Kolkata Durga Puja 2023

‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও’

এ বারের পুজোয় বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধিরা যে ভাবে টালা প্রত্যয়, চোরবাগান, চেতলা অগ্রণী, বালিগঞ্জ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের আলোকসজ্জার দিকে অপলক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন তাতে মনে হয় মানিক, শ্রীধরের বিশ্ব কাঁপানো উত্তরসূরি পেয়ে গিয়েছে কলকাতা।

Advertisement

দেবদূত ঘোষঠাকুর

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:০০
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

স্টার্ট, অ্যাকশন, ক্লিক।

Advertisement

চলচ্চিত্রের মতো সব ক্যামেরার সামনে নয়। রেকর্ড করা চিত্রপট দিয়ে দর্শকের মনোরঞ্জন করাও নয়। ইচ্ছেমতো লোকেশন‌ চেঞ্জ করার কোনও সুযোগ নেই। সব থেকে কঠিন বিষয়, এক বার ভুল হলে তার সংশোধন করা অর্থাৎ এডিট করার কোনও সুযোগই নেই। এমন একটা জায়গা তাঁর কর্মভূমি, যেখানে এক বার ভুল হলে তা শুধরে নেওয়ার উপায় নেই কোনও। শত শত দর্শকের সামনে লাইভ পারফরম্যান্স। আর নাট্যমঞ্চের সেই মানুষটাকেই ধরে আনা হল দুর্গাপুজোর মণ্ডপে। নাটকের লোক পুজো মণ্ডপে কী করবেন? তাঁকে যিনি এনেছেন, তিনি মিটিমিটি হাসছেন। কাজের সুবাদে সেই সময় আমিও সেখানে হাজির। আমার কানের সামনে মুখ এনে পুজো-কর্তা বললেন, ‘‘দেখো দাদা ,ফাটিয়ে দেবেন‌ পিনাকীদা।’’ তখনই জানলাম, ওঁর নাম পিনাকী গুহ। উনি ছোটদের অভিনয় শেখান। তবে মঞ্চে ওঁর আসল কাজ আলোক সম্পাতের মাধ্যমে দৃশ্য তৈরি করা। ডায়লগ অনুযায়ী আলো কমিয়ে-বাড়িয়ে আবহ তৈরি করা। বিভিন্ন মূহূর্ত তৈরি করা আবহ সঙ্গীতের সঙ্গে তালমিল রেখে। এই মঞ্চে কতটা সফল হবেন তিনি?

এক সময় কলকাতার বড় পুজো মানেই ছিল চন্দননগরের আলো। গেটের সামনে থেকে শুরু। মণ্ডপের ভিতরে আলোকসজ্জার দায়িত্বেও চন্দননগর। চন্দননগরের চাহিদা দেখে মহানগরীর আনাচেকানাচে মিনি চন্দননগর তৈরির হিড়িক পড়ল। অপেক্ষাকৃত ছোট পুজোগুলি নির্ভর করতে শুরু করল ‘কলকাতার চন্দননগর’-এর উপরে। বেশ কিছু কাল আসল চন্দননগরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যবসা করেছে কলকাতায় গজিয়ে ওঠা চন্দননগর। থিম পুজো এসে সেই ব্যবসাকে চাপে ফেললেও, চন্দননগরের আলোর জাদুকর শ্রীধর দাস মনে মনে হেসেছিলেন। প্রথমে ওই চন্দননগরের আলোকেই পারমুটেশন-কম্বিনেশন করে থিম পুজোর কাজে ব্যবহার করা শুরু হল। যেমন ভাবে টিকে থাকার লড়াইয়ে একটু একটু করে নিজেকে বদলে নিচ্ছিল কুমোরটুলিও।

Advertisement

তখনও সিনেমার আলোক শিল্পী, মঞ্চের আলোক শিল্পীরা পুজোর মণ্ডপে ডাক পেতে শুরু করেননি। আর্ট কলেজের কিছু কিছু ভাস্কর পটুয়াপাড়ার স্টাইল ভেঙে, নিজের স্টাইলে ঠাকুর গড়ছিলেন এখানে-ওখানে।

এই পরিবর্তনটা অবশ্য শুরু হয়েছিল উত্তরের জগৎ মুখার্জি পার্কে। কবিরাজ বাড়ির ছেলে অশোক গুপ্তের হাত ধরে। উত্তরের সেই পরিবর্তনটাই হাইজ্যাক করে নিল পূর্ব কলকাতা। পিকনিক গার্ডেন্সের অনুব্রত চক্রবর্তীর কথা আমার বেশ মনে আছে। ওঁদের পাড়ার বন্ধন রাহাদের সঙ্গে নিয়ে নতুন একটা ঘরানার পুজোর জন্ম দিয়েছিলেন অনুব্রতেরা। এই অনুব্রত আবার নাটকের লোক। পুজোয় নাটকের সেট তুলে আনার প্রবণতা শুরু হয় তিলজলা-পিকনিক গার্ডেন্স থেকে। বিশেষ করে পুজোর আলোকসম্পাতটা ছিল নাটুকে।

নাটকের বা চলচ্চিত্রের সেটের আদলে মণ্ডপ তৈরি কৌশলের পূর্ণতাপ্রাপ্তি ঘটল থিম শিল্পী সুশান্ত পালের হাত ধরে। নাটক বা চলচ্চিত্রের সেটকে পরিমার্জন করে যে মণ্ডপ তৈরির কাজে লাগানো যায় তার উদাহরণ সুশান্ত। এই শিল্পকলাকে নিজের মতো করে দুমড়েমুচড়ে প্রতি বছরই নতুন স্বাদ উপহার দিয়ে গত ২৫ বছর ধরে কলকাতার পুজোকে শাসন করছেন এই শিল্পী। প্রথম প্রথম নিজেই আলোর কৌশল ঠিক করতেন সুশান্ত। আবহ সঙ্গীতও। এখন অবশ্য পেশাদার আলোক শিল্পীরা আলোকসজ্জার বিষয়টি দেখেন। আবহ সঙ্গীতেও পেশাদার লোক। তবে অনুব্রতেরা পড়ে আছেন ২৫ বছর আগের যুগে। তাই এখন আর কল্কে পায় না ওই সব পুজো।

থিম পুজোয় আলোকসম্পাতে পাকাপাকি ভাবে মঞ্চের আলোর আগমন খুব সম্ভবত অজেয় সংহতিতে এই শতকের একেবারে গোড়ার দিকে। রবীন্দ্র সদনে আলোকসম্পাত করতেন হাসি পাঞ্চাল। ‘মাটিতে আলোতে’ থিমটিকে বাস্তবায়িত করেছিলেন আলোর জাদু দিয়ে। এর পরে একে একে অন্যদের আসা শুরু। কনিষ্ক সেনের মতো ভারতখ্যাত আলোক শিল্পীও উপেক্ষা করতে পারেননি মায়ের ডাক। এর পরে ধীরে ধীরে পিনাকী, প্রেমেন্দুবিকাশ চাকীরা এলেন কলকাতার পুজোয়। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন আরও অনেকে। তাঁদের কেউ কেউ নিজেদের জাহির করতে ব্যস্ত। কেউ আবার নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। যেমন পিনাকী।

একেবারেই গোবেচারা ভদ্রলোক। না-গোঁজা বুক শার্ট, পায়ে চপ্পল অথবা কাবুলি জুতো। চুল কোনও সময়েই পাট পাট করে আঁচড়ানো অবস্থায় দেখিনি। মুখে সব সময়েই হাসি। কথাবার্তায় অমায়িক। বাইরেটা যতই নরম, ভিতরটা ততটাই কঠিন। বিশেষ করে কাজের সময়টায়। এক বার কাজ শুরু করলে, শেষ না-হওয়া পর্যন্ত থামেন না তিনি। থামতে জানেন না। কেউ কাজে হস্তক্ষেপ করুক তা চান না। পুজোকর্তা মন্ত্রী হন বা সাংসদ, পুরসভার মেয়র পারিষদ হন কিংবা বিধায়ক— পিনাকীর নীতির পরিবর্তন হয় না। বুক বাজিয়ে তাই বলতে পারেন, ‘‘আমার কাজটা আমাকেই বরং করতে দিন।’’

নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই কাজ শেষ করেন। তাই বাধ্য হয়ে থিম শিল্পীকে তার আগেই মণ্ডপের কাজ শেষ করতে হয়। প্রতিমা তৈরি করে তারও আগে প্রতিমাশিল্পীকে ঠাকুর মণ্ডপে তুলে দিতে হয়। তাঁরা বলেন, ‘‘পিনাকীদা থাকলে চাপে পড়ে যাই। তবে তাড়াতাড়ি মণ্ডপের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় শেষ মুহূর্তের ভুলত্রুটিগুলি শুধরে নেওয়া যায়।’’ যাঁকে ভাল লেগে যায়, তাঁর জন্য সব কিছু করতে পারেন মানুষটি। এমনকি, স্বেচ্ছায় মণ্ডপে আলোকসম্পাতের দায়িত্ব নেন। পরামর্শ মানা হচ্ছে কি না, তা দেখতে হঠাৎ হঠাৎ ওই মণ্ডপে হানা দেন। পারিশ্রমিক নেন না। বলেন, ‘‘মানুষ এসে দেখবে। ভাল বলবে। সেটাই তো আসল পুরস্কার। সব কিছু টাকা দিয়ে হয় না!’’ যদি দেখেন পরামর্শ মানা হচ্ছে না, নীরবে সরে যান। প্রাপ্য টাকাপয়সা না-নিয়েই। এটাই তাঁর একমাত্র অহমিকা। এসেছিলেন পারিশ্রমিক নিয়ে আলোকসম্পাত করার অভিলাষ নিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নাম লেখালেন পুজো পাগলদের দলে।

একডালিয়া এভারগ্রিন, সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার, কলেজ স্কোয়ার, মহম্মদ আলি পার্ক, বাগবাজার সর্বজনীন, সিংহী পার্ক, ম্যাডক্স স্কোয়ার, শ্রীভূমি স্পোর্টিংরা অবশ্য কখনই থিমের স্রোতে ভেসে যায়নি। সাবেক প্রতিমা আর চন্দননগরের আলোর জোরেই তারা টানছে লাখ লাখ মানুষকে। জিতেন পাল, মোহনবাসী রুদ্রপাল, সুনীল পালদের মতো কলকাতার পুজোয় শ্রীধরও সমান প্রাসঙ্গিক।

১৯৫৬ সালে স্কুলজীবনের গণ্ডি পেরোনোর আগেই আলোর দুনিয়ায় পা রাখেন শ্রীধর। তাঁরই হাতে তৈরি এসডি ইলেকট্রিক কোম্পানির এক সময় ছিল জগৎজোড়া নাম। টিনটিন থেকে হাঁদা ভোঁদা, মাদার টেরিজা থেকে সত্যজিৎ রায়, ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ থেকে মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল খেলা, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ, জুরাসিক পার্ক থেকে চিড়িয়াখানা— সব জীবন্ত হয়ে উঠেছে শ্রীধরের শৈলীতে। একটা সময় বাজার ছেয়ে গেল চিনা আলোয়। টুনি বাল্বের কপাল পুড়তে শুরু হল তখনই। এর পরে এল এলইডি। কলকাতার পুজোয় প্রয়োজন ফুরোতে শুরু করল চন্দননগরেরও। তবে শ্রীধর পুরোপুরি অতীত হয়ে যাননি। চন্দননগরের চারমন্দির তলায় প্রথম ফাইবারে ঢালাই করা আলো ‘টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার’ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। পিনাকীদের কাছে তিনি রয়ে গিয়েছেন পথপ্রদর্শক হিসেবে। ক্লান্ত ‘ঘোড়া’ এ বার থামতে চায়। অবসর নিয়ে শ্রীধর সুযোগ করে দিতে চান উত্তরসূরিদের।

২০০৩ সালে আমেরিকার ডেনভার বিমানবন্দরে নেমে লেজার আলোর কারসাজিতে হতচকিত হয়ে গিয়েছিলাম। চমৎকৃত হয়েছিলাম এটা জেনে যে, ওই আলোকসজ্জার মূল কারিগর এক বাঙালি। মানিক সরকার। জাদু সম্রাট জুনিয়র পিসি সরকারের অগ্রজ। মানিক, শ্রীধর তাঁদের জাদু দিয়ে জয় করেছেন রাশিয়া, আমেরিকা, ইংল্যান্ড। এ বারের পুজোয় বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধিরা যে ভাবে টালা প্রত্যয়, চোরবাগান, চেতলা অগ্রণী, বালিগঞ্জ কালচারাল অ্যাসোসিয়েশনের আলোকসজ্জার দিকে অপলক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন তাতে মনে হয় মানিক, শ্রীধরের বিশ্ব কাঁপানো উত্তরসূরি পেয়ে গিয়েছে কলকাতা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement