নরেন্দ্র মোদী তাঁর আট বছর শাসনকালে অনেক কিছুই করেছেন যা বিতর্কিত, এবং নিকট ভবিষ্যতে সেই বিতর্ক প্রশমনের সম্ভাবনা কম। কিন্তু যা নিয়ে দ্বিমত নেই তা হল, ভারতের আর্থিক মানচিত্র এই ক’বছরে পাল্টেছে অপ্রত্যাশিত ভাবে। এই পরিবর্তন যুগপৎ আর্থিক ও সামাজিক, যেমন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন নিয়ে এসেছিল ভারতীয় জীবনে। এই ধরনের পরিবর্তনের পরে সচরাচর পূর্বের স্থিতাবস্থায় প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা থাকে না। যেমন শতরঞ্জ কে খিলাড়ি ছবিতে, যেখানে কোম্পানি দ্বারা অওয়ধ অধিকারের পর শুধু যে দাবা খেলার নিয়মই পাল্টাল তা নয়, বোঝা গেল যে, পাল্টাতে চলেছে সামগ্রিক জীবনধারা।
২০১৪ থেকে ২০২১, এই সাত বছরে ভারতের অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধি হয়েছে ৪০ শতাংশ, যা চিনের পরেই (৫৩%) দুনিয়ায় দ্বিতীয় স্থানে। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের মতে, ২০২৭ সালে ভারতের মোট জাতীয় উৎপাদন হতে চলেছে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার, বিশ্বে পঞ্চম বৃহত্তম। উন্নতি অনেকটা ব্যাহত হয়েছে কোভিড-১৯ অতিমারির জন্য। সমপরিমাণ ক্ষতি হয়েছে অতিমারি নিয়ন্ত্রণে নীতিগত অব্যবস্থার কারণে, এবং তারও আগে নোট বাতিলের তুঘলকি সিদ্ধান্তের ফলে।
তবে সেখান থেকে ভারত এগিয়ে এসেছে অনেক দূর। অনেক নতুন পদ্ধতি প্রবর্তিত হয়েছে, যার বীজবপণ মনমোহন সিংহের আমলে হলেও মোদীই তাঁর রাজনৈতিক শক্তির জোরে সেগুলির বাস্তবায়ন সম্ভব করেন। দৃষ্টান্ত, দেশব্যাপী পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি)। দেশের প্রথা ছিল কেন্দ্রের জন্য একগুচ্ছ কর, রাজ্যের জন্য আর এক। যত কর, ততই কর ফাঁকি। এ সব পিছনে ফেলে অবশেষে মোদী সরকার প্রবর্তন করল এক তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর জিএসটি, যার উদ্দেশ্য কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়ের প্রাপ্য সব রকমের পরোক্ষ কর একত্রে ধার্য করে তা অন্তিম মূল্য থেকে কেটে নেওয়া। ও দিকে, শুধু কর বা শুল্ক আদায়ই নয়, সব রকম ব্যক্তিগত আদানপ্রদানই এখন তথ্যপ্রযুক্তির মুখাপেক্ষী। আজকাল বাজারে মাছ কিনেও অনেকে টাকা দেন ইউপিআই-এর মাধ্যমে। প্রায় কেউই আর অ্যাপ ক্যাবে চড়ে মানিব্যাগ খুলে ভাড়া মেটান না।
এই ক’বছরে পরিকাঠামোর উন্নতি হয়েছে অনেকখানি। ২০১৪ থেকে জাতীয় সড়কের দৈর্ঘ্য বেড়েছে ৫০ শতাংশ। পথে টোল প্লাজ়াগুলিতেও সময় নষ্ট হয় না আর, সরাসরি ই-ওয়ালেট থেকে টাকা কেটে নেয় যন্ত্র। এই আট বছরে অভ্যন্তরীণ বিমানযাত্রীর সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বিমানে মাল ভাড়া থেকে আয় বেড়েছে ৪৪ শতাংশ। সরকারি তথ্য অনুসারে, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে চালু হবে ২২০টি নতুন বিমানবন্দর। বাড়ছে কৃষিজাত পণ্য দ্রুত বিদেশে রফতানির জন্য কার্গো বিমানের সংখ্যা। রেলের গতি বৃদ্ধিরও চেষ্টা চলছে। মূলত কোভিডের তাড়নায় বেড়েছে ইন্টারনেট-সহ মোবাইল ফোনের ব্যবহার, যা এখন সংখ্যায় ৭৮ কোটির বেশি।
উপরোক্ত তথ্যগুলি থেকে অনুমান করা যায়, মোদীর লক্ষ্যটি কী। তাঁরা নিশ্চয়ই চাইছেন ভারতকে এক সুসুংহত অর্থনীতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে, যাতে ভারত পরিণত হয় এক বিশাল ও ঐকিক বাজারে। কিন্তু ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতি— সবই বহুধাবিভক্ত। যেমন ধর্মবিশ্বাস বিভিন্ন, তেমনই বিভিন্ন খাদ্যরুচি, পোশাক, ভাষা, লোকাচার, জীবনের লক্ষ্য ইত্যাদি। ‘বৈচিত্র’ বা ‘বিভিন্নতা’ নিশ্চয়ই গণতন্ত্রপ্রেমীদের কাছে মূল্যবান, কিন্তু ‘পপুলিস্ট’ নেতাদের প্রয়োজন হয় একই মানসিকতাসম্পন্ন ভক্তদের। ভারত তেমন দেশ নয়। অনেক রাজ্য ও অনেক আঞ্চলিক স্বার্থে বিভক্ত এই দেশে এক আইন চাপিয়ে দেওয়া অসম্ভব।
অথচ, ভারতকে একটি সুসংহত বাজার (যেমন চিন) হিসেবে পৃথিবীর কাছে তুলে ধরতে না পারলে কোথা থেকে আসবে ভবিষ্যৎ উন্নয়নের মূলধন? যতই দেশে দেখা যাক কিছু বিদেশি সংস্থার উপস্থিতি— বেঙ্গালুরু বা গুরুগ্রামে— বিদেশি লগ্নির হিসাবে কিন্তু ভারত এক নগণ্য ‘আউটপোস্ট’ মাত্র। বিশ্বের প্রত্যক্ষ লগ্নির মাত্র ২.৪ শতাংশ আসে ভারতে, যেখানে আমেরিকা নিয়ে যায় ২১ শতাংশের বেশি, এবং চিন ও হংকং যুগপৎ ১৬ শতাংশ। দেশে কোথাও এমন গচ্ছিত সম্পদ নেই, যা ব্যবহার করে অর্থনীতি উপর সারিতে উঠতে পারে। বিদেশি বিনিয়োগ মাত্র ছিটেফোঁটায় এলে শাসকদের চলবে কেমন করে?
এ দিকে, পর পর দু’বার সাধারণ নির্বাচনে বিজেপির বিপুল জয়ের ফলে যে কথাটি দৃষ্টি থেকে সরে গিয়েছে তা হল, বিজেপির সুহৃদের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নয়— যার ফলে অর্থব্যবস্থার পদ্ধতিগত পরিবর্তন হলেও আর্থিক সংস্কার করা সম্ভব হচ্ছে না। এখনও অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরা— দেশের মোট কর্মিসংখ্যায় যাঁদের অনুপাত ৮৩ শতাংশ— কাজ করছেন নিয়োগপত্র বা নিয়মিত ছুটির প্রতিশ্রুতি ছাড়াই। কোন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান চাইবে এই ধরনের শ্রম পরিবেশে পুঁজি নিয়োগ করতে?
ও দিকে দেশব্যাপী জিএসটি-র অবস্থাও বেহাল হতে চলেছে। ভারতে কিছু রাজ্য উৎপাদক, বাকিরা মূলত ভোগ করে। জিএসটি-র গঠনটিই এমন যে, ওই করের সিংহভাগ আসে উৎপাদক রাজ্যগুলি থেকে। ২০২০ সালের মাথাপিছু জিএসটি আদায় হিসাবে শীর্ষে গোয়া, দিল্লি, হরিয়ানা ইত্যাদি; পশ্চিমবঙ্গের স্থান বাইশ নম্বরে, তারও নীচে উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের মতো রাজ্য। ওই করের হার প্রভৃতি নির্ধারিত হয় জিএসটি পরিষদে, যেখানে মতবিরোধ ক্রমশ বাড়ছিল। সম্প্রতি জিএসটি সংক্রান্ত একটি মামলায় সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছে, ওই কাউন্সিলের ভূমিকা ‘পরামর্শদাতা’-র। তাই জিএসটি-তে কেন্দ্রের অংশ বিচার করতে হবে সংসদকে এবং রাজ্যের হার সাব্যস্ত করবে সেই রাজ্যের বিধানসভা। অর্থাৎ শেষ হল কেন্দ্র ও রাজ্যের যুগ্ম প্রয়াসে এক দেশে এক বাস্তবসম্মত কর প্রয়োগের স্বপ্ন। আশঙ্কা যে, ফিরে আসবে সেই করব্যবস্থার নৈরাজ্য।
নৈরাজ্যের সঙ্গে যোগ হয়েছে মোদীর স্বপ্নবিলাস। তিনি ভাবছেন প্রযুক্তিচালিত এক ঝাঁ-চকচকে অর্থব্যবস্থা তৈরি করতে পারলে তাঁর স্থান পাকা হবে মহান নেতা হিসেবে। কিন্তু বিদেশি লগ্নিকারীদের কাছে তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা ধোঁয়াশায় পরিপূর্ণ। সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি ক্রেতাদের কাছে বিক্রির কথা বলেও তা হয়ে ওঠে না, যত ক্ষণ না প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বিশেষ কয়েক জন ব্যবসায়ী, অর্থাৎ ‘সাঙাত’, নিলামঘরে হাজির হচ্ছেন। ও দিকে সরকারি নীতি যে কখন পাল্টাবে, তার কোনও স্থিরতা নেই। কোনও কোনও শিল্পক্ষেত্র, যেমন বিমা, একশো শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে; তবুও— সম্ভবত সাঙাতদের পরামর্শেই— বিমা সংক্রান্ত আইনে এমন কিছু ঘোরপ্যাঁচ রেখে দেওয়া হয়েছে যে, নতুন একটি বিদেশি বিমা সংস্থাও ভারতের দিকে পা বাড়ায়নি। ও দিকে নানাবিধ কারণে হাল ছেড়ে ভারত থেকে পালাচ্ছে অনেক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। যেমন গাড়ি নির্মাতা ফোর্ড, মোটরবাইক বিক্রেতা হার্লে ডেভিডসন, সিমেন্ট উৎপাদনকারী হলসিম, জার্মান পাইকারি বিক্রেতা মেট্রো। ২০১৪ সালে মোদীর ক্ষমতায় আরোহণ থেকে এখন পর্যন্ত ২,৭৮৩টি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এই দেশ ছেড়ে চম্পট দিয়েছে।
নরেন্দ্র মোদী খুবই প্রযুক্তি ভালবাসেন। তবে যার মূল্য তিনি বুঝতে আগ্রহী নন, তা হল বন্ধুত্ব ও বোঝাপড়া, সমাজের অন্তর্নিহিত সংহতি। সমস্যা হল, অবিশ্বাস ও আস্থাহীনতার এই সামাজিক আবহাওয়াটি দেশি বা বিদেশি, কোনও পুঁজির পক্ষেই তেমন নিরাপদ নয়।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।