রফতানি বৃদ্ধি আর সরকারি ক্রয়ের ফলেও খাদ্যশস্যের দাম বাড়ছে
Inflation

গরিব মানুষের পাতে টান

খুচরো বাজারে জিনিসের দাম— বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম— বাড়ছে কেন? একটা বড় কারণ নিশ্চয় পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি।

Advertisement

অভিরূপ সরকার

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০২২ ০৫:০০
Share:

টাকার দাম পড়ছে। এর একটা মানে হল, বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। কিছু দিন আগেও একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে বাজারে গেলে যতটা চাল-ডাল-তেল-মশলা, আনাজ, ফলমূল, মাছ-মাংস কেনা যেত, এখন তার থেকে কম পরিমাণে কেনা যাচ্ছে। টাকার দাম পড়ে যাওয়ার আর একটা মানে হল, বিদেশি মুদ্রার বাজারে টাকার নিরিখে আমেরিকান ডলারের দাম বাড়ছে। অর্থাৎ, প্রতিটি ডলার কিনতে এখন বেশি টাকা লাগছে।

Advertisement

গত ১২ মে কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান বিভাগ জানিয়েছে, এপ্রিল মাসে দেশে খুচরো পণ্যের বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৭৯%। তার মানে, ২০২১ সালের এপ্রিলে খুচরো বাজারে জিনিসপত্রের দাম যা ছিল, তার তুলনায় ২০২২-এর এপ্রিলে জিনিসপত্রের দাম ৭.৭৯ শতাংশ বেড়েছে। তুলনার জন্যে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ২০২২-এর মার্চ মাসে মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৯৫%, আর ২০২১-এর এপ্রিল মাসে ৪.২৩%। কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যান থেকে আরও দুটো জিনিস স্পষ্ট। এক, সম্প্রতি ভারতের শহরাঞ্চলে যে হারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, গ্রামাঞ্চলে বাড়ছে তার তুলনায় বেশি হারে। ২০২২-এর এপ্রিলে শহরাঞ্চলে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হার ৭.০৯%, গ্রামাঞ্চলে ৮.৩৮%। দুই, সাম্প্রতিক কালে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির তুলনায় খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার অনেক বেশি— গ্রামে, এবং শহরে। গ্রামে ৮.৫%, শহরে ৮.০৯%। অর্থাৎ, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিই মূলত খুচরো বাজারে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হারটাকে ঠেলে তুলে দিচ্ছে।

এক বছর আগেও কিন্তু চিত্রটা এ রকম ছিল না। সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হার যেমন অনেক কম ছিল, তেমনই গ্রামের বাজারে জিনিসপত্রের দাম শহরের তুলনায় কম হারে বাড়ত, আর খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির হারের তুলনায় অনেক কম। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল খুবই অল্প— ২০২১-এর এপ্রিলে মাত্র ১.৩১%। মূল্যবৃদ্ধির হার বেড়ে যাওয়ার ফলে মধ্যবিত্তের তো অবশ্যই নাভিশ্বাস উঠছে, কিন্তু দাম বাড়ার প্রকোপ গরিব মানুষের উপর পড়ছে সব থেকে বেশি। এর কারণ, প্রথমত, শহরের তুলনায় গ্রামে বেশি গরিব মানুষ বাস করেন; দ্বিতীয়ত, অপেক্ষাকৃত সচ্ছলদের তুলনায় গরিব মানুষ খাবার-দাবারের পিছনে তাঁদের আয়ের আরও বেশি অংশ ব্যয় করে থাকেন, ফলে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে তাঁদেরই সবচেয়ে ক্ষতি।

Advertisement

খুচরো বাজারে জিনিসের দাম— বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম— বাড়ছে কেন? একটা বড় কারণ নিশ্চয় পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। সারা পৃথিবী যখন একটু একটু করে কোভিডের কবল থেকে বেরিয়ে আসছিল, তখন অর্থনৈতিক লেনদেনও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছিল। ফলে পেট্রল-ডিজ়েলের চাহিদা এবং দাম দুই-ই বাড়ছিল। তার পর রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার কারণে ওই অঞ্চল থেকে পেট্রোলিয়ামের জোগান হঠাৎ কমে গেল, পশ্চিম ইউরোপ রুশ পেট্রলিয়ামের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল, যুদ্ধে ব্যবহারের জন্যে তেলের চাহিদা বাড়ল— সব মিলিয়ে পেট্রল-ডিজ়েলের এখন আকাশছোঁয়া দাম। পেট্রল-ডিজ়েলের দাম বাড়লে পরিবহণ খরচ বাড়ে, কাজেই সব জিনিসেরই দাম বাড়ার কথা। তার উপর কোভিডের সময় সারা পৃথিবী জুড়ে যে জোগান-ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছিল, ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হওয়ার বদলে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ তাকে আরও বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। ফলে পৃথিবীর বাজারে সার্বিক ভাবে জোগানে টান পড়ছে। কিন্তু এ সব দিয়ে সার্বিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ যদি বা বোঝা যায়, আলাদা করে খাদ্যপণ্যের দাম কেন বাড়ল, আর সেটা শহরের তুলনায় গ্রামে কেন বেশি বাড়ল, তার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

বর্তমান প্রতিবেদকের মতে, খাদ্যপণ্য মূল্যবৃদ্ধির একটা বড় কারণ দেশের খোলা বাজারে খাদ্যপণ্য, বিশেষ করে খাদ্যশস্যের জোগানে টান। এর পিছনে আবার দুটো প্রধান কারণ। প্রথম কারণ, খাদ্যশস্যের রফতানি বৃদ্ধি; দ্বিতীয় কারণ, বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্পে বণ্টনের জন্য অধিকতর সরকারি শস্য-সংগ্রহ। গত কয়েক বছর ধরেই চাল এবং গমের রফতানি উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে গিয়েছে। আমেরিকান ডলারে মাপলে ২০১৫-১৬’র তুলনায় ২০২০-২১ সালে, চাল বাদ দিয়ে অন্যান্য খাদ্যশস্যের রফতানি, যার মধ্যে গমের রফতানিও আছে, ১.৬৬ গুণ অর্থাৎ ১৬৬% বেড়েছে। কিছু দিন হল ইউক্রেন থেকে গমের জোগান পৃথিবীর বাজারে আসছে না, তাই ২০২১-২২’এ ভারতীয় গমের রফতানি আরও বেড়েছে, রফতানিমূল্য ২.০৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে— ২০১৫-১৬’র তুলনায় যা প্রায় সাত গুণ বৃদ্ধি। উল্লেখ্য যে, অতি সম্প্রতি
কেন্দ্রীয় সরকার গম রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করল। একই সঙ্গে ২০১৫-১৬ এবং ২০২০-২১’এর মধ্যে চালের রফতানি বেড়েছে ৫০%, যা ২০২১-২২’এ আরও অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯-২০ সালে বাসমতী ছাড়া অন্যান্য চালের রফতানিমূল্য ছিল দু’শো কোটি ডলার। ২০২১-২২’এ সেটা বেড়ে হয়েছে ৬১১ কোটি ডলার। উল্লেখ করা দরকার যে, ২০১৫-১৬ এবং ২০২০-২১’এর মধ্যে সমস্ত পণ্যের মোট রফতানি বেড়েছে মাত্র ১০%। সেই নিরিখে খাদ্যশস্য রফতানির বৃদ্ধি অভূতপূর্ব। রফতানি বাড়ার ফলে দেশের বাজারে জোগান কমে গিয়েছে।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলির নানা রকম কল্যাণমূলক প্রকল্প। প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনায় একা কেন্দ্রীয় সরকারই জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের আওতায় বিপুল সংখ্যক নাগরিককে প্রতি মাসে তাঁদের স্বাভাবিক রেশন-বরাদ্দের উপর অতিরিক্ত ৫ কেজি চাল অথবা গম বিনামূল্যে বিতরণ করছে।
২০২০-র মার্চে প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল। তার পর কয়েক দফায় এর সময়সীমা বাড়নো হয়েছে। শেষতম ঘোষণা অনুযায়ী প্রকল্পটি ২০২২-এর সেপ্টেম্বর অবধি চলবে। এই বিশাল প্রকল্পের সঙ্গে রাজ্য সরকারদের সরাসরি খাদ্য-বিতরণ প্রকল্পগুলোকে যদি যোগ করা যায়, তা হলে বোঝা যাবে যে, গরিবদের মধ্যে বণ্টনের জন্যে শস্য উৎপাদনের যে অংশটা সরকার সংগ্রহ করছে এবং সেই কারণে যেটা খোলা বাজারে পৌঁছতে পারছে না, তার পরিমাণও নেহাত কম নয়। সব মিলিয়ে জোগান কমেছে, খাদ্যশস্যের দাম বেড়েছে। রফতানি বা বণ্টনের জন্যে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য যে হেতু গ্রামের বাজার থেকেই সংগ্রহ করা হয়, তাই গ্রামের বাজারে খাদ্যশস্যের দাম বেড়েছে বেশি।

এখানে মূল্যবৃদ্ধির হার কমানোর জন্যে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ নিয়ে কিছু মন্তব্য প্রয়োজন। মূল্যবৃদ্ধি রদ করার সাবেক দাওয়াই সুদের হার বাড়ানো; এবং ক্যাশ রিজ়ার্ভ রেশিয়ো অর্থাৎ রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে বাধ্যতামূলক ভাবে যে নগদটা বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে জমা রাখতে হয়, সেটাও বাড়ানো। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক দুটোই বাড়িয়েছে। সুদের হার বাড়লে ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে বাড়ি-গাড়ি কেনার প্রবণতা কমে, ফলে বাজারে জিনিসপত্রের চাহিদা হ্রাস পায়। ক্যাশ রিজ়ার্ভ রেশিয়ো বাড়লে, মানুষের হাতে নগদের জোগান কমে গিয়ে জিনিসপত্রের চাহিদা কমে। চাহিদা কমলে জিনিসপত্রের দাম কমার কথা। সমস্যা হল, সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি চাহিদা বাড়ার জন্যে ঘটেনি, জোগান কমার জন্যে ঘটেছে। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের দাওয়াইয়ের ফলে চাহিদা কমে গিয়ে মূল্যবৃদ্ধি হয়তো কিছুটা কমবে, কিন্তু উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান কমবে আরও বেশি। সেটা ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে খুব একটা মঙ্গলজনক হবে না। তার থেকে ভাল হত যদি জিনিসপত্রের, বিশেষ করে দেশের খোলা বাজারে খাদ্যশস্যের জোগান বাড়ানোর জন্যে কোনও পদক্ষেপ কেন্দ্রীয় সরকার করতে পারত।

পরিশেষে টাকার নিরিখে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে দু’একটা কথা। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমাদের ডলার দিয়ে তেল কিনতে হয়। ডলারের দাম বেড়ে গেলে তেলের দাম আরও বেড়ে যায়, যার ফল আরও মূল্যবৃদ্ধি। কিন্তু শুধু টাকা কেন, ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো, ইয়েন সব কিছুর নিরিখেই তো ডলারের দাম বাড়ছে। কারণ, বিদেশি মুদ্রা বাজারের ফাটকাবাজরা মনে করছে বর্তমান পৃথিবীর টালমাটাল অবস্থায় আমেরিকান ডলারই সবচেয়ে নিরাপদ মুদ্রা। তাই তারা আর সব মুদ্রা বিক্রি করে ডলার কিনছে। মজার কথা হল, আমেরিকায় মূল্যবৃদ্ধির হার এখন ৮.৩%, যা আমাদের দেশ এবং আরও অনেক দেশের মূল্যবৃদ্ধির হারের থেকে বেশি। সে দেশে ঋণাত্মক প্রকৃত সুদের হার এখন আমাদের দেশ এবং আরও অনেক দেশের থেকে কম। তবু কেন ফাটকাবাজরা ডলার বা ডলার-বন্ডের দিকে ঝুঁকছেন, সেটা একটা ধাঁধা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement