—প্রতীকী ছবি।
বর্তমান কলামলেখক ১৯৯৬ সালে তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে তাঁর নর্থ ব্লকের দফতরে দেখা করেছিলেন। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রসঙ্গ উত্থাপন করবে কি না, এই মর্মে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে মনমোহন খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন: “এ ছাড়া অন্য কোনও বিষয় উত্থাপন করার আছে কি?”
সেই থেকে যাবতীয় নির্বাচনের সময় একই উত্তর ঘুরেফিরে এসেছে। যার মধ্যে রয়েছে ব্যাঙ্কঋণ মকুব, শস্যের বাজারে আহরণ-মূল্যের তুলনামূলক বৃদ্ধি, অধিকাংশ ভোক্তাকে বিনামূ্ল্যে খাদ্যশস্য দেওয়া, তফসিলে নতুন অন্তর্ভুক্ত জাতের জন্য নিয়োগ সংক্রান্ত সংরক্ষণ, অস্থায়ী পেনশন প্রকল্প, বিনামূল্যে প্রদেয় সামগ্রী এবং ভর্তুকির লম্বা তালিকা এবং গরিব মানুষের জন্য (সর্বদা ক্রমবর্ধমান) অর্থপ্রদান। পাশাপাশি, উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য কৃতিত্ব জাহির (বিশেষ করে শৌচালয়, বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট সংযোগ)। অর্থনীতিবিদেরা যাকে সংস্কার বলেন, আর্থিক নীতির মধ্যে সেই নিয়মানুবর্তিতা এবং বাজারমুখীনতার উল্লেখ কিন্তু নির্বাচনী প্রচার বা প্রতিশ্রুতিতে দেখা যায় না।
সম্ভবত এটাই আশা করা যায়। ভোটদাতারা সেই দিকেই তাকিয়ে থাকেন, যেটি তাঁরা এই মুহূর্তেই হাতে পাচ্ছেন। এখানে ‘আগামী’ বলে কিছু নেই। আর যে রাজনৈতিক দল সব থেকে লাভজনক প্যাকেজ তাঁদের সামনে রাখছে, তাকেই তাঁরা বেছে নিচ্ছেন বলে মনে হয়। ফলে রাজকোষের উপর অত্যধিক চাপ পড়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। এই সব প্রতিশ্রুতি মেটাতে গিয়ে স্কুলশিক্ষা, জনস্বাস্থ্যের মতো উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি বিষয়গুলি যে উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে, সে বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্য শোনা যায় না।
রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে কৃষি, বেকারত্ব এবং আয়ঘটিত সমস্যার মতো জ্বলন্ত বাস্তব নিয়ে বিশেষ ভাবনাচিন্তা দেখা যাবে, এমন আশাও করা যায় না। বিহারে জাতগণনা থেকে উঠে আসা তথ্য এবং নিয়োগ সংক্রান্ত সংরক্ষণের বিষয়ে প্রতিশ্রুতির কী অর্থ দাঁড়িয়েছে, তা এক বার বিবেচনা করে দেখলেই বিষয়টা বোঝা যাবে। ১৩ কোটি ১০ লক্ষ জনসংখ্যা বিশিষ্ট একটি রাজ্যে সরকারি চাকরির সংখ্যা সব মিলিয়ে ২০ লক্ষ। অসংরক্ষিত শ্রেণির ক্ষেত্রে বিপুল ভাবে এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেণিগুলির ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও এই অসাম্য সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
যদি এই সমস্যার মোকাবিলা করতে হয় এবং জাত-কাঠামোর প্রধান শ্রেণিগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে সরকারি চাকরির বণ্টনের ব্যবস্থা করতে হয়, তা হলে কী পদক্ষেপ করা উচিত? সে রাজ্যে তফসিলি জাতিভুক্ত জনসংখ্যার ২.৯ লক্ষ মানুষ সরকারি ক্ষেত্রে কর্মরত। সেখানে আরও ১.১ লক্ষ চাকরির সংস্থান হতে পারে। অতিরিক্ত মাত্রায় পিছিয়ে-পড়া সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে ৪.৬ লক্ষ সরকারির কর্মচারীর সঙ্গে আরও ২.৮ লক্ষ যুক্ত হতে পারে। সংরক্ষণ-বহির্ভূত এবং বাকি পিছিয়ে-পড়া শ্রেণির ততটুকুই স্থানচ্যুতি ঘটবে, সংরক্ষণের অংশ বাড়ালে সংরক্ষণ বহির্ভূতদের উপর চাপ আরও একটু বাড়তে পারে। অথচ প্রতিশ্রুতিতে যে পরিমাণ চাকরির কথা বলা হচ্ছে, তা এই পরিসংখ্যানের চেয়ে বেশি নয়। সবমিলিয়ে সংরক্ষণের ক্ষেত্রে জাত-ভিত্তিক পরিবর্তন ঘটালেও সরকারি চাকরির সংখ্যা ১০ লক্ষের নীচেই থাকবে। ১৩ কোটি ১০ লক্ষ জনসংখ্যার একটি রাজ্যে বিষয়টি যে জাতপাত তথা সামাজিক ন্যায় সংক্রান্ত সমস্যার কোনও অর্থবহ সমাধান হতে পারে, তা কি কেউ বিশ্বাস করবেন?
এ বার আসা যাক কৃষকের কাছ থেকে অধিকতর দামে সরকারের ফসল কেনার বিষয়টিতে। বিশেষ করে চাল ও গমের বাজারে চলিত ক্রয়মূল্যের নিরিখে দেখলে তা বেশ খানিকটা বেশি। অন্য দিকে, এই বর্ধিত মূল্য কৃষকদের সামনে এক প্রকার উদ্দীপক হিসাবে কাজ করে এবং তাঁদের চাল ও গমচাষেই বেশি করে উৎসাহিত করে। উৎপাদনের বাড়তি অংশটুকুও তাঁরা সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে ভারমুক্ত হতে চান। ফলে সরকারই কার্যত হয়ে দাঁড়ায় ফসলের একমাত্র ক্রেতা। ব্যক্তিগত বাণিজ্য অথবা কৃষিবৈচিত্রের বিষয়টিকে এখানেই বিদায় জানাতে হয়। অথচ, এই দু’টি বিষয়ের একান্ত প্রয়োজন। আরও প্রয়োজন, ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়া জলাভাবের মোকাবিলা অথবা জলের উন্নততর ব্যবহারের ব্যবস্থা করা।
অন্য দিকে, সরকারি সংগ্রহ ব্যবস্থার পরিকাঠামোও ভাল নয়। বিক্রয়যোগ্য ফসল বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কৃষকের হাতে যে পরিমাণ অর্থ তুলে দেওয়া হয়, তা প্রকৃত পরিবহণমূল্যের অর্ধেক মাত্র। এর ফলে অনেক সময়েই শস্য স্তূপ হয়ে পড়ে থাকে। শেষমেশ তা খয়রাতি করে দায়মুক্ত হতে হয়। সব শেষে, শস্যের বিপণনমূল্য অপরিবর্তিত (আদৌ যদি কোনও মূল্য থেকে থাকে) রয়ে যায়। সেই কারণে সরকারের তরফে ভর্তুকির পরিমাণও বাড়তে থাকে। আন্তর্জাতিক স্তরে কোথাও এ দেশের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উল্লেখ পাওয়া যায় না। যা থেকে কৃষকদের স্থায়ী আয় সংক্রান্ত সমস্যার একমাত্র সমাধানসূত্র পাওয়া যেতে পারত। কৃষকের আয় দ্বিগুণ করার যে প্রতিশ্রুতি এক কালে বিজেপি দিয়েছিল, তা অনেক দিনই বিস্মৃতির আড়ালে চলে গিয়েছে। ‘মোর ক্রপ পার ড্রপ’ (ক্ষুদ্র কৃষি উৎপাদন বিষয়ে বিজেপির স্লোগান)-এর কথাও বোধ হয় এখন আর কারও মনে নেই।
পরিশেষে আসা যাক নগদ প্রদান সম্পর্কে। এ কথা মোটামুটি স্বীকার করেনেওয়া হয় যে, ‘অ্যাবসোলিউট পভার্টি’ (যে অবস্থায় একটি নির্দিষ্ট কালপর্বে কোনও ব্যক্তি বা পরিবারের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় আয়টুকুও থাকে না) ‘মিনিমাল পভার্টি’ (যে আয়ে জীবনধারণের ন্যূনতম চাহিদাগুলি মেটানো সম্ভব)-তে উপনীত হয়েছে। যদিও বিহারের পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যাচ্ছে, সে রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ প্রতি মাসে৬০০০ টাকারও কম আয়ে জীবন ধারণ করেন। যে কোনও দায়বদ্ধ মাপকাঠিতেই বোঝা যায় এটি যথেষ্ট নয়। হয়তো অনেক ক্ষেত্রে আয় কম দেখানো হয়েছে। এ ধরনের সমীক্ষায় এমন প্রায়শই হয়ে থাকে। অন্যান্য রাজ্যের বাসিন্দাদের অবস্থা নিশ্চিত ভাবে এর চেয়ে ভাল। তবুওস্বাধীনতার ৭৬ বছর পরে বেশির ভাগ বঞ্চিত মানুষের আয়ে ভর্তুকি দিতে হয়। ‘এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিম’-এর মতো এ ক্ষেত্রেও ভারতে রাষ্ট্রের তরফে নাগরিক-স্বাচ্ছন্দ্য প্রদানে ব্যর্থতার কথাই উঠে আসে। রাজনীতিবিদরা কথার পাহাড় গড়ে বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে চান। তাতে কিঞ্চিৎ শ্রুতিসুখ মিললেওকোনও সমাধানসূত্র মেলে না।