আলাদা আলাদা ভাবে ‘স্ব’ এবং ‘রাষ্ট্র’-এর মানে কী? আর, এক সঙ্গে ‘স্বরাষ্ট্র’ মানেটাই বা কী? কিংবা একটু সম্প্রসারিত হয়ে যদি ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক/মন্ত্রী’ হয়, তা হলে তার মানেটা কী দাঁড়ায়? এই প্রশ্নগুলো অহিন্দিভাষী সব ভারতীয়ের মধ্যে আবার নতুন করে জেগে উঠছে। তাঁরা জানতে চাইছেন— সেই স্বরাষ্ট্রে কি স্ব-স্ব মাতৃভাষা অধিকার বা সম্মান পায়? ভাষা-নাগরিকত্বের অথবা সাংবিধানিক বহু প্রশ্নের দিকে না গিয়ে বরং কয়েকটি অন্য বিষয়ের দিকে একটু নজর ফেরাই।
১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯। সাংবিধানিক সংসদে কোন ভাষাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করা যায় তাই নিয়ে বিতর্ক চলছে। জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ইংরেজরা যখন ভারতে এসেছিল তখন ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব, এবং যখন চলে গেল তখন ইংরেজি ভাষার গুরুত্বের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক। এখন ইংরেজি ভাষা প্রায় একটি আন্তর্জাতিক ভাষা হয়ে উঠেছে। ফলে এ কথা অবাস্তব যে, আমরা যা জানি সে সব ভুলে যাব, এবং যা যা আমরা শিখেছি তার সুবিধা আমরা নেব না।... আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা কোন ভারত দেখতে চাই— বিজ্ঞান ইত্যাদিতে সমৃদ্ধ এক আধুনিক ভারত, না কি এক পুরাতন ভারত যার সঙ্গে বর্তমান সময়ের কোনও রকম সম্পর্ক থাকবে না?
সেই দিনই ওই বিতর্কেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, হিন্দিভাষীরা যা যা সুবিধা পাচ্ছেন অহিন্দিভাষীরা সেই সেই সুবিধা পাচ্ছেন না। বিদেশি শাসকেরাও এই সাহস দেখাননি। জ্ঞান-বিজ্ঞান, কারিগরি ইত্যাদি সব বিষয়েই হিন্দির ব্যবহার কেবলমাত্র হিন্দিভাষীদেরই সাহায্য করবে। তাঁর প্রশ্ন: “তা হলে বাংলা, গুজরাত, মহারাষ্ট্র, মাদ্রাজ— এই সব রাজ্য, শহরের ক্ষেত্রে কী হবে? তারাও কি তাদের ভাষা ব্যবহার করে যাবে? তা হলে জ্ঞানের আন্তঃরাজ্য আদানপ্রদান চলবে কী ভাবে? আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেই বা কী হবে?... এই বিষয়টিকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করবেন না।”
১৯৫১-র ভাষা শুমারির সমীক্ষায় দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে কেবলমাত্র একটি ভারতীয় ভাষার উল্লেখ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ, ইংরেজিকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে উল্লেখ করার স্বাধীনতা ছিল না। আবার, যাঁদের মাতৃভাষা হিন্দি বা উর্দু তাঁদের দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে এই তিনটি ভাষার একটিরও উল্লেখ করার স্বাধীনতা ছিল না।
এই তিনটি বিষয় থেকে পরিষ্কার যে, রাষ্ট্রীয় ভাষা নির্বাচনের ক্ষেত্রে নেহরু বা শ্যামাপ্রসাদের মতামতকে যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, ঠিক তেমনই দেশের একটা বড় অংশের সাধারণ নাগরিকেরও দ্বিতীয় ভাষা নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনও স্বাধীনতা ছিল না। তাঁরা বাধ্য হয়েছিলেন মাতৃভাষা অথবা দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দিকে মেনে নিতে। এই প্রশাসনিক (না কি রাজনৈতিক?) সিদ্ধান্তের ফল একেবারে হাতেনাতে পাওয়া গেল। প্রথম ও দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে হিন্দির অবস্থান একেবারে শীর্ষে পৌঁছে গেল।
উত্তরপ্রদেশ, বিহার, বম্বে, মধ্যপ্রদেশ— এই সব রাজ্যে এই বৃদ্ধির শতকরা হার এতটাই বেশি ছিল যে, সমীক্ষার আধিকারিকেরা সেই অস্বাভাবিকতার কারণ দর্শাতে বাধ্য হয়েছিলেন। ব্যাখ্যায় তাঁরা লিখেছিলেন প্রতিবেশী রাজ্যগুলি থেকে হিন্দিভাষীদের এই সব রাজ্যে চলে আসা, বেশির ভাগ বিদ্যালয়ে হিন্দি ভাষা শেখানো, প্রচুর সংখ্যক হিন্দি নৈশ বিদ্যালয় স্থাপন করার কথা।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ১৯৪৯-৫০ সালে যেখানে তেমন গণমাধ্যমই ছিল না, সেখানে এই সব মিথ্যে প্রচার করল কে বা কারা? সে কথা ঠিকই। মূলত সরকারি নথিপত্র থেকেই এক ভ্রান্ত ধারণার শুরু, তার পর ক্রমে গণমাধ্যমে তার প্রচার। এই ২০২২ সালে অবশ্য সমাজমাধ্যমই গণমাধ্যমের কাজটি করে দেয়। হিন্দিই দেশের প্রধান ও জাতীয় ভাষা— এ এখন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের মত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সুতরাং অন্যান্য ভাষার উন্নতির জন্য তেমন পথ নেওয়া যাচ্ছে না, যেগুলি ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’পন্থীরা নিতে পারছেন। এত দিন ধরে অন্ধ হয়ে থেকে আজ সংসদে হইচই করে কোনও লাভ হবে কি? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সংসদে হিন্দির জয়গান গাইলেন, বললেন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সব সরকারি কাজ হিন্দিতে হবে। শুনে বিরোধীরা সরব হলেন ‘হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ’ নিয়ে; জয়রাম রমেশ দাবি করলেন, ভারতের মৃত্যুঘণ্টা বাজাচ্ছে হিন্দি ভাষার আগ্রাসন। কিন্তু এ সব কিছুই তো নতুন নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই বহু ভুল, বহু অবজ্ঞার ফলে আজকের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্তমান সরকার কেবল রাজনৈতিক সুবিধার্থে সেই সুযোগ নিচ্ছে।