ক’দিন আগে ধাপায় কাজ করতে গিয়ে এক আবর্জনা কুড়ানি মহিলার বজ্রপাতে মৃত্যু হল। পুর কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হল, নিরাপত্তারক্ষী থাকলেও আবর্জনা কুড়ানিরা কী ভাবে ভিতরে ঢুকলেন? স্পষ্টতই এখানে আবর্জনা কুড়ানিদেরই অপরাধী, নিদেনপক্ষে অনভিপ্রেত বলে দেখার একটি মানসিকতা ধরা পড়ছে। অথচ, আবর্জনা কুড়ানি বা ‘ওয়েস্ট পিকার’-দের বিশ্বের পরিবেশবাদীরা বিশেষ সম্মান করছেন। বলছেন, এঁরা হলেন ‘ক্লাইমেট ভলান্টিয়ার’— যাঁরা নিজেদের শ্রম দিয়ে পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখেন। কলকাতায় প্রায় পঁচিশ হাজার মানুষ আবর্জনা কুড়োনোর কাজে যুক্ত। প্রায় নিখরচায় এই শহরকে আবর্জনামুক্ত রাখতে অনেকটাই সাহায্য করছেন তাঁরা। আরও লক্ষণীয় বিষয় হল, পুর আবর্জনা ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ২০০০ সাল এবং ২০১৬ সালে যে বিধি ঘোষণা করা হয়েছিল, তার অনেকটাই পালন করেন এই আবর্জনা কুড়ানিরাই। পরিবেশ সুরক্ষার নিরিখে দেখলে, পুরসভার চাইতে বেশি নম্বর পাবেন তাঁরা।
আমরা নাগরিকরা পরিবার-পিছু দৈনিক কম বেশি ২০০-৮০০ গ্রাম আবর্জনা তৈরি করি। নিজের বাড়ি থেকে সেই আবর্জনা বেরিয়ে যাওয়ার পরে তার কী হয়, তা নিয়ে আমাদের তেমন মাথাব্যথা নেই। ধরে নিই, পুর কর্তৃপক্ষ বা পঞ্চায়েত যা করা দরকার, তা-ই করছে। যদিও দেখতে পাই, সেই আবর্জনা ধাপার মাঠের মতো বর্জ্য ফেলার জায়গায় জমে স্তূপ হচ্ছে, পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে, কখনও জমছে পাড়ার মোড়েই। আবর্জনা ব্যবস্থার পরিকাঠামো, যা বিধি অনুসারে থাকার কথা, তা তৈরির জন্য চারটি ধাপে কাজ করতে হবে— উৎস থেকে আবর্জনা আলাদা এবং যথাযোগ্য ভাবে সংগ্রহ, শুকনো আবর্জনার পুনর্ব্যবহার (রিসাইক্লিং) নিশ্চিত করা, ভিজে (জৈব) আবর্জনা থেকে সার তৈরি করা বা শক্তি উৎপাদন, এবং অবশিষ্ট আবর্জনা ফেলার জন্য একটি যথোপযুক্ত নিরাপদ স্থান, বা ‘স্যানিটারি ল্যান্ড ফিলিং’-এর ব্যবস্থা করা। এই হল পুর আবর্জনা ব্যবস্থাপনার সম্পূর্ণ পরিকাঠামো।
পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১৫ হাজার মেট্রিক টন এবং কলকাতায় সাড়ে চার হাজার মেট্রিক টন পুর আবর্জনা দৈনিক উৎপন্ন হয়। যার ষাট শতাংশ ‘ভিজে’ অর্থাৎ জৈব, পঁচিশ শতাংশ শুকনো পদার্থ, এবং পনেরো শতাংশ অন্যান্য গোত্রের পদার্থ। কলকাতার নব্বই শতাংশ পুর আবর্জনা ধাপায় নিয়ে যাওয়া হয়, যার মধ্যে আট শতাংশ প্লাস্টিক।
এ রাজ্যের পুরসভাগুলি আবর্জনার বিভাজন এবং পুনর্ব্যবহারের কিছু উদ্যোগ করেনি, এমন নয়। কিন্তু প্রচারের চাইতে কাজ হয়েছে কম। হাইওয়ের পাশে আবর্জনার স্তূপ, ধাপার মাঠে জঞ্জালের পাহাড় থেকেই তার প্রমাণ মিলবে। বরং নানা শ্রেণির বর্জ্যের বিভাজন এবং পুনর্ব্যবহারের কাজটি নীরবে করে চলেছেন আবর্জনা কুড়ানিরা। কলকাতার ঘুম ভাঙার আগেই বস্তা কাঁধে নিয়ে তাঁরা রাস্তার আবর্জনা স্তূপ থেকে কাগজ, প্লাস্টিক, ধাতু, কাপড় ইত্যাদি শুকনো আবর্জনা তুলে নিয়ে যান। দিনের আলোয় এঁরা বিশেষ বেরোন না, পুলিশের ভয়ে।
ধাপাতে কাজ করেন এমন কয়েক হাজার জনের মধ্যে রয়েছেন শ’খানেক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। দিন-রাতে বারো থেকে আঠারো ঘণ্টা কাজ করে এঁদের রোজগার দিনে দু’শো কি তিনশো টাকা। ধাপাতেই তৃতীয় লিঙ্গের শতাধিক মানুষ আছেন, যাঁরা আবর্জনা থেকে ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য বেছে নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এই মানুষগুলিকেই সমাজ ‘আবর্জনা’ বলে মনে করে, তাঁদের প্রতি কাজ করে আমাদের বিরক্তি, ঘৃণা, ভয়। আমরা ধরে নিয়েছি, অস্বাস্থ্যকর ভাবে, ছিন্নভিন্ন পোশাকে, লুকিয়ে-চুরিয়েই তাঁদের বাঁচতে হবে। কেন, সে প্রশ্নটা করা হয়নি। একটি অসরকারি সংস্থার সমীক্ষায় বলা হয়েছে, আবর্জনা কুড়োনোয় নিরত ষাট শতাংশ কর্মীই সপরিবারে, অর্থাৎ মা, বাবা, স্বামী, সন্তান নিয়ে আবর্জনা কুড়োন।
অথচ, আবর্জনা ব্যবস্থাপনা বিধি ২০১৬-তে বলা আছে, আবর্জনা কুড়ানিদের এই ব্যবস্থায় যোগদান করতে দিতে হবে। অসংগঠিত আবর্জনা সংগ্রাহকদের স্বীকৃতি, পরিচয়পত্র দিতে হবে পুরসভা বা পঞ্চায়েতকে। তাঁদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে তুলতে সাহায্য করতে হবে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে শুকনো আবর্জনা সংগ্রহের জন্য উৎসাহিত করতে হবে। সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, চিকিৎসা শিবির করতে হবে তাঁদের জন্য।
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ২০২০-২১ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ‘কত শতাংশ পুরসভা আবর্জনা কুড়ানিদের এবং ব্যবসায়ীদের নথিভুক্তি করেছে?’— এই প্রশ্নের উত্তরে লেখা আছে, শূন্য। বাংলায় একটা পুরসভাও বিধি মেনে কাজ করেনি। অথচ, ভারতের অন্তত পঁচিশটি শহরে আবর্জনা কুড়ানিদের সংগঠনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, তাঁদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে। দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই, হায়দরাবাদ, শ্রীনগর, বেঙ্গালুরুতে তাঁদের সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্প, এবং সমবায় গঠন করা হয়েছে।
আর কলকাতা? ধাপার খুব কাছেই আবর্জনা কুড়ানিদের বস্তিগুলো, সেখানে জঞ্জাল পোড়ায় মিথেন গ্যাসের বিষাক্ত ধোঁয়া সর্বক্ষণ ওঁদের শরীরে প্রবেশ করে। কুকুর, সাপ, বিষাক্ত প্রাণীর দংশনে অজস্র ক্ষতে ভরা ওঁদের শরীর। কোমরে ব্যথা, ঘন ঘন জ্বর, পেটের রোগ, শ্বাসের অসুখ লেগেই আছে। এঁদের প্রায় সত্তর শতাংশ মহিলা ও শিশু।
এঁরাও কিন্তু আমাদেরই সহনাগরিক।