ভারতে পুত্রসন্তানের চাহিদা কমছে, তারই ছাপ লিঙ্গ-অনুপাতে?
Sex Ratio

মেয়েদের সংখ্যা বাড়ছে

প্রতি হাজার পুরুষে মহিলার সংখ্যা এর আগের বারের সমীক্ষার (২০১৫-১৬) তুলনায় অনেকখানি বেড়েছে— ৯৯১ থেকে বেড়ে হয়েছে ১০২০, অর্থাৎ বৃদ্ধি ২৯ বিন্দু।

Advertisement

শাশ্বত ঘোষ

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২২ ০৬:০৪
Share:

প্রতি হাজার পুরুষে মহিলার সংখ্যা এর আগের বারের সমীক্ষার (২০১৫-১৬) তুলনায় অনেকখানি বেড়েছে। প্রতীকী ছবি।

জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষার (ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে, সংক্ষেপে এনএফএইচএস) পঞ্চম দফার (২০১৯-২১) পরিসংখ্যানে দেখা গেল, সামগ্রিক লিঙ্গ-অনুপাত, অর্থাৎ প্রতি হাজার পুরুষে মহিলার সংখ্যা এর আগের বারের সমীক্ষার (২০১৫-১৬) তুলনায় অনেকখানি বেড়েছে— ৯৯১ থেকে বেড়ে হয়েছে ১০২০, অর্থাৎ বৃদ্ধি ২৯ বিন্দু। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে যে, মাত্র চার-পাঁচ বছরের মধ্যে সামগ্রিক লিঙ্গ-অনুপাত কি এতখানি বাড়তে পারে? সমীক্ষায় পাওয়া বেশ কয়েকটি নারীকেন্দ্রিক সূচকে— বিশেষত মাতৃকালীন স্বাস্থ্য সূচকে— অগ্রগতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার একে লিঙ্গবৈষম্য হ্রাসের সূচক হিসাবে মান্যতা দিয়েছে। আবার কিছু বিশেষজ্ঞ তথ্যের গুণমান, কোভিডের সময়ে সমীক্ষা করা রাজ্যগুলির তথ্যের সম্ভাব্য ত্রুটি এবং সর্বোপরি, ভারতের মতো একটি পিতৃতান্ত্রিক দেশে কী ভাবে সামগ্রিক লিঙ্গ অনুপাত হঠাৎ নারীদের অনুকূলে চলে যেতে পারে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে এই সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্যকে অগ্রহণযোগ্য বলেছেন।

Advertisement

উদ্বেগগুলি উড়িয়ে দেওয়ার নয়। কিন্তু, এনএফএইচএস-এর চতুর্থ এবং পঞ্চম দফার মধ্যে মহিলাদের পক্ষে সামগ্রিক লিঙ্গ-অনুপাত বৃদ্ধির সম্ভাব্য কারণগুলি খোঁজা প্রয়োজন। খেয়াল রাখা জরুরি যে, সামগ্রিক লিঙ্গ-অনুপাত প্রধানত জন্মের সময়ের লিঙ্গ অনুপাত, ০-৬ বছর বয়সের শিশুদের মধ্যে লিঙ্গ-অনুপাত, মহিলা এবং পুরুষদের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট বয়সে সম্ভাব্য আয়ুষ্কালের পার্থক্য, এবং মাতৃমৃত্যুর অনুপাত দ্বারা নির্ধারিত হয়। যে রাজ্যগুলিতে সামগ্রিক লিঙ্গ-অনুপাত উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে, যেমন কেরল (অনুপাত বেড়েছে ৭২ বিন্দু) এবং তামিলনাড়ু (৫৫ বিন্দু), সেখানে তা ঘটেছে প্রধানত পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের জন্মের সময় প্রত্যাশিত গড় আয়ু বৃদ্ধির জন্য। তথ্য অনুযায়ী, ২০১০-১৪ সালে কেরল এবং তামিলনাড়ুতে জন্ম নেওয়া মহিলাদের জন্মকালীন প্রত্যাশিত গড় আয়ু পুরুষদের তুলনায় যথাক্রমে ৫.৮ এবং ৪.১ বছর বেশি ছিল। ২০১৬-২০’র মধ্যে রাজ্য দু’টিতে এই ব্যবধান আরও বেড়ে যথাক্রমে ৬.১ এবং ৪.৫ বছর হয়েছে। ২০১০-১৪ সালে ৭০ বা তদূর্ধ্ব বয়সের পুরুষদের তুলনায় একই বয়সে মহিলাদের যত বছর বেশি বাঁচার সম্ভাবনা ছিল, ২০১৬-২০’র মধ্যে তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ, এই রাজ্যগুলিতে এই সময়কালে মহিলাদের জন্মকালীন আয়ু পুরুষদের তুলনায় বেড়েছে তো বটেই, তা পরিণত বয়সেও অব্যাহত রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, এনএফএইচএস-এর বিভিন্ন দফার মধ্যে এই রাজ্যগুলিতে শিশুদের মধ্যে লিঙ্গ-অনুপাত হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু মহিলাদের আয়ু— বিশেষত বেশি বয়সে— অনেকটা বেড়ে যাওয়ার ফলে সামগ্রিক লিঙ্গ-অনুপাতে তার ছাপ পড়েনি। এটাও উল্লেখযোগ্য যে, বর্তমান দশকে জন্মকালীন লিঙ্গ-অনুপাত এই রাজ্যগুলিতে স্থিতিশীল ছিল— প্রতি হাজার পুরুষে কেরলে ৯৭৪ এবং তামিলনাড়ুতে ৯১৭ জন মহিলা।

কিছু রাজ্যে সামগ্রিক লিঙ্গ-অনুপাত উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে— যেমন কর্নাটক (৫৫ বিন্দু), হরিয়ানা (৫০ বিন্দু), পঞ্জাব (৩৩ বিন্দু)— মূলত শিশুদের মধ্যে লিঙ্গ-অনুপাত বাড়ার কারণে। ২০১৫-১৬ এবং ২০১৯-২১’এর মধ্যে এই রাজ্যগুলিতে শিশু লিঙ্গ-অনুপাত যথাক্রমে ৬৮, ৫৭ এবং ৪৬ বিন্দু বেড়েছে। অসম, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ এবং গুজরাতে শিশু লিঙ্গ-অনুপাত যদিও মাঝারি মাপে বৃদ্ধি পেয়েছে (যথাক্রমে ৩৫, ২৯, ৩৮ এবং ৪৯ বিন্দু), সেই তুলনায় এই রাজ্যগুলিতে সামগ্রিক লিঙ্গ-অনুপাত তেমন বাড়েনি (রাজ্যগুলিতে লিঙ্গ-অনুপাত বৃদ্ধি পেয়েছে যথাক্রমে ১৯, ২২, ২২ এবং ১৫ বিন্দু)। দেখা যাচ্ছে, এই রাজ্যগুলিতে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের জন্মকালীন প্রত্যাশিত আয়ু বা বার্ধক্যকালীন আয়ু, কোনওটাই তেমন তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বাড়েনি।

Advertisement

তবে, এই রাজ্যগুলিতে শিশুদের মধ্যে মেয়েদের অনুকূলে লিঙ্গ-অনুপাত বৃদ্ধি ইঙ্গিত করছে যে, পুত্রসন্তানের চাহিদা কমছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকেও সেই একই ইঙ্গিত পাওয়া যায়। পুত্রসন্তানের চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে কি না, তা মাপার একটি শক্তিশালী সূচক এই রকম— কত শতাংশ দম্পতির দু’টি জীবিত কন্যা আছে, কিন্তু কোনও পুত্র নেই, এবং তাঁরা আর সন্তান চান না। ১৯৯২-৯৩ এবং ২০১৯-২১ সালের মধ্যে এই রাজ্যগুলোতে এই সূচক তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বেড়েছে— হরিয়ানাতে ৯% থেকে বেড়ে ৪৪%, পঞ্জাবে ২২% থেকে ৪৭%, উত্তরপ্রদেশে ১৭% থেকে ৪৪%, এবং মধ্যপ্রদেশে ২০% থেকে ৫০%। এটা এক দিকে সরকার ও বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার উদ্যোগে সামাজিক চেতনা বিকাশের নিরন্তর প্রয়াসের সুফল; অন্য দিকে, কন্যাসন্তান-কেন্দ্রিক বিভিন্ন পরিকল্পনার সফল রূপায়ণের ফল।

অন্য কিছু রাজ্যে এনএফএইচএস-এর শেষ দুই দফার মধ্যে সামগ্রিক লিঙ্গ-অনুপাতে বৃদ্ধির পরিমাণ শিশু লিঙ্গ-অনুপাতে বৃদ্ধির চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি। যেমন, রাজস্থান এবং পশ্চিমবঙ্গে শিশু লিঙ্গ-অনুপাত শুধুমাত্র যথাক্রমে ৪ এবং ১৩ বিন্দু বেড়েছে, কিন্তু সামগ্রিক লিঙ্গ-অনুপাত বেড়েছে যথাক্রমে ৩৬ এবং ৩৮ বিন্দু। বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশায় সামগ্রিক লিঙ্গ-অনুপাত বেড়েছে যথাক্রমে ২৮, ৪৮ এবং ২৭ বিন্দু, যদিও এই রাজ্যগুলিতে শিশু লিঙ্গ-অনুপাত কমেছে। এই রাজ্যগুলিতে মহিলা ও পুরুষদের মধ্যে জন্মকালীন প্রত্যাশিত আয়ুর পার্থক্যও এ সময়ে উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়েনি। তা হলে, সামগ্রিক লিঙ্গ-অনুপাত এতখানি বাড়ল কী ভাবে? যদি প্রসূতিমৃত্যুর অনুপাতের দিকে তাকাই (প্রতি লক্ষ জীবিত সন্তানপ্রসবে প্রসবকালীন কারণে মৃত্যুর সংখ্যা), দেখতে পাব যে, রাজস্থান, ওড়িশা এবং বিহার/ঝাড়খণ্ডে এটি ২০১২-১৪ থেকে ২০১৮-২০’এর মধ্যে যথাক্রমে ৫৫, ৪৬ এবং ৪৭ শতাংশ কমেছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে, যদিও প্রসূতিমৃত্যুর অনুপাত মাত্র ৯% কমেছে, জন্মকালীন লিঙ্গ-অনুপাত ২০১৪-১৬ এবং ২০১৮-২০’র মধ্যে ৭ বিন্দু বেড়েছে। তা ছাড়া, পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে দীর্ঘায়ুতে পার্থক্য ২০১০-১৪ এবং ২০১৬-২০’র মধ্যে স্থিতিশীল ছিল। অর্থাৎ, কোনও একটি নির্দিষ্ট কারণে নয়, বরং বিভিন্ন কারণের সংমিশ্রণ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে রাজ্যগুলোতে সামগ্রিক লিঙ্গ-অনুপাত বাড়ছে।

তবে, এই কারণগুলো থেকে সামগ্রিক লিঙ্গ-অনুপাত বাড়ার একটা দিকনির্দেশ পাওয়া গেলেও এর থেকে অবশ্য এনএফএইচএস-এ প্রাপ্ত সংখ্যার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্বন্ধে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় না। এর আগেও দেখা গিয়েছে যে, এনএফএইচএস-এর তথ্য থেকে যে লিঙ্গ-অনুপাত পাওয়া যাচ্ছে, তা জনশুমারি থেকে প্রাপ্ত অনুপাতের চেয়ে বেশি। তার কিছু তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে, এই লেখায় সে প্রসঙ্গে ঢুকব না। ইন্ডিয়ান হিউম্যান ডেভলপমেন্ট সার্ভের (আইএইচডিএস) দ্বিতীয় দফাতেও সামগ্রিক লিঙ্গ-অনুপাতের একই প্রবণতা দেখা গিয়েছে— ২০১১-১২ সালে ১০০০ পুরুষ প্রতি ১০০৪ জন মহিলা, যা ২০০৪-০৫ প্রথম রাউন্ডের তুলনায় খানিকটা বেশি। কোনও বিশদ বিশ্লেষণ ছাড়াই এনএফএইচএস-এর মতো এত বিশাল আকারের সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্য বেমালুম খারিজ করে দেওয়া কাজের কথা নয়। লিঙ্গ-অনুপাত নির্ধারণের শ্রেষ্ঠ পন্থা অবশ্যই জনশুমারি, কিন্তু এই মুহূর্তে এটুকুও জানা নেই যে, পরবর্তী জনশুমারি কবে হবে, বা আদৌ হবে কি না। সেই ক্ষেত্রে এনএফএইচএস-এর তথ্যকে গুরুত্ব দেওয়াই বিধেয়।

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সামগ্রিক লিঙ্গ-অনুপাত ও শিশু লিঙ্গ-অনুপাত বাড়ার প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করার জন্য সামাজিক সক্রিয়তা এবং সংবেদনশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যখন নারীদের অনুকূলে জন্মকালীন লিঙ্গ-অনুপাতের অগ্রগতি নেই বললেই চলে। গত এক দশকে জন্মকালীন লিঙ্গ-অনুপাত বেড়েছে মাত্র এক বিন্দু—প্রতি হাজার পুরুষে ২০১১ সালে ছিল ৯০৬ মহিলা, আর ২০২০ সালে ৯০৭। এই অনুপাতটি কাঙ্ক্ষিত অনুপাত ৯৪৩-এর চেয়ে অনেক কম। এই প্রবণতা ইঙ্গিত করে যে, ভারতের অনেক রাজ্যে, বিশেষত উত্তর-মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে, জন্মের আগে লিঙ্গ-নির্ধারণ ও ভ্রূণহত্যা এখনও অব্যাহত। সরকারি ও সামাজিক হস্তক্ষেপের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হতে পারেন বয়স্ক বিধবারা, কারণ জনসংখ্যায় তাঁদের অনুপাত অদূর ভবিষ্যতে উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পাবে, এবং তাঁরা শুধু গার্হস্থ হিংসার সহজ শিকার নন, সমাজের বিভিন্ন স্তরে হিংসার শিকার।

এই মুহূর্তে লিঙ্গ-অনুপাত বৃদ্ধি নিয়ে উল্লাসের বদলে এই প্রশ্নগুলি নিয়ে মাথা ঘামানোই বিচক্ষণতার পরিচায়ক হবে।

ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ় কলকাতা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement