বিধানসভার বাজেট অধিবেশনে রাজ্যপালকে নিয়ে যা ঘটল, তাকে নজিরবিহীন বললে হয়তো কিছুই বলা হয় না। পদাধিকারে রাজ্যপাল সংবিধানের ‘রক্ষক’ বলে স্বীকৃত। জগদীপ ধনখড় প্রায় প্রতি দিন তাঁর সেই ভূমিকার কথা সকলকে মনে করিয়ে দিতে চান। কিন্তু বাজেট অধিবেশনে রাজ্যপালের প্রারম্ভিক ভাষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিধানসভায় এ বারের কাণ্ডে সেই ধনখড়ের আচরণ সম্পর্কেই বিবিধ বিভ্রান্তি ও প্রশ্নের অবকাশ যথেষ্ট।
রাজ্যে বিরোধী-রাজনীতি ক্রমশই খাদের দিকে চলেছে। বিধানসভা ভোটের পর থেকে পুরসভাগুলির সাম্প্রতিক নির্বাচন পর্যন্ত দেখলে এর আর কোনও ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার হয় না। বিজেপির ভোট আরও কত কমল বা বামের ভোট কোথায় কতটা বাড়ল, সেটা ভোট-অঙ্কের বিশ্লেষণে অবশ্যই খুব মূল্যবান। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে কোন দল কত আসন পেল বা কারা কতগুলো বোর্ড দখল করল, সেটিই প্রধান বিচার্য হয়।
সেই নিরিখে রাজ্য এখন, বলতে গেলে, বিরোধী-শূন্য। ভোট একশো ভাগ স্বচ্ছ হয়নি এটা যেমন ঠিক, তেমন কোনও কালেই যে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট হয় না, তা-ও মেনে না নেওয়ার কারণ নেই। বস্তুত আজ যাঁরা শাসক, কাল তাঁরা বিরোধী হলে ঠিক একই ভাবে অভিযোগ করবেন, প্রতিবাদ জানাবেন। এটাই স্বতঃসিদ্ধ, অন্তত বাংলায়।
এখন যদি কেউ বলেন, জোর-জুলুম, মারপিট না হলে বিরোধীরা আরও কয়েকটি আসন পেতেন, সেই কথা অস্বীকার করা ভুল হবে। তা বলে কেউ যদি ভেবে বসেন, ভোট ‘অবাধ’ হলেই রাজ্যের পুরসভাগুলিতে এখন হই হই করে বিরোধীদের ধ্বজা উড়ত, তা হলে তাঁদের মানসিক স্থিতি সম্পর্কেও উদ্বেগের কারণ থাকবে।
সোজা কথায়, গোলমাল, ছাপ্পা, গাজোয়ারির ঘটনাগুলি না ঘটলেও বড় ছবিটি বদলাত না। তৃণমূলই জিতত এবং তাদের ভাবমূর্তির পক্ষে সেটা অনেক ভাল হত। গোলমাল যা হয়েছে, সংখ্যার কম-বেশি দিয়ে তাকে বিচার করলেও ভুল হবে। রাজনীতির লোকেরা মানুন বা না-মানুন, এর সঙ্গে কিন্তু ‘পারসেপশন’ অর্থাৎ সাধারণ ধারণা যুক্ত হয়ে থাকে।
যেমন, ১৯৭২ সালের ভোটে কংগ্রেস ব্যাপক রিগিং ও সন্ত্রাস করে জিতেছিল, সেই অভিযোগ মোটামুটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আজও ভোটে দুর্নীতির দৃষ্টান্ত হিসাবে ’৭২-কে সামনে আনা হয়। কিন্তু ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় এসে জ্যোতি বসুর সরকার এ বিষয়ে যে তদন্ত কমিশন করেছিল তাতে রিগিংয়ের ব্যাপকতা সে ভাবে প্রমাণিত হয়নি। যত দূর জানি, কমিশন যত সংখ্যক আসনের দিকে ইঙ্গিত করেছিল, সেগুলি না ধরলেও কংগ্রেসের জয় আটকাত না। সেই রিপোর্ট অবশ্য বিধানসভায় জমা পড়েছে বলে জানা নেই। রিগিংয়ের ছাপ কিন্তু কংগ্রেসের গায়ে লেপ্টে আছে।
এক সময় হুগলি জেলায় সিপিএম সাংসদ অনিল বসুর জয়ের গগনচুম্বী ব্যবধান অনেকেই ভোলেননি। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তা দেখে এক বার বলেছিলেন, ‘অশ্লীল!’ মেদিনীপুর জেলার বিধায়ক নন্দরানি দলকে নিয়েও একই কারণে আলোচনা হত। জয়ের সংশয়ে নয়, জয়ের ব্যবধানে। খুঁজলে এমন নজির আরও মিলবে।
পুরনো থাক। রাজ্যে এখনকার পরিস্থিতি হল, শাসক তৃণমূল তামা-তুলসী-গঙ্গাজল হাতে করে ভোট করলেও রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির বরাতে আপাতত পতন এবং আরও পতন। রাজ্যে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ফলে উজ্জীবিত হওয়া দলটি পর পর ধাক্কা খেতে খেতে আজ তাই নিজেদের মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত। রাজ্য দখলের স্বপ্ন ফেরি করতে আসা ওই দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বিধানসভা ভোটের পরেই কার্যত পিঠটান দিয়েছেন। সংগঠনে টানাপড়েন।
তা হলে বিরোধী পরিসর যাবে কোথায়? রাজভবনের ‘সক্রিয়তা’র মধ্যে অনেকে সেই ফাঁক পূরণের ছবি দেখতে পাচ্ছেন। আড়াই বছর আগে রাজভবনে প্রবেশের পর থেকে রাজ্যপাল ধনখড়ের বিভিন্ন কার্যকলাপ ও কথাবার্তা প্রধানত বিজেপির ‘উৎসাহবর্ধক’ হয়ে উঠেছে কি না, সেই প্রশ্নে তর্কও আজ বোধ হয় অনর্থক।
সাংবাদিক হিসাবে কয়েক দশক বিধানসভার অধিবেশন দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। বহু অশান্তি, ক্ষোভ-বিক্ষোভের সাক্ষী থেকেছি। অগ্রজদের কাছে জেনেছি, যুক্তফ্রন্ট বা তারও আগে কংগ্রেস আমলে বিধানসভায় আরও নানা তুলকালামের ইতিহাস। তবে এ বার যা হল, তেমনটি শুনিনি। দেখিওনি।
আমরা দেখেছি, বামফ্রন্টের আমলে সভাকক্ষে গভীর রাত পর্যন্ত কংগ্রেস বিধায়কদের অবস্থান-বিক্ষোভ। আর তাঁদের বার করতে পুলিশের ডান্ডাবাহিনীকে বিধানসভার ‘নিরাপত্তারক্ষী’ (ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ড) পদে সাময়িক ভাবে নিয়োগ করে সভাকক্ষে ঢুকিয়ে দেওয়ার দৃশ্য। সে দিন মার খেয়ে মাথা ফেটেছিল নেতাজির ভাইপো শিশির বসুর। হাতে আঘাত পেয়েছিলেন অধ্যাপক কিরণ চৌধুরী। তাঁদের সে দিনের প্রতিবাদের কারণ, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু কংগ্রেস বেঞ্চকে ‘স্কাউন্ড্রেল’ বলেছিলেন। সে কথা তিনি ফিরিয়ে নিতেও চাননি।
রাজ্যপালের ভাষণ ঘিরেও অনেক অশান্তি আমাদের দেখতে হয়েছে। বহু বার হট্টগোলে, অশান্তিতে ভাষণের একটি কথাও শোনা যায়নি। কিন্তু রাজ্যপালেরা তাঁদের জরুরি ন্যূনতম কর্তব্যটুকু সমাধা করে দিয়েছেন। তার জন্য স্পিকার বা মুখ্যমন্ত্রীকে করজোড়ে আবেদন জানাতেও দেখিনি।
এক বার তো এক রাজ্যপালের প্রবেশপথে শুয়ে পড়েছিলেন বিরোধীরা। পাশের পথ দিয়ে আনা হয়েছিল তাঁকে। আর এক বার সভায় মাইক্রোফোনের তার ছিঁড়ে দেওয়া হল। প্রবল হট্টগোলের মধ্যে অ-মাইক বক্তৃতা দিতে শুরু করে দিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল। আসলে প্রতিবাদের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং রাজ্যপালের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা দু’টিকেই মান্যতা দিয়ে তাঁরা নিজেদের কাজ করতে পেরেছেন। উল্লেখযোগ্য হল, রাজ্যপাল নুরুল হাসানের আমলে একটি ঘটনা। তিনি ঠিক এই রকমই বাজেট অধিবেশন উদ্বোধন করতে এসেছিলেন। যথারীতি বিরোধীপক্ষ কংগ্রেস চিৎকার করতে থাকে। ‘সরকারের তৈরি মিথ্যা কথা পড়তে দেব না’ ইত্যাদি স্লোগানে সভা উত্তপ্ত।
সে দিনও নুরুল হাসান ভাষণ পাঠ শুরু করামাত্র ‘রে রে’ করে বিরোধী সদস্যরা ওয়েলে নেমে পড়েন। কয়েক জন রাজ্যপালের দিকে ধেয়ে যান। তাঁর হাতের কাগজপত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়। তাঁর চশমা খুলে যায়। তাঁর গায়ে অল্পস্বল্প ধাক্কাও পড়েছিল। এখন প্রয়াত এক তৃণমূল সাংসদ তখন কংগ্রেসে। তিনিই ছিলেন রীতিমতো ‘অ্যাংরি’ ভূমিকায়। কিন্তু সব সত্ত্বেও রাজ্যপাল তাঁর বক্তৃতা এড়ানোর চেষ্টামাত্র করেননি। প্রেস বক্সে বসে সব দেখলাম।
রাজ্যপাল নুরুল হাসানের সঙ্গে আমার প্রায়ই কথা হত। সে দিন রাতে রাজভবনের ফোন। রাজ্যপাল জানতে চাইলেন, “আমার পেটে কোন এমএলএ খোঁচা দিচ্ছিলেন, তুমি দেখেছ?” নামটি তাঁকে বলিনি। জানিয়েছিলাম, জটলায় ভাল করে দেখতে পাইনি। কিন্তু অবাক করে দিয়ে বিদগ্ধ পণ্ডিত নুরুল হাসান প্রত্যুত্তরে হেসে বলেছিলেন, “শাস্তির জন্য নয়, নাম জানলে তাঁকে ডেকে আমি লাঞ্চ খাওয়াতাম!”
বিধানসভায় সোমবারের ঘটনাবলি দেখতে দেখতে সে সব মনে পড়ছিল। রাজ্যপাল সংবিধানের রক্ষক। তিনি বাজেট অধিবেশন উদ্বোধন না করে অর্থাৎ স্বয়ং একটি সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি করে ফিরে যেতে পা বাড়িয়েছেন, এটা অভাবনীয়!
এ রকম পরিস্থিতি তো কতই হয়! হয়েছেও। তাতে রাজ্যপালের ভাষণ পাঠে বিশেষ সমস্যা কোথায় হল, সেটাই সাধারণ বুদ্ধির অগম্য। শান্ত পরিবেশ নিশ্চয় অভিপ্রেত। কিন্তু সভা বাধ্য ছাত্রের মতো বসে না থাকলে রাজ্যপাল বক্তৃতাই করবেন না, সংবিধানের কোন ছত্রে তা লেখা আছে?
যেমন বোঝা কঠিন, পুরো ঘটনার দায় রাজ্যপাল শুধু শাসক দলের উপরেই বা চাপাচ্ছেন কেন? বিজেপির ক্রিয়া সঙ্গত, আর শাসক তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া অশিষ্ট— এটাই কি অন্তর্নিহিত বার্তা?