Present Situation of Buddhadev's India

অবমাননার সুদীর্ঘ ইতিহাস

ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর চেষ্টায় সতেরো শতাংশ দলিত মানুষকে আম্বেডকরের নাম নিয়ে নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি।

Advertisement

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ জানুয়ারি ২০২৫ ০৬:২৭
Share:

সম্প্রতি ‘বুদ্ধিস্ট সার্কিট’ ভ্রমণের সুযোগ এসেছিল। বুদ্ধের জন্মস্থান, বর্তমান নেপালের লুম্বিনী থেকে শাক্যরাজা শুদ্ধোদনের রাজধানী কপিলাবস্তু (নেপালের তিলাউরাকোট ও ভারতে উত্তরপ্রদেশে পিপরাহোয়া গ্রাম) হয়ে সুজাতা গ্রামের কাছে বোধগয়ায় জ্ঞানার্জনের পর এবং কুশীনগরে মহাপরিনির্বাণের আগে পর্যন্ত যে সকল জায়গায় তিনি গেছেন, উপদেশ দিয়েছেন, সম্মেলন ও প্রচার করেছেন— শ্রাবস্তী বৈশালী নালন্দা রাজগির বারাণসী-সহ সেই সব জায়গা দেখা ছিল উদ্দেশ্য। এই ভ্রমণ জাপানিদের কাছে যতটা জনপ্রিয়, ভারতবাসীর কাছে তত নয়। আলাদা ভাবে হয়তো অনেকে গেছেন, কিন্তু বুদ্ধের পদাঙ্ক অনুসরণের ভাবনা থেকে নয়। পূর্ব এশিয়ার ভিয়েতনাম মায়ানমার কম্বোডিয়া তাইল্যান্ড শ্রীলঙ্কা ইত্যাদি নানা দেশের বৌদ্ধ পর্যটকদের ঘুরতে দেখা গেল, কিছু জায়গায় সম্মেলন ও পূজাপাঠও চলছিল। যে ভারতীয় বৌদ্ধ পর্যটকদের দেখা গেল, তাঁরা মূলত মহারাষ্ট্র ও মধ্যপ্রদেশের, অধিকাংশই দলিত বা জনজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁদের বুকে ও কাপড়ে আম্বেডকরের ছবি-সহ প্রতিষ্ঠানের নাম লেখা।

Advertisement

বৈশালীতে কিছু ভারতীয় বৌদ্ধ পর্যটকের কাছে শুনলাম, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সম্প্রতি রাজ্যসভায় আম্বেডকরের নাম উচ্চারণ করে বলেছেন, বার বার ওঁর নাম নিয়ে কথা বলাটা আজকাল ফ্যাশন হয়ে গেছে, তার চেয়ে এত বার ভগবানের নাম নেওয়া গেলে সাত জন্ম পর্যন্ত স্বর্গে জায়গা মিলত। আম্বেডকরপন্থী এবং ভগবানে বিশ্বাসী, উভয়েরই এতে বিস্মিত হওয়ার কথা। ১৯৩৬ সালে আম্বেডকর ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি গঠন করেন এবং মতান্তর সত্ত্বেও জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে, স্বাধীনতার পর নেহরু সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভায় আইনমন্ত্রী হন। হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠার তীব্র বিরোধী ছিলেন তিনি। শেষ জীবনে বৌদ্ধ ধর্মের শরণাপন্ন হন। ভারতের বহু দলিত সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ হিন্দুধর্ম বর্জন করে বৌদ্ধ খ্রিস্টান জৈন ইত্যাদি ধর্মের আশ্রয় নিয়েছেন।

ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর চেষ্টায় সতেরো শতাংশ দলিত মানুষকে আম্বেডকরের নাম নিয়ে নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি। অথচ গত দশ বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে দলিতদের নিধন ও নিপীড়ন হয়েই চলেছে উচ্চবর্ণ ও উগ্র হিন্দুদের হাতে। আবার মাঝেমধ্যেই বিজেপি আম্বেডকরকে নিজেদের লোক বলে চালাতে চায়; শুধু আম্বেডকর নয়, গান্ধী পটেল সুভাষচন্দ্র সবাইকে আত্তীকরণ করে, তাঁদের অনুরাগীদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চলছেই। মোদী সরকার ২০১৯-এ সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলে ‘আর্টিকল ৩৭০’ বাতিল করার পর থেকে প্রচার করে— আম্বেডকর আর্টিকল ৩৭০-এর বিরোধিতা করে নেহরু মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এই মন্তব্য সত্যের ধারেকাছেও আসে না, তাঁর পদত্যাগের কারণ ছিল ভিন্ন। জম্মু কাশ্মীর এবং লাদাখ সমস্ত জায়গায় একত্রে গণভোট না করে তিনটে পৃথক জায়গায় আঞ্চলিক গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের কথা বলেছিলেন তিনি। পাকিস্তান অর দ্য পার্টিশন অব ইন্ডিয়া বইতে স্পষ্ট বলেছেন, ভারতে হিন্দুরাজ চালু হলে তা বিপর্যয়ের শামিল হবে, যে কোনও উপায়ে তা আটকাতেই হবে।

Advertisement

হিন্দু সমাজকে আধুনিক ও প্রগতিশীল করতে নেহরু হিন্দু কোড বিল আনেন। অমিত শাহ অন্য একটি মন্তব্যে রাজ্যসভায় বলেছিলেন, এই বিলের সাব-কমিটিতে আম্বেডকরকে চেয়ারম্যান করলে তিনি ১৯৫১ সালে পদত্যাগ করেন। আসলে ১৯৪৭-এর অক্টোবরে আম্বেডকর মন্ত্রিসভায় এই বিলের প্রাথমিক খসড়া পেশ করেন। হিন্দুত্ববাদী দলগুলো এবং হিন্দু নেতারা তার বিপক্ষে ভোট দিয়ে বিরোধিতা করেন। লাগাতার হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ও হিন্দু নেতাদের বিরোধিতার কারণে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, এমনটাই মনে করা হয়। যদিও এই বিলের প্রাথমিক খসড়া পাশ করানোয় কংগ্রেসের ব্যর্থতাও অন্যতম কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

আম্বেডকর হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে, দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের এই ধর্ম গ্রহণে আহ্বান জানান। বুদ্ধ শান্তি মৈত্রী সহিষ্ণুতার বার্তা প্রচার করেছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পর শাক্য বংশের আর অগ্রগতি হয়নি। তিনি যে সব জায়গায় গিয়েছিলেন সেগুলোর অধিকাংশ স্থানে পরে মৌর্য সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার পর যান, স্তূপ নির্মাণ করে নিজের স্মারকস্তম্ভ পুঁতে জায়গাগুলো চিহ্নিত করেন। পরে গুপ্ত ও পাল রাজত্বে এই স্তূপগুলোকে বড় করা হয়, ছোট-বড় অনেক বিহার তৈরি হয়, নালন্দায় বিশ্ববিদ্যালয়ও। উনিশ শতকে প্রত্নতাত্ত্বিকদের তত্ত্বাবধানে খননের পর এই সব স্তূপ পুনরুদ্ধার করা হয়। সারনাথে যে অশোকস্তম্ভ উদ্ধার হয় তার মাথায় আছে চারটি সিংহের মুখ, সামনের দু’টি করে মোট আটটি পা, চব্বিশ ‘স্পাইক’-এর চক্র এবং হাতি সিংহ বৃষ ঘোড়ার মূর্তি। এই স্তম্ভই বর্তমান ভারতের জাতীয় চিহ্ন, চক্রটি আছে জাতীয় পতাকাতেও। এই প্রতিটি চিহ্ন গভীর বৌদ্ধিক অর্থবহ, অথচ রাষ্ট্রজীবনে তার প্রকাশ নেই। বুদ্ধের ভারতে দলিতদের অসম্মানিত, দলিত করে রাখার প্রক্রিয়া চলছেই। অবমানিত হচ্ছেন খোদ আম্বেডকরও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement