল্পে মুঞ্জলদের মতো উদ্যোগীদের উত্থান লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
দেশের উদ্যোগপতিদের জগতে প্রতিভাবানদের উত্থান।
এঁরা এবং এঁদের মতো আরও অনেকেই বেশ কিছু ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে বৃহত্তর অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। আজকের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলির মধ্যে সামনের সারিতেই যারা রয়েছে (বৈদ্যুতিক যানবাহন, পরিবেশবান্ধব শক্তিসমূহ, বৈদ্যুতিন সামগ্রী উৎপাদন এবং খুচরো ব্যবসা) এবং প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রের ‘ইউনিকর্ন’-রা (অর্থাৎ, যে সব স্টার্ট-আপ ব্যবসার অর্থমূল্য ১০ লক্ষ ভারতীয় টাকার সীমানা পেরিয়েছে) এই অগ্রগতির যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে প্রমাণ রাখতে সমর্থ হয়েছে। এই সব উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করছে যে পোক্ত বাণিজ্যিক যুক্তিকাঠামো আর নৈতিকতার উপরে এদের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত, তার উপর। গত দু’দশকে যারা এই দায় পালনে অগ্রবর্তী ছিল, তাদের তুলনায় এরা অন্য রকম। পূর্বতনরা ব্যর্থ হয়েছিল মূলত সম্পত্তির ব্যবসায় (রিয়্যাল এস্টেট), পরিকাঠামো নির্মাণের ব্যবসাগুলিতে এবং বিমান পরিবহণের বাণিজ্যে।
চতুর্থত, সরকারের গণকল্যাণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের বিষয়ে মোটের উপর নিঃসন্দিহান ক্ষমতার কথাও উল্লেখ করা জরুরি। এই কাজে সরকার প্রযুক্তিকেই বাহন হিসেবে ব্যবহার করেছে। এ বিষয়ে কৃতিত্বের স্বীকৃতি প্রাথমিক ভাবেই প্রধানমন্ত্রীর প্রাপ্য। কিন্তু এই কাজে সরকারি আমলা এবং প্রযুক্তি-বিষয়ক উদ্যোগপতিদের সাধুবাদ না জানানোও অন্যায়। তাঁরাই নীতিকে প্রয়োগের স্তরে পৌঁছে দিয়েছেন। কেউ আশা রাখতেই পারেন যে, একই কাজ উন্নতমানের প্রাথমিক শিক্ষা এবং গণস্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রেও ঘটবে। এই দু’টি ক্ষেত্রে কাজ এখনও অনেকখানি বাকি রয়ে গিয়েছে।
ভারত প্রথম বার তার নিজের ভূমিতে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে।
পঞ্চমত, ক্রমাগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, এমন একটি দেশে, কয়েকটি হতাশার দশক পেরিয়ে এক যথোপযুক্ত প্রতিরক্ষাগত উৎপাদনের ভিত্তি তৈরির প্রচেষ্টা এক সাফল্যের স্তরে পৌঁছেছে। লাইট কমব্যাট যুদ্ধবিমান উৎপাদন সম্ভব হয়েছে, সম্ভব হয়েছে লাইট কমব্যাট হেলিকপ্টার নির্মাণও। ভারত প্রথম বার তার নিজের ভূমিতে বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। পরমাণুশক্তি চালিত দ্বিতীয় ডুবোজাহাজটি নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছে এবং ক্ষেপণাস্ত্রের এক বিশাল সম্ভারকে নিজের হাতে প্রস্তুত রাখতেও সফল হয়েছে।
এই দৃশ্যমান সাফল্যের পিছনে রয়েছে উপকরণের যোগান দেওয়া সংস্থাগুলির অকথিত সাফল্যের কাহিনি। যাদের এক বড় অংশই মাঝারি এবং ক্ষুদ্রশিল্প। এই সব সংস্থার উৎপাদনচক্র আজও খুব বেশি সময়সাপেক্ষ। এগুলিকে স্বল্পসময়ে কী করে নির্বাহ করা যায়, তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ রয়েছে। কিন্তু বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিরক্ষা সামগ্রীর আমদানিকারক দেশে থেকে ভারত আজ যে এই ক্ষেত্রের এক লক্ষণীয় উৎপাদকে পরিণত, এ তথ্যটি সত্যিই আশাব্যঞ্জক।
পরিশেষে, আগামী দু’বছরের মধ্যে আমরা হয়তো দেশের পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগগুলির সুফল দেখতে পাব। হয়তো এই সময়ের মধ্যে পশ্চিম ভারতের উচ্চগতি সম্পন্ন মালবাহী রেল-করিডর এবং মসৃণতর এক্সপ্রেসওয়ে এবং সড়কপথ নির্মিত হয়ে যাবে। শক্তি উৎপাদনে ঘাটতির দিন গত হয়েছে (যদিও এই ক্ষেত্রটি এখনও কম শুল্কের কারণে কিছুটা নড়বড়ে), টেলি-যোগাযোগ বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে বলাই যায়, অন্তর্জাল এবং মোবাইল ব্যাঙ্কিং-সহ অন্যান্য প্রযুক্তিনিবিড় পরিষেবা ক্ষেত্রগুলি লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনযাপন সরল করতে সমর্থ হয়েছে, বিমানযাত্রা আগের থেকে অনেক কম ব্যয়সাপেক্ষ এবং আমরা খুব শীঘ্রই দ্রুততর গতিসম্পন্ন, অধিক আরামপ্রদ যাত্রীবাহী ট্রেনের দেখা পাব বলে মনে হয়।
সুতরাং ‘অনায়াস জীবনযাত্রা’-র পদধ্বনি ইতিমধ্যেই শ্রুত হয়েছে বলা যায়। এমন একটি দেশ, যেখানে অনেক কিছুই এখনও পশ্চাদপদ, সেখানে এই সব ইতিবাচক কথা মাথায় রেখে একটি নতুন বছর শুরু করা অবশ্যই এক আশাপ্রদ ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে শুভ বলে মনে হচ্ছে।